ক্রমশ এখন বুড়িয়ে যাচ্ছি খোকা!
আর কিছুদিন পরে-
হয়তোবা আরো বুড়ো হয়ে যাবো আমি,
একেবারে সেই থুত্থুরে এক বুড়ো!
তখন কি তুই আমার পাশেই থাকবি?
তখন কি তুই ভালোবেসে বুকে রাখবি?


হয়তোবা তোর অনেক দামের কাচের বাসন-বাটি,
কাঁপা কাঁপা হাতে ধরতে গেলেই ছিটকে পড়বে, ওরে;
যদি ভেঙে যায়; তবে,
তখন কি তুই ভীষণ রাগ করবি?
ডাইনিং-এ তোর সুন্দর সাদা বিছানো চাদরখানি,
খাওয়ার সময় যদি তরকারিসহ উল্টিয়ে দিই বাটি,
অথবা, পানি ভরা গ্লাসখানি যদি ফেলে দেই আমি,
রাগ করিস না খোকা।
বলিস না তুই চিৎকার করে জোরে-
‘তুমি আস্ত একটা বোকা!’
বুড়োরা যে চায় একটু করুণা, এতটুকু ভালোবাসা!
তুই কি জানিস, খোকা?


হয়তো, একদিন আমি  শুনবো না রে ভালো,
বলিস না তুই তখন-
‘বধির কিংবা কালা’,
তোর মুখেরই কওয়া কথাটি আবার বলিস ধীরে,
ক্ষমা করে দিস আমায়, যাচ্ছি বুড়ো হয়ে।


শক্তি যখন হারিয়ে যাবে, কাঁপবে আমার হাঁটু,
দাঁড়াতে আমার হাতটা ধরিস চেপে;
হাসি মুখে তুই একটু সাহস তখন আমায় দিস,
ভালোবেসে তুই ভালোবাসার কথাটি আবার বলিস।
আমার পায়ের পাতায় উপর পা দু'খানি রেখে
যেমনি করে শিখেছিলি, প্রথম হাঁটা তুই।
তেমনি করে আমায় না হয় হাঁটিয়ে নিস রে বাপ।


জানিস খোকা, জানিস?
বুড়োরা সবাই ভাঙা রেকর্ড, ঘ্যানরঘ্যানর করে,
বকরবকর সারা দিনমান, একঘেয়েমির সুর;
অধৈর্য তুই হইস না বাপ, বকবকানি শুনে,
কষ্ট হলেও আমার কথা শুনিস মনোযোগে!
মনে পরে তোর! ছোট্ট বেলার কথা?
একটা ঘুড়ি পাওয়ার জন্যে
ঘ্যানরঘ্যানর করতিস কানের পাশেই বসে;
কিনে দিলেই শান্ত হতিস, কেউ জানে না তা',
সেইসব কথা আমি জানি, আর জানে তোর মা।


এখন আমার গায়ের গন্ধ উৎকট হবে জানি,
‘বুড়োটে গন্ধ' এ কথা নিয়ে বলিস না তুই কিছু,
গোসল করার জন্য আমায় করিস নারে জোর,
ঠাণ্ডা পানির পরশ পেলেই ঠাণ্ডা লেগে যায়,
অনেক কষ্ট হবে রে আমার বুঝে নিস তুই, খোকা!
বুড়োদের যে কত কষ্ট! একদিন তুই বুঝবি,
কালের চক্রে তুইও যে খোকা একদিন বুড়ো হবি।
শরীরের গন্ধে নাক সিটকায়ে থাকিস না তুই দূরে,
তুই যে আমার রক্তকণিকা, র'স এ হৃদয় জুড়ে।
বিশ্বাস কর, বৃদ্ধ হওয়া নয়তো রে কোন পাপ!
এ কথাটি মনেতে রাখিস, বাপ।


হাতে যদি একটু একটু সময় থাকে গল্প করিস, কেমন?
কিছুটা সময় আমার জন্য রাখিস পৃথক করে।
একা একা রবো সারাদিন ধরে,
তুই যদি এসে গল্প করিস,
তখন আমার সময়গুলো কাটবে চমৎকার!
জানি খোকা, জানি, ভীষণ ব্যস্ত, ভীষণ ব্যস্ত তুই!
তারই মাঝে একটু সময় আমার জন্যে দিস,
এই বুকখানি শীতল হবে, জানিস কি তুই, জানিস?
মনে আছে তোর? সেই ছোটকালে বিছানায় শুয়ে শুয়ে,
গল্পা শোনার জন্য কত আবদার  করতিস প্রতিদিন?
গল্পের ছলে রাজরাজড়ার ছেলে বানাতাম তোরে,
ইনিয়েবিনিয়ে কতো যে বলেছি,
শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে যেতিস তুই ওরে।
কত কথা তুই বলতিস খোকা গল্পকথার নামে,
সুবোধ ছেলের মতন আমিও শুনে যেতাম সে সব কথা-
ছিলো না যার মানে।
তোর সে গল্প হতো না যে শেষ,
নদীর স্রোতের মতোই চলতো অফুরান কাল ধরে।


হয়তোবা আমি একদিন রবো একলাই বিছানায়,
ভুল করে যদি তোর চাদরটা ভিজিয়ে দেই,
অথবা নোংরা করে দেই যদি অসচেতনার ভুলে।
রাগ করিস না, ক্ষমা করে দিস, যাইস না আমায় ছেড়ে।
আমার শেষ বয়সে থাকিস হাতটা ধরে,
বৃদ্ধাশ্রমের নিঃসঙ্গতায় পাঠাইস নারে, বাপ!
মহান প্রভুর মৃত্যুর দূত আসবে যখন নিতে,
আমার হাতটি শক্ত করে রাখিস তোরই হাতে,
একটু সাহস দিসরে আমায়, খোকা,
ভয়হীনতার সাথে
আমি যেন ওই মৃত্যুকে পারি করতে আলিঙ্গন।


ভাবিস না খোকা,
চলে গেলে একা ওপারের দেশে,
ফিসফিস করে বলবো আমি মহান প্রভুর কাছে;
তুই যে আমায় ভালোবেসেছিলি,
আমার বৃদ্ধকালে যত্নআত্তি করেছিস অনেক।
নিশ্চয় তিনি তোর প্রতিও হবে রে রহমশীল।
তোর ছেলে আবার তোরই মতন ভালোবাসবে তোরে।
স্মরণে রাখিস, মানুষের এই জীবনযাপন জটিলতাহীন,
জীবনের চাকা চক্রাকারেই চলে।


০৯/০৯/২০১৭
মিরপুর, ঢাকা।