মহামান্য জয়যাত্রার টং-ঘরের চায়ের দোকানে
ওরা কয়েকজন কাঠুরিয়া
নিয়মিতভাবে দোতারা ও খঞ্জনি বাজিয়ে গান গায়
প্রত্যেক রাতের নিবিড় গহীনে।
জঙ্গলের পাশ দিয়ে নদী বয়ে গেছে
নদীটির নাম কালিন্দী-ইছামতি
কিশোরীর নূপুরের মসৃণ শব্দের সুর তুলে
সে নদীর জলরাশি সাগরের দিকে হেঁটে যায়।
কালিন্দির পাশে গহীন জঙ্গল-
বৃক্ষে মহীরূহে ঝোপঝাড়ে, লতাপাতায় ঘন বন
মনে হয়, এতো সে-ই বৃন্দাবন!
সঙ্গীতের মুর্চ্ছণায় বৃক্ষের পাতারা উন্মাতাল
নৃত্যের ঝংকারে মৃত্তিকা ও নদীজল কম্পমান
অন্তহীন আনন্দের মহামিলনের লীলাস্থান।
জঙ্গলের তীর ঘেঁসে চায়ের দোকান
বুর্জ খলিফার চোখবাঁধাঁনো অপার সৌম্যতা যেনো
দাঁড়িয়ে আছে মাথা উঁচু করে এ রুক্ষ মরুতে
আনন্দের স্রোতে কোথাও ভাসিয়ে নিতে
দুঃখকাতর এসব কাঠুরিয়াদের মৌন-মৃত প্রাণ।
কালিন্দী-ইছামতি এক বয়সী নদী
পৃথিবীর রুক্ষতায় মানুষের হিংস্রতায়
তার জলের প্রবাহ কম
অথচ, কাকচক্ষুর নির্মল স্বচ্ছতা জেগে উঠে
তার বুকে, মনোরম জলের ফোঁটায়।
এ নদীতে নৌকা চলে
পাল তুলে, হেলে দুলে
দুপুরে, সন্ধ্যায়, নিস্তব্ধ রাত্রির কালে
চাঁদের নরম ‌জ্যোৎস্না যখন গলে গলে ঝরে পড়ে
তরল রূপার মতো উজ্জ্বলতা নিয়ে
তখন ওরা- বেদনাহত কাঠুরিয়ার দল
পাখিদের মতো ডানা ঝাপটিয়ে
সুরের মাতমে মেতে উঠে অনন্ত আনন্দে
গলা ছেড়ে গান গায় তালে ও বেতালে
কবিতার হাড়গোড় রক্ত-মাংস চটকায় সারারাত ধরে
ভুলভাল উচ্চারণের রসিকতায়।
সেখানে কোন পাহাড় নেই, পাহাড় ছিলো না
সেখানে কোন সাগর নেই, সাগর ছিলো না
অথচ, শনশন বাতাসের ঘায়ে আমোদিত হয়
স্নিগ্ধ মধ্যরাত দুঃখমাখা কাঠুরিয়াদের প্রাণ
জয়যাত্রার চায়ের দোকান
অনন্ত বিথির উচ্ছ্বসিত বাতাসের তোড়ে
দুলে উঠে, নেচে উঠে, হেসে উঠে
তুচ্ছ, জড় মানুষের মৃতবৎ প্রাণ
কিন্তু সেই সব বাতাসের সুরভী নেহাতই কম।
তবুও, মখমলের মতোন ঘাসের উপরে পা ছড়িয়ে
সমুদয় মৃতপ্রাণে অসীম আশির্বাদের পরশের প্রত্যাশায়
দূরের উদার আকাশের দিকে ওরা তাকায়।
অথবা, কখনো সখনো শুধুই বসে থাকে চুপচাপ করে
কবরের নিঃস্তব্ধতা ধীরে ধীরে নেমে আসে
শিশিরের শব্দহীন পদক্ষেপ তুলে।


সেই সব কাঠুরিয়াদের দলে ছিলো-
ইজ্জত আলী সরদার
ছোকরাগোছের লাজুক একটি ছেলে-
ইজ্জু নাম তার
বয়সকে পরাজিত করা বয়সী যুবক- মিস্টার দাদু
সম্পর্কের আড়ালে হারিয়ে গেছে যার আসল নামখানি
দরাজ কণ্ঠের অরুণ- অদ্ভুত ভূত নামেই যে খ্যাত
কথার প্যাচালে বিদ্ধকরার শাণিত প্রাণের কল্প
কবিতার কথায় জ্বালা ধরে যার প্রাণে
বউসোহাগী কাব্যরসিক অনন্য মনন।
কখনোবা হাজির হন প্রতিবেশীদের দু'একজন-
তুষার কিংবা ত্রিভুবন
মাঝে মাঝে চকোলেট
অথবা ডেভিল ইনসাইড নামের সেই লগ্ল
যার কণ্ঠের লালিত্যে ঝরে যায় কাব্যসুধার আকর
আহা! তারাও সঙ্গত দিতো প্রাণের উচ্ছ্বাসে স্যাঙ্গাত হয়ে।


তারপর, বহু বহুদিন পরে
এই সকল সোনালী চায়ের কাপ
স্মৃতির পালকে ভর করে কাঠুরিয়াদের সূর্যাস্তের কালে
পরীদের মসৃণ দু'হাতে ধরা
রেকাবিতে অতুল স্বপ্নের মতো দেখা দিবে
বিস্মৃতির অতল গহ্বর থেকে নবতররূপে
আজকের জয়যাত্রার রঙিন টংঘরের চায়ের দোকান
এলেবেলে সুরের গানের আখড়া
এবং কবিতার মধুরিমা
আর চুপচাপ করে বসে থেকে
রাতের তারা গোনার অলৌকিক প্রহরের কথা।


২০/১০/২০২০
মিরপুর, ঢাকা।