মানুষ মনের প্রকাশিত আবেগকে বলা হয় ভাব। আর এই ভাব থেকেই রসের উৎপত্তি। কবির সৃষ্টসাহিত্য ভাবরসে রূপান্তরিত হয়েই কাব্যরস সৃষ্টি করে। কাব্যরস কবিতার উল্লেখযোগ্য একটি বিষয়। কাব্যের রস হলো, কাব্য ও অলঙ্কার শাস্ত্রে; তথা, সাহিত্যে ভাবের বহিঃপ্রকাশ। রসের আক্ষরিক অর্থ হলো− আস্বাদনীয় বা রসনাগ্রাহ্য গুণের প্রকাশ বিশেষ। এই বিচারে রস ছয় প্রকারঃ  মধুর, অম্ল, লবন, কটু, কষায়, তিক্ত। কিন্তু ভারতীয় নাট্য, কাব্য ও অলঙ্কার শাস্ত্রে রসের ভিন্নতর রূপ আছে। এই রস সৌন্দর্যবোধের একটি ভিন্নতর দশায় উপস্থাপন করা হয়। কবিতায় কোন বর্ণনা, শ্রবণ বা পাঠ করে শ্রোতা বা পাঠকের মনে যে ভাবের উদয় হয়; সেই ভাবের স্থায়িত্বের প্রকাশই কাব্যরস । কবিতার নন্দনতত্ত্বের আলোকে কাব্যরসকে কাব্যের অমৃত বলেও অবহিত করা হয়ে থাকে। ভারতীয় নাট্যশাস্ত্রের নন্দনতত্ত্বের বিচারে রস ৮ প্রকার। কিন্তু, কাব্য শাস্ত্রে সেই ৮ প্রকার রসের সাথে আরো দু'টি রসের (শান্ত রস ও বাৎসল্য রস) কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ, কাব্যবোদ্ধাগণের মতে, কাব্যরস ১০ (দশ) প্রকার। যথা- ১। শৃঙ্গার রস, ২। হাস্য রস, ৩। করুণ রস, ৪। বীর রস, ৫। অদ্ভুত রস, ৬।  ভয়ানক রস, ৭। বীভৎস রস, ৮। রৌদ্র রস, ৯। শান্ত রস এবং ১০। বাৎসল্য রস।


কাব্যে রসের ব্যবহারের কয়েকটি উদাহরণ নিচে দেয়ার চেষ্টা করছি। এ ছাড়াও, কোন কবিবন্ধুর যদি আরো সুন্দর উদারহরণ জানা থাকে; তবে, মন্তব্যের মাধ্যমে প্রদান করে, আলোচনাটিকে অধিকতর সম্মৃদ্ধ করলে খুশি হবো।


১। শৃঙ্গার রসঃ কাব্যে যে ভাব প্রকাশের মাধ্যমে নায়ক-নায়িকা তথা প্রেমিক-প্রেমিকার মনের অনুরাগ বা ভালোবাসার কথাকে প্রকাশ করা হয়ে থাকে।


উদাহরণ-
যখন তোমার সাথে আমার হলো দেখা
        লেকের ধারে সঙ্গোপনে,
বিশ্বে তখন মন্দা ভীষণ, রাজায় রাজায়
        চলছে লড়াই উলুর বনে।
যখন তোমার পায়রা-হাতে হাতটা রেখে
        ডুবে থাকি স্বর্গসুখে,
তখন কোনো গোলটেবিলে দাবার ছকে
        শ্বেত পায়রাটা মরছে ধুকে।
(প্রেমের কবিতা)- কবি শামসুর রাহমান


২। হাস্য রসঃ কবিতার যে বাক্যে বা ভাব প্রকাশের মাধ্যমে শ্রোতা বা পাঠকের মনে হাসির উদ্রেক করা হয়ে থাকে।


উদাহরণ-
সফদার ডাক্তার মাথা ভরা টাক তার
খিদে পেলে পানি খায় চিবিয়ে।
চেয়ারেতে রাতদিন বসে গোণে দুই তিন
পড়ে বই আলোটারে নিভিয়ে।
(সফদার ডাক্তার)- কবি হোসনে আরা


৩। করুণ রসঃ কাব্যে যে নেতিবাচক বা অপ্রিয় ভাবের প্রেক্ষিত প্রকাশ করে শ্রোতা বা পাঠকের মনে শোকের সঞ্চার করা হয়ে থাকে।


উদাহরণ-
সবচেয়ে যে ছোট্ট পিড়িখানি
সে খানি আর কেউ রাখেনা পেতে,
ছোটথালায় হয় নাকো ভাত বাড়া
জল ভরে না ছোট্ট গেলাসেতে।
বাড়ির মধ্যে সবচেয়ে যে ছোট
খাবার বেলা কেউ ডাকে না তাকে।
সবচেয়ে যে শেষে এসেছিল,
তারই খাওয়া ঘুচেছে সব আগে।
(ছিন্ন মুকুল)- কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত


৪। বীর রসঃ  কাব্যের যে ভাবের প্রকাশের মাধ্যমে  দয়া, দান, দেশভক্তি, বিদ্রোহ ইত্যাদির ক্ষেত্রে উৎসাহ বিষয়ক ভাবের প্রকার করা হয়ে থাকে।


উদাহরণ-
কারার ঐ লৌহকপাট
ভেঙ্গে ফেল, কর রে লোপাট
রক্ত-জমাট
শিকল পূজার পাষাণ-বেদী
ওরে ও তরুণ ঈশান!
বাজা তোর প্রলয় বিষাণ!
ধ্বংস নিশান
উড়ুক প্রাচীর প্রাচীর ভেদি
(কারার ঐ লৌহ কপাট) - কবি কাজী নজরুল ইসলাম

৫। অদ্ভুত রসঃ  কাব্যে যে বক্তব্য প্রকাশের ক্ষেত্রে আশ্চর্যজনক বিষয়কে নিয়ে বিস্ময়াত্মক ভাবের প্রকাশ করা হয়ে থাকে।


উদাহরণ- (আমার জানা নেই। কোন বন্ধুর জানা থাকলে মন্তব্যে লিখুন)।


৬।  ভয়ানক রসঃ কাব্যের যে ভাবের প্রকাশের ক্ষেত্রে শ্রোতা বা পাঠকের মনের ভেতরে ভীতি সৃষ্টি করা হয়ে থাকে।


উদাহরণ-
দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার হে!
লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে, যাত্রীরা হুঁশিয়ার।।
দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ-
ছিঁড়িয়াছে পাল কে ধরিবে হাল, কার আছে হিম্মত।
(কাণ্ডারী হুশিয়ার)- কবি কাজী নজরুরুল ইসলাম


৭। বীভৎস রসঃ  কাব্যে যে ভাবের প্রকাশে শ্রোতা বা পাঠকের মনে ঘৃণাবোধের ভাব প্রকাশ করা হয়ে থাকে।


উদাহরণ-
কাঁচা মাংস খায় কেহ ভাজা ঝোলে ঝালে,
মানুষের গোটা মাথা কেহ ভরে গালে।
(নেট থেকে সংগৃহীত)


৮। রৌদ্র রসঃ কাব্যে প্রকাশিত এমন ভাব, যা শ্রোতা বা পাঠকের মনে রাগান্বিত ভাবের বা ক্রোধের উদ্রেক করা হয়ে থাকে।


উদাহরণ-
(দুর্যোধন ধৃতরাষ্ট্রকে বলেছিলো)
নিন্দা! আর নাহি ডরি,
নিন্দারে করিব ধ্বংস কন্ঠরুদ্ধ করি।
নিস্তব্ধ করিয়া দিব মুখরা নগরী
স্পর্ধিত রসনা তার দৃঢ়বলে চাপি।
(কাহিনী) - কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


৯। শান্ত রসঃ  কাব্যের যে বক্তব্যের মাধ্যমে ধীরস্থিরভাবে তত্ত্বজ্ঞানের প্রকাশের নিমিত্ত শান্তভাবের উদয় ও অনুরাগ সৃষ্টি করা হয়ে থাকে।


উদাহরণ-
শোনা গেল লাশকাটা ঘরে
নিয়ে গেছে তারে;
কাল রাতে - ফাল্গুনের রাতের আঁধারে
যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ
মরিবার হল তার সাধ ।
(আট বছর আগে একদিন) - কবি জীবনানন্দ দাশ


১০। বাৎসল্য রসঃ  কবিতায় সন্তান, শিষ্য বা অনুজের প্রতির স্নেহ-বাৎসল্যের যে ভাবের প্রকাশ করা হয়ে থাকে।


উদাহরণ-
আমাদের বাড়ি না আসিয়া তুই ভালো করেছিস মেয়ে,
আমরা কি আর এমন করিয়া সাজাতাম তোরে পেয়ে!
এ বাড়িতে তুই সন্ধ্যা-প্রদীপ শান্ত গৃহের কোণে,
এ বাড়ির তুই শুভশঙ্খ যে বাজিস সকল ক্ষণে।
এ বাড়ির তুই মঙ্গলঘট বহিয়া শীতল বারি,
যে আসে নিকটে স্নেহ-মমতায় আপন হস যে তারি।
এ বাড়ির তুই সন্ধ্যা-মালতী আঙিনার কোণে ফুটে,
বিছায়ে দিছিস সন্ধ্যার মেঘ আকাশ হইতে লুটে।
(মেয়ে) -কবি জসীম উদ্দীন


অবশ্য, কোন কোন পণ্ডিতজন শান্ত রসকে করুণ রসের অন্তর্গত বিষয় বলেও উল্লেখ করেছেন।সর্বপরি, কবিতা শুনতে, পড়তে বা আবৃত্তি করতে গেলে কাব্যরসের ধারণা রাখতে হয়। অপরদিকে, কবিকে কবিতা রচনা করতে গেলেও কাব্যরস সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা উচিৎ। এতে শ্রোতা ও পাঠকের বোধের উৎকর্ষতা লাভ হয়। কবির লেখা কবিতা শ্রোতা বা পাঠকের কাছে নান্দনিক হয়ে উঠে। কখনো কখনো কাব্যরস শ্রোতা ও পাঠককে মনজগতে সৃষ্ট সৌন্দর্যের ভেতর এতটাই গভীরে টেনে নিয়ে যায়, সে তখন রসজগতে দ্রবীভূত হতে থাকে।


২৬/০৮/২০২১
মিরপুর, ঢাকা।