পূর্ব-সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আসরের প্রাণ-কবি অনিরুদ্ধ বুলবুল নিজের ট্যাক্সি নিয়ে এলেন আমাকে নিয়ে মিলন চক্রে সামিল হওয়ার ইচ্ছায়। মিরপুর থেকে যাওয়ার পথে শেওড়াপাড়া হতে কবি রুনা লায়লাকে তুলে নিয়ে গাড়ি সাঁই সাঁই চলছে আমাদের প্রাণের বইমেলা, বাংলা একাডেমির দিকে। আজ অন্যরকম  ঢাকার শহর। যানজট এবং জানজট কোনটাই প্রায় নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি-এর সামনে গিয়ে গাড়ি থামলো। টিএসটির পর যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ। তাই, হেঁটেই যেতে হলো বাংলা একাডেমির নজরুল চত্বরে।


কবি হুমায়ূন কবির কবিদের মিলন চক্রের ব্যাজ ও ব্যানার তৈরী করার গুরু-দায়িত্বটা সানন্দে নিজের ঘাড়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য তার অফিসের জরুরী কাজের জন্য মিলনচক্রে উপস্থিত হতে পারেননি। কিন্ত, তিনি ছিলেন দায়িত্বের প্রতি বিশ্বস্ত। তাই, তার একজন বন্ধুর মারফত পাঠিয়ে দিয়েছেন মিলনচক্রের ব্যানার ও ব্যাজ সুদূর গাজিপুর থেকে। ধন্যবাদ কবি হুমায়ূন কবির।


পথে থাকতেই জানতে পেরেছি কবি ফয়েজউল্লাহ রবি ও কবি মোঃ  মনিরুল ইসলাম (মনির) আছেন নজরুল মঞ্চের কাছে। আমরা বেলা তিনটার কাছাকাছি সময়ে কাঙ্ক্ষিত বইমেলা প্রাঙ্গনে পৌঁছলাম। আমাদের পৌঁছার আগেই নজরুল মঞ্চে অপেক্ষা করছিলেন সুদূর কুমিল্লা থেকে আগত কবি আবদুল্লাহ আল-নিটাব খাঁন ও তার বন্ধু (নামটি মনে নেই)। বাংলা-কবিতার কবিদের মিলন চক্রের ব্যানার টাঙানো হলো। ব্যানার দেখে দেখেই একজন একজন করে জড়ো হতে লাগলো নজরুল মঞ্চের অশ্বত্থ গাছের ছায়াতলে।


এরপর, একে একে আসতে থাকেন সর্বকবি আনোয়ার পারভেজ শিশির, মোহাম্মদ মুনিরুজ্জামান, মলয় গাঙ্গুলী, রবিউল হাসান, রুহুল আমীন রৌদ্র ও কবির বন্ধু দুলালুর রহমান (আপন), রাবেয়া রাহীম ও কবির বোনের মেয়ে মায়ামাখা মুখশ্রীর মম (তাকে দেখে মা ডাকতেই ইচ্ছে করে; নামের সার্থকতা যথার্থই হয়েছ)। সিমন চন্দন বৈরাগী স্বপরিবারে হাজির হয়েছেন, স্ত্রী- মুন্নী বৈরাগী এবং কিউট একজন ছেলে অর্ণবকে নিয়ে। কবি ফিরোজ হোসেন দু'হাতে দুই সন্তান- মেয়ে নিহা হাসলিনা এবং ছেলে শেখ তালহা যোবায়েরকে নিয়ে হাস্যমুখে এগিয়ে এলেন। পরস্পর পরিচয় তুলে ধরে আলাপ করছে। এমন সময় দেখি আমার ডান পাশে কবি রাবেয়া রাহীমের সাথে খুব হাস্যোজ্জ্বল দু'জন প্রাণবন্ত যুবক কথা বলছেন। একজনের মাথায় বেনী বাঁধার মতো চুল, যদিও শাররীক অবয়ব ও চেহারা বলিষ্ঠ পুরুষালী। এগিয়ে পরিচিতি জানতে গিয়েই জানলাম একজন আসরের কবি মীম মাশকুর, অন্যজন ছড়াকার ইমরান হাসান জেসন। যিনি বাংলা-কবিতার নিবন্ধিত  কবি নন বটে; সামহোয়ারইন ব্লগে নিয়মিত লেখেন। এরই মাঝে যে-ই এসে নিজের পরিচয় দিয়ে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন, তাকেই কবি রুনা লায়লা একটি করে 'ফক্স ক্যাণ্ডি' ধরিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু এ লেবেনচুষ চিনির বদলে পানি দিয়ে তৈরী মনে হয়; না মিষ্টি, না তিতা, শুধুই একটু সুবাসিত এবং ক্রমশ গলে যাওয়া ঝিঁকার কষের মতো।


কবি অসীম সাহার সাথে গতকাল রাতে কথা হয়েছিল। বলেছিলেম- দাদা, আমরা কয়েকজন বাংলা একাডেমির নজরুল মঞ্চে মিলিত হবো, আপনি যদি বইমেলায় থাকেন; তবে, মোবাইল দেবো। আপনার সাথে দেখা করবো। কিন্তু শ্রদ্ধেয় কবি আমাদেরকে বিস্মিত করে নিজেই চলে এসেছেন। কবি অসীম সাহাকে কবি রুনা লায়লা যথারীতিভাবে ক্যাণ্ডি বাড়িয়ে দিলেন। কবি ডায়াবেটিসের দোহাই দিয়ে নিতে অস্বীকৃতি জানালে, তাঁকে ম্যাংগোবার দিয়ে আপ্যায়ণ করা হয়। আমরা সবাই কবির সাথে ফটোসেশন করলাম। কিছুক্ষণ পরেই আমাদের মাঝে হাজির হলেন মেয়ে নুসরাত জাহান এবং মেয়ে-জামাই মোঃ নাজমুল হক (জামাইবাবু দেখতে খুবই সুন্দর ও হাসিখুশি)-কে সাথে নিয়ে কবি মোঃ নূরুল ইসলাম, সে-ই সুদূর ময়মনসিংহ থেকে (এই জন্য কবিকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই)। সবশেষে এলেন আসর কবি হাফিজুর রহমান চৌধুরী।


এমন সময় কবি ফয়েজউল্লাহ রবি এলেন এক সুসংবাদ নিয়ে। তার বন্ধু (নামটি ভুলে গিয়েছি)  জিটিভে আছেন। তারা বইমেলা থেকে লাইভ অনুষ্ঠান দেখাচ্ছেন। ইচ্ছে করলে আমরা টিভিতে লাইভ প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করতে পারি। বললাম, সুসংবাদ। প্রচারেই প্রসার। তবে, আগে জেনে নাও, আমাদের ব্যানারসহ লাইভ দেখাবে কি না। অল্প কিছুক্ষণের মধেই কবি রবি সুসংবাদ বয়ে নিয়ে এলেন।


আমাদের অনেকেই সাথে করে বই, ব‌্যাগ, খাবার ইত‌্যাদি নিয়ে এসেছিলেন; যা নজরুল মঞ্চের বেদীতে জড়ো করে রাখা হয়েছিলো। আমি সে সকল মূ‌ল্যবান সম্পদাদি পাহারায় নিযুক্ত রইলাম আর কবি অনিরুদ্ধ বুলবুলের নেতৃত্বে সকলে ব‌্যানারসহ লাইভ অনুষ্ঠানের ক্যামেরার চোখের সামনে চলে গেলেন। বেদীর উপরে বসে আমি আমার ভাঙ্গা পা দোলাতে দোলাতে হাসি-খুশিমাখা উচ্ছ্বল মুখগুলো দেখতে থাকলাম। পৌঢ়া মা যুবক সন্তানের হাত ধরে প্রাণের বইমেলায় আসছেন। প্রজাপতির মতো ছোট ছোট শিশুরা রঙিন জামা পড়ে বয়স্কদের হাত ধরে বইমেলা প্রাঙ্গনে ঢুকে এক অনাবিল আনন্দের ঢেউ তুলে ছুটে বেড়াচ্ছে, কপোত-কপোতির মতো হাত ধরাধরি করে যুবা-যুবীরা প্রাণোচ্ছ্বলতায় হেঁটে যাচ্ছে। দেখতে খুবই ভালো লাগছে আমার।


কিছুক্ষণ পর, শশ্রুমণ্ডিত কবি আনোয়ার পারভেজ শিশির ফিরে এসে বললেন, আমার শরীরটা বেশি ভালো লাগছে না। আমি এখানে বসি, আপনি যান লাইভ অনুষ্ঠানের ক‌্যামেরার চোখের আওতায়। ক্রাচে ভর দিয়ে যখন ওখানে গেলাম, বুকের সাঁটানো বাংলা-কবিতার ব্যাজ দেখেই বোধ হয়, টিভি-কর্মী তার হাতে ধরা মাউথস্পিকারটি আমার মুখের সামনে এগিয়ে দিলেন। বাংলা কবিতা ওয়েবসাইট সম্পর্কে যৎসামান্য জানি, তা' সংক্ষেপে বলার চেষ্টা করেছি। অতঃপর, সবাই ফিরে এলাম যথাস্থানে এবং পরস্পর পরস্পরের সাথে আলাপ ও  মোবাইলে ছবি তোলার পর্ব চললো অনেকক্ষণ।


কবি পলক রহমানের একক কাব্যগ্রন্থ 'বৈশাখ অহংকারের আলপন' ও কবি রুমা চৌধুরীর সাথে যৌথ কাব্যগ্রন্থ 'শার্সির ওপারে শেষ পদক্ষেপ'  এবং উদ্যোমী কবি শিমুল শুভ্রের সম্পাদিত কাব্য গ্রন্থ 'কাব্য শতদল' এর মোড়ক উন্মোচনের জন্য আমার সদলবলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের স্থাপিত বইমেলার মূল প্রাঙ্গনে যাই। মোড়ক উন্মোচনের জন্য নির্ধারিত বেদীতে অনেক ভীড় ও সিরিয়াল দীর্ঘ হওয়ার কারনে আমরা যে যে প্রকাশনা থেকে বইগুলো প্রকাশ পেয়েছে, সে সকল স্টলের সামনেই মোড়ক উন্মোচনের অনুষ্ঠানের আনন্দটি উপভোগ করে নেই। এখানে 'মাই টিভি'-এর ক্যামেরা ক্রু-গণ আমাদের অনুষ্ঠান রেকর্ড করেন। খবরে প্রচার হবে বলে শুনেছি। উপস্থিত কবিদের সকলেই কেউ এক কপি এবং কেউবা একাধিক কপি 'কাব্য শতদল' সংগ্রহ করে পরস্পর বিদায় নিয়ে চলে আসি।


চলে আসতে গেলেই আসা যায় না। ছোটগল্পের মতো 'শেষ হয়েও হলো না শেষ'-এর মতো সবাই চললো চা-পানের জন্য স্টল খোঁজাখুঁজিতে। এবার বইমেলার আশেপাশে কোন প্রকার দোকান বসতে দেয়া হয়নি। হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরীর পিছনের চত্বরে। ওখানে বসলাম- সর্বকবি অনিরুদ্ধ বুলবুল, ফয়েজউল্লাহ রবি, আবদুল্লাহ আল-নিটাব খাঁন, মোহাম্মদ মুনিরুজ্জামান, মোঃ মনিরুল ইসলাম (মনির), আনোয়ার পারভেজ শিশির (যিনি নিজে অসুস্থবোধ করলেও প্রাণের আবেগের তাড়ণায় আমাদের ছেড়ে যাননি)। আর একমাত্র পূতপবিত্র সাদা শাড়িতে সজ্জিত হয়ে আসা কবি রুনা লায়লা। এখানে আমরা ল্যাম্পপোস্টের আলোকে অমজাদার ফুচকা অতঃপর ঘটি-চানাচুরের স্বাদ জিহ্বায় ধারণ করে পস্পরের থেকে বিদায় নিয়ে ফিরে চললাম আপন কুলার পানে। সাঙ্গ হলো বাংলা কবিতার আসরের কবিদের ১৭-০২-২০১৭ তারিখের মিলনচক্র। ধন্যবাদ।


বিঃদ্রঃ আসছে রোববার, ১৯/০২/২০১৭ তারিখ, বিকেল বেলায় আমাদের প্রাণ-প্রিয় বাংলা কবিতা ওয়েবসাইটের সুদক্ষ এডমিন পাগল কবি নামে খ্যাত আশফাকুর রহমান পল্লব বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণের বইমেলায় উপস্থিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। যারা তার সাথে সাক্ষাতে আগ্রহী তারা বইমেলা প্রাঙ্গণে কবি অনিরুদ্ধ বুলবুল বা আমার মোবাইলে যোগাযোগ করবেন।