কবিতা লেখার কিছু গুরুত্বপূর্ণ কৌশল আছে; যেগুলো অনুসরণ করলে একজন কবিতালেখক সহজেই প্রভাবশালী ও সুন্দর কবিতা লিখতে পারেন। নিচে তার কিছু মূল কৌশল তুলে ধরার চেষ্টা করা হলোঃ
১. ভাব বা অনুভব নির্ধারণ করাঃ
প্রথমেই ঠিক করতে হবে, আপনি কী অনুভব বা বার্তা প্রকাশ করতে চান? প্রেম, বেদনা, প্রকৃতি, প্রতিবাদ, নিঃসঙ্গতা ইত্যাদি। কবিতায় ভাব ও অনুভব নির্ধারণ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক বিশ্লেষণমূলক দিক। এটি কবিতার অন্তর্নিহিত অর্থ, আবেগ এবং কবির মনের অবস্থার অনুধাবন করতে সহায়তা করে। নিচে এই বিষয়ে আলোচনা করা হলোঃ
ভাব নির্ধারণ কি?
ভাব বলতে বোঝানো হচ্ছে, কবিতার মূল চিন্তা, দৃষ্টিভঙ্গি বা বক্তব্য। কবি কী বলতে চাইছেন? কী বার্তা দিতে চাইছেন? সেটাই কবিতার ভাব। ভাব নির্ধারণের মাধ্যমে কবিতার মূল সুর ও উদ্দেশ্য বোঝা যায়। ভাব নির্ধারণের ধাপসমূহঃ
(ক) কবিতার বিষয়বস্তু অনুধাবন করা; অর্থাৎ, কবি কী বিষয়ে লিখেছেন?
(খ) কবিতার প্রেক্ষাপট বোঝা; অর্থাৎ, কবিতাটি কোন পরিস্থিতিতে বা পরিবেশে লেখা?
(গ) চিত্রকল্প ও প্রতীক বিশ্লেষণ; অর্থাৎ, কবি কোন রূপক, প্রতীক বা চিত্র ব্যবহার করেছেন?
(ঘ) ভাষা ও রচনাশৈলী বিশ্লেষণ; অর্থাৎ, কবির ব্যবহার করা শব্দ, অলঙ্কার, বাক্যগঠন কেমন?
অনুভব নির্ধারণ কি?
অনুভব হলো, কবিতাটি পাঠকের মনে কী ধরণের আবেগ বা মনোভাব সৃষ্টি করে এবং কবির মনের গভীর আবেগ কীভাবে প্রকাশ পায়? অনুভব নির্ধারণের উপায়ঃ
(ক) কবিতার আবেগ বিশ্লেষণ করা; অর্থাৎ, এটি সুখের, দুঃখের, বিরহের, প্রেমের না উদ্দীপনার কবিতা?
(খ) কবিতার স্বভাব অনুযায়ী শব্দ বেছে নেওয়া; অর্থাৎ, কবি কোন ধরনের শব্দ ব্যবহার করেছেন? (উদাহরণ- বেদনা, আনন্দ, শূন্যতা ইত্যাদি)
(গ) পাঠকের প্রতিক্রিয়া অনুধাবন; অর্থাৎ, কবিতা পড়ে পাঠকের মনে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়?
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়-
কবিতা "আমার সোনার বাংলা"- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
এখানে ভাব হলো, মাতৃভূমির প্রতি অগাধ ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা।
আর অনুভব হলো, গভীর দেশপ্রেম, আত্মনিবেদন, আবেগময় গর্ব।
কবিতায় ভাব ও অনুভব নির্ধারণ মানে হলো কবির মনের গভীরে প্রবেশ করে তাঁর ভাষার, চিত্রকল্পের ও আবেগের মাধুর্য অনুধাবন করা। এটি পাঠকের সাহিত্য-রসগ্রহণে সহায়তা করে এবং কবিতার প্রকৃত সৌন্দর্য উদ্ঘাটন করে।
২. ভাবনায় গভীরতা আনাঃ
কবিতা সংক্ষিপ্ত হয়, তাই কম শব্দে গভীর ভাব প্রকাশ করতে হয়। কবিতার প্রতিটি শব্দের অর্থ ও দ্যোতনার প্রতি মনোযোগ দিতে হবে। কবিতায় ভাবনার গভীরতা আনা হলো, কবিতাকে ভাবগতভাবে সমৃদ্ধ করা। যাতে পাঠকের মনে দাগ কাটে এবং চিন্তার খোরাক জোগায়। গভীর ভাবনা একটি কবিতাকে কেবল আবেগপ্রবণ নয়, বুদ্ধিবৃত্তিকভাবেও অর্থবহ করে তোলে।
(ক) ভাবনার গভীরতা বলতে কী বোঝায়?
ভাবনার গভীরতা মানে হলো, কেবল সরল বা উপরিতলের অনুভব নয়। বরং, সেই অনুভবের অন্তরালে থাকা অর্থ বা মানে, দর্শন, জীবনবোধ বা জিজ্ঞাসার দৃষ্টিকে ধরতে পারা। পাঠক যেন একাধিক স্তরে কবিতাটি উপলব্ধি করতে পারেন। প্রথম পাঠে একরকম; আবার গভীরে যেতে যেতে নতুন নতুন অর্থ উন্মোচিত হয়।
(খ) কীভাবে কবিতায় ভাবনার গভীরতা আনা যায়?
দার্শনিকতা যুক্ত করার মাধ্যমে কবিতায় ভাবনার গভীরতা আনা সম্ভব। জীবনের অর্থ, মৃত্যু, সময়, সম্পর্ক, নিঃসঙ্গতা ইত্যাদি বিষয়ে গভীর চিন্তা কবিতাকে ভাবনাসমৃদ্ধ করে তোলে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, জীবনানন্দ দাশের কবিতায় সময় বা নিষ্প্রাণতার যে দর্শন উঠে আসে, তা গভীর ভাবনার। প্রতীক ও রূপক ব্যবহার করেও ভাবনার গভীরতা আনা যায়। সরাসরি না বলে রূপকে বা প্রতীকে বোঝালে পাঠক ভাবতে বাধ্য হয়। যেমন, 'পাখি' শব্দটি শুধু একটি প্রাণী নয়; এ শব্দটি স্বাধীনতার প্রতীক বা আত্মার প্রতীকও হতে পারে। দ্ব্যর্থতা ও বহুমাত্রিকতা রাখার মাধ্যমেও ভাবনার গভীরতা তুলে আনা যায়। একটি চিত্র বা বাক্য যেন একাধিক অর্থ বহন করতে পারে। পাঠকের নিজস্ব অভিজ্ঞতা অনুযায়ী অর্থ খুঁজে নিতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, 'আলো এসে আঁধার ঢাকে'- এটি বাহ্যিক আলো হতে পারে; আবার মানসিক উপলব্ধির ইঙ্গিতও হতে পারে। নীরবতা ও অস্পষ্টতার সদ্ব্যবহার করেও ভাবনার গভীরতা আনা সম্ভব। সবকিছু বলে না দিয়ে বক্তব্যে কিছুটা ফাঁক রাখা। যাতে পাঠককে ভাবনার জায়গা দেওয়া। কবি শঙ্খ ঘোষ, জীবনানন্দ দাশ প্রমূখ কবিগণ এই কৌশল চমৎকারভাবে ব্যবহার করেছেন। জীবনের চেনা জগৎকে নতুনভাবে দেখার কৌশল ভাবনার গভীরতা আনতে সহায়তা করে থাকে। সাধারণ দৃশ্য বা অভিজ্ঞতা থেকেও অন্যরকম প্রশ্ন তুলে ধরা। যেমন, 'একটি কাক' বা 'ঝরা পাতা' দিয়ে মানবজীবনের নশ্বরতা বোঝানো যেতে পারে। একটি উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, 'ঝড়ে পড়া ঝরা পাতাটি ভাবছিল, সে কি বৃক্ষের অন্তিম ভাষা'? এখানে, ভাবনার গভীরতা হলো, পতন, মৃত্যু, শেষের পরও এক ধরনের যোগাযোগ বা অর্থ খোঁজার চেষ্টাকে প্রতীকের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে। কবিতায় ভাবনার গভীরতা আসে অভিজ্ঞতা, অন্তর্দৃষ্টি ও ভাষার সূক্ষ্ম ব্যবহারে। কবি যত বেশি নিজের ভেতরে তাকাতে পারবেন, জীবনের গূঢ় সত্য খুঁজে নিতে পারবেন, তত বেশি তাঁর কবিতা গভীর হয়ে উঠবে।
৩. ছন্দ ও মাত্রা বোঝাঃ
বাংলা কবিতায় ছন্দের তিনটি মূল ধরণ- স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ও অক্ষরবৃত্ত। ছন্দ অনুসরণ করলে কবিতার সুরে একটি তাল ও সঙ্গতি আসে। তবে আধুনিক কবিতায় অনেক সময় ছন্দ ভেঙেও লেখা হয়। কবিতায় ছন্দ ও মাত্রা বোঝা খুবই জরুরী। এটি বাংলা কবিতার একটি মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ দিক। ছন্দ ও মাত্রা কবিতার সঙ্গীতধর্মিতা, গতি ও রূপ নির্ধারণ করে। নিচে সহজ ও সংক্ষিপ্তভাবে এই দুটি বিষয় তুলে ধরা হলো।
(ক) ছন্দ কি?
ছন্দ হলো কবিতার ধ্বনিগত বিন্যাস বা কাঠামো। এটি কবিতার সুর, গতি ও তাল নির্ধারণ করে। ছন্দের সাহায্যে কবিতার একটি সংগঠিত রূপ তৈরি হয়; যা পাঠকের মনে একটা ছন্দোময় অনুভূতি জাগায়।
(খ) মাত্রা কি?
মাত্রা হলো ধ্বনির দৈর্ঘ্য। প্রতিটি শব্দ বা অক্ষরের উচ্চারণে নির্দিষ্ট সময় লাগে। এই সময়কালই হলো মাত্রা। বাংলা কবিতায় দু'ধরনের অক্ষর আছে- মুক্তাক্ষর ও বদ্ধাকর। এই অক্ষর গণনার মাধ্যমে মাত্রা নির্ধারণ করা হয়।
৪. উপমা ও রূপকের ব্যবহারঃ
কবিতায় চিত্রকল্প তৈরি করতে উপমা, রূপক, অলংকার, প্রতীক ব্যবহৃত হয়। এগুলো কবিতাকে আরও জীবন্ত ও বিমূর্ত করে তোলে। কবিতায় উপমা ও রূপক হলো কবিতার অলংকারশাস্ত্রের অন্যতম প্রধান দিক। উপমা ও রূপক কেবল কবিতাকে অলংকৃত করে না; বরং, ভাবপ্রকাশকে করে অধিক সজীব, চিত্রময় ও হৃদয়গ্রাহী।
(ক) উপমাঃ
যখন কোনো বস্তু বা ভাবের তুলনা অন্য কোনো বস্তু বা ভাবের সঙ্গে স্পষ্টভাবে তুলনাসূচক শব্দ ব্যবহার করে করা হয়, তখন তাকে উপমা বলে। 'সে ফোটে ফুলের মত'। অথবা, 'তুমি যেন চাঁদের আলো'। উপমা সরাসরি তুলনার মাধ্যমে ভাব প্রকাশ করা হয়। যাতে পাঠক বুঝতে পারে, ‘একটি বস্তু অন্যটির মত’।
(খ) রূপকঃ
যখন কোনো তুলনাসূচক শব্দ ছাড়াই একটি বস্তুকে আরেকটি বস্তু বলে ধরে নেওয়া হয়, তখন তাকে রূপক বলে। রূপকে তুলনা অন্তর্নিহিত, প্রকাশ্য নয়। কবিতার ভাষায় একটি বস্তু সরাসরি অন্য বস্তুতে রূপান্তরিত হয়। 'তুমি আমার হৃদয়ের চাঁদ'। অথবা, 'জীবন এক চলমান নদী'। রূপক অলংকারে তুলনা আড়ালে থাকে। এটি গভীরতা ও কাব্যিক ব্যঞ্জনা বাড়ায়। পাঠকের কল্পনার জগতে একটি বিমূর্ত রূপ তৈরি করে।
উপমা কবিতাকে সহজবোধ্য ও কোমল করে তোলে। আর, রূপক কবিতায় আনে গভীরতা, বিমূর্ততা ও ধ্যানী ভাব। উভয়ই কবির ভাব প্রকাশে সহায়তা করে এবং পাঠকও সহজে অনুভব করতে পারে। উদাহরণ দিয়ে বলা যেতে পারে,
'তুমি আছো হৃদয়ে,
যেন শীতের সকালের সূর্য;
আলোর মতো শান্ত।
তুমি আমার সাহস,
তুমি নিজেই একটি দীপ'।
এখানে, উপমা (যেন শীতের সকালের সূর্য) এবং রূপক (তুমি নিজেই একটি দীপ)।
৫. ধ্বনিগত সৌন্দর্য বজায় রাখাঃ
শব্দের ধ্বনি ও মিল, অনুপ্রাস ইত্যাদির দিকে খেয়াল রাখলে কবিতাকে শ্রুতিমধুর করে তোল। কবিতা শুধুমাত্র ভাবপ্রকাশের একটি মাধ্যম নয়; এটি একধরনের সঙ্গীতও বটে। শব্দের ধ্বনি, ছন্দ, অলঙ্কার, অন্ত্যমিল এবং মাত্রা, এই সমস্ত উপাদান মিলেই গড়ে ওঠে কবিতার ধ্বনিগত সৌন্দর্য। এ সৌন্দর্য পাঠকের মনে একটি শ্রুতিমধুর অনুভূতির সৃষ্টি করে। যা কবিতাকে শুধুই পাঠযোগ্য নয়; বরং, শ্রবণযোগ্যও করে তোলে। এই ধ্বনিগত সৌন্দর্য বজায় রাখার জন্য যা প্রয়োজন, তা হলো-
(ক) ছন্দ ও মাত্রার গুরুত্বঃ
ছন্দ কবিতার হৃদস্পন্দন। নির্দিষ্ট ছন্দে রচিত কবিতা পাঠকের মনে সংগীতধর্মী আবেশ তৈরি করে। যেমন বাংলা সাহিত্যে ব্রজবুলি বা পয়ার ছন্দে লেখা কবিতাগুলি একটি সুনির্দিষ্ট ছন্দবদ্ধ সুর ধারণ করে। মাত্রাবৃত্ত বা স্বরবৃত্ত ছন্দে ধ্বনির ওঠানামা কবিতাকে প্রাণবন্ত করে তোলে।
(খ) অন্ত্যমিল ও অনুপ্রাসঃ
অন্ত্যমিল কবিতার সুরে সংগতি আনে এবং শ্রোতার মনে একটি ছন্দময় সমাপ্তির অনুভূতি জাগায়। অনুপ্রাস অলঙ্কার মাত্র। যেমন একাধিক শব্দে একসঙ্গে এক বা কাছাকাছি ধ্বনির পুনরাবৃত্তি করা। কবিতার ধ্বনিগত সৌন্দর্য বহুগুণে বাড়িয়ে তোলে।
(গ) শব্দচয়ন ও ধ্বনির সঙ্গতিঃ
ধ্বনিগত সৌন্দর্য বজায় রাখতে শব্দচয়নে সংবেদনশীল হওয়া আবশ্যক। উচ্চারণে মাধুর্যপূর্ণ, ছন্দে গাঁথা শব্দ কবিতার আবেগকে শ্রুতিগোচর করে তোলে। অপ্রাসঙ্গিক, ভারী বা খটমট শব্দ ধ্বনিসৌন্দর্য নষ্ট করতে পারে।
(ঘ) বাক্যগঠন ও বিরামচিহ্নের ব্যবহারঃ
বাক্যগঠনে স্বাভাবিক ছন্দ বজায় রাখা এবং যথাযথ বিরামচিহ্নের মাধ্যমে শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি নির্ধারণ করলে কবিতা পাঠে সঙ্গীতধর্মী প্রবাহ বজায় থাকে। ধ্বনি কখন থামবে? কোথায় বাড়বে? এসব সূক্ষ্ম দিক কবিতার শ্রুতিমাধুর্যে বড় ভূমিকা রাখে। ধ্বনিগত সৌন্দর্য কবিতার এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এটি পাঠকের কানে সুরের দোলা তোলে; হৃদয়ে জাগায় আবেগের স্পন্দন। ভাব, ভাষা ও শব্দের সংমিশ্রণে যদি সঠিক ধ্বনি ব্যবহার করা যায়, তবে সেই কবিতা হয়ে ওঠে শ্রুতিমধুর ও চিরস্থায়ী।
৬. পাঠকের ভাবনায় জায়গা রাখাঃ
সব কিছু স্পষ্ট করে বলার বদলে ইঙ্গিতপূর্ণ ভাষা ব্যবহার করলে পাঠক নিজে ব্যাখ্যা করতে পারে; এটা ভালো কবিতার লক্ষণ। কবিতা একটি শিল্প, যার সৌন্দর্য কেবল কবির ভাব প্রকাশে নয়; বরং, পাঠকের মনের অংশগ্রহণেও নিহিত। কবিতায় পাঠকের ভাবনার জন্য জায়গা রাখা মানে, কবি এমনভাবে ভাষা, চিত্রকল্প ও ভাব প্রকাশ করবেন, যা পাঠকের কল্পনা ও অনুভূতির জন্য উন্মুক্ত থাকে। এটি কবিতাকে একমুখী নয়, বহুমাত্রিক করে তোলে। যেখানে পাঠক নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, অভিজ্ঞতা ও আবেগ নিয়ে কবিতার অর্থ আবিষ্কার করে নিতে পারে। এক্ষেত্রে কবির কবিতায় থাকতে হয়-
(ক) স্পষ্টতা ও অস্পষ্টতার ভারসাম্যঃ
একটি ভালো কবিতা কখনোই অতিরিক্ত ব্যাখ্যামূলক হয় না। কবি ইচ্ছাকৃতভাবে কিছু ফাঁক রেখে দেন। যেখানে পাঠক নিজস্ব ভাবনা বসাতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, জীবনানন্দ দাশের কবিতায় প্রকৃতি ও স্মৃতির যে ঘনঘোর চিত্র থাকে, তা কখনো পুরোপুরি বোঝার নয়। তবে, অনুভবের জন্য পর্যাপ্ত।
(খ) প্রতীক ও চিত্রকল্পের ব্যবহারঃ
প্রতীক ও চিত্রকল্প কবিতায় ভাব প্রকাশের এক সূক্ষ্ম উপায়। যা পাঠকের কল্পনাকে সক্রিয় করে। যেমন, 'নীল আকাশ'; কবিতায় কখনো কখনো শুধুই আকাশ নয়; এটি হতে পারে স্বাধীনতা, বিষণ্নতা কিংবা অনন্তকালের প্রতীক। পাঠক যেভাবে নিতে চান। কবি এখানে ভাবনার দায়িত্ব পাঠকের ওপর ছেড়ে দেন।
(গ) মৌনতা ও অসম্পূর্ণতার ভূমিকাঃ
অনেক সময় কবিতার অন্তিম পঙ্ক্তি বা ভাবটি সরাসরি না বলে কবি থেমে যান। অথবা ইচ্ছাকৃতভাবে অসম্পূর্ণ রাখেন। এই নিঃশব্দতা, এই অসম্পূর্ণতা পাঠককে ভাবতে বাধ্য করে। তারপর কী হলো? অথবা, এই লাইনটির মানে কী হতে পারে? এটাই পাঠকের ভাবনার স্থান তৈরি করে।
(ঘ) বহুবিধ অর্থের সম্ভাবনাঃ
যত বেশি একটি কবিতার পঙ্ক্তি বহুমাত্রিক অর্থ ধারণ করতে সক্ষম, তত বেশি সে কবিতা পাঠকের ভাবনার জায়গা রাখে। একটি পঙ্ক্তি ভিন্ন পাঠকের কাছে ভিন্ন অর্থ বয়ে আনতে পারে। এবং সেটাই কবিতার সৌন্দর্য ও শক্তি।
(ঙ) পাঠকের সঙ্গে একধরনের সহযোগিতাঃ
কবিতা একতরফা বাণী নয়; এটি একধরনের যৌথ সৃষ্টি। কবি তার ভাষা ও অনুভূতি নিয়ে আসেন; আর পাঠক নিয়ে আসেন তার জীবনানুভব, চেতনা ও আবেগ। এই যৌথ প্রক্রিয়া ততই সফল হয়, যতই কবি পাঠকের ভাবনার জন্য খোলা জানালা রাখেন। পাঠকের ভাবনায় জায়গা রাখা কবিতাকে জীবন্ত করে তোলে। এতে করে কবিতা কেবল কবির নয়, পাঠকেরও হয়ে ওঠে। এ এক নিঃশব্দ সংলাপ; যেখানে কবি বলেন, আবার নীরবও থাকেন। আর পাঠক সেই নীরবতায় শুনে ফেলেন নিজের মনের কথা।
৭. পুনঃলিখন ও সম্পাদনাঃ
কবিতার প্রথম খসড়া নিখুঁত নাও হতে পারে। কবিতা বারবার পড়ে দেখতে হয়, শব্দ পাল্টাতে হয়, ছন্দ ঠিক করতে হয়; যতটা প্রয়োজন। কবিতা মানেই প্রথম খসড়ায় সম্পূর্ণতা নয়। অনেক সময় প্রথমবার লেখা কবিতা আবেগে ভরপুর হলেও, ভাষা, ছন্দ বা গঠনগত দিক থেকে দুর্বল থাকে। সেজন্যই পুনঃলিখন ও সম্পাদনা কবিতার নির্মাণ প্রক্রিয়ার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। খাঁটি অনুভবের সঙ্গে শৈল্পিক নিপুণতা মেলাতে হলে, কবিকে নিজের লেখা বারবার করে পড়তে হয়, ছাঁটতে হয়, বদলাতে হয়। আবার, কখনো নতুনভাবে নির্মাণ করতেও হয়।
(ক) কেনো পুনঃলিখন প্রয়োজন?
ভাষা পরিশীলনের জন্য কবিতার পুনঃলিখন প্রয়োজন হয়। প্রথম খসড়ায় শব্দচয়ন অনেক সময় কাঁচা থাকে। কবি পরবর্তী পাঠে খেয়াল করেন, কোন শব্দটি বেমানান বা অপ্রাসঙ্গিক? তখন, তা বদলে দেন। ছন্দ ও ধ্বনি ঠিক করার জন্যও পুনঃলিখন করতে হয়। অনেক সময় কবিতার ছন্দ ঠিকমতো বয়ে চলে না বা ধ্বনিগত সৌন্দর্য তৈরি হয় না। পুনঃলিখনে কবি শব্দের স্থানবিন্যাস, উচ্চারণের ভারসাম্য ইত্যকার বিষয়গুলো ঠিক করে নেন। ভাবের শুদ্ধির জন্যও এ কাজটি করতে হয়। কখনো অনুভূতি প্রকাশ অতিরিক্ত হয়ে যায় বা অপ্রয়োজনীয় বিবরণে ভরে ওঠে। তখন কবি অনাবশ্যক অংশ ছেঁটে ভাবকে কেন্দ্রীভূত করেন। দ্রুততা বনাম গভীরতার প্রয়োজনেও কবিতার পুনঃলিখন করতে হয়। তাড়াহুড়োয় লেখা কবিতা অনেক সময় গভীরতা হারায়। পরবর্তী পাঠে তা ফের খুঁজে এনে জোড়া লাগাতে হয়।
(খ) কেনো সম্পাদনা প্রয়োজন?
প্রযুক্তিগত সম্পাদনার প্রয়োজনে কবিতার সম্পাদনা করা দরকার। বানান, বিরামচিহ্ন, বাক্যগঠন ইত্যাদি যাচাই করে নেওয়া। শৈল্পিকতা, কাব্যিকতা, ভাষার সৌন্দর্য, ছন্দ, অলঙ্কার; এসবের সঙ্গতি রক্ষা করার জন্য সম্পাদনা প্রয়োজন।
অনেক সময় বিষয়গত মূল ভাবের সঙ্গে মিল রেখে অনুচিত বা বিভ্রান্তিকর উপাদান বাদ দেওয়ার নিমিত্ত সম্পাদনা করার প্রয়োজন পড়ে। কবির পক্ষে নিজের লেখা নিরপেক্ষভাবে দেখা কঠিন হলেও, পুনঃলিখন ও সম্পাদনা একটি কবিতার উন্নতির চাবিকাঠি। নিজেকে পাঠকের আসনে বসিয়ে কবিতা পাঠ করলে বোঝা যায়; কোথায় কবিতা কথা বলছে, আর কোথায় থেমে যাচ্ছে। দরকার হলে বিশ্বস্ত পাঠকের মতামত গ্রহণ করাও কার্যকর।
অনেক বিখ্যাত কবি যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত প্রমুখ কবিগণ বারবার কবিতা সম্পাদনা করেছেন। জীবনানন্দ দাশেরও বহু কবিতা মৃত্যুর পরেও সম্পাদিত ও পুনঃগঠিত অবস্থায় প্রকাশিত হয়েছে। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর 'নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ' কবিতাটি বেশ কয়েকবার সম্পাদনা করেছেন। তবে, পুনঃলিখন মানেই আত্মত্যাগ নয়। অনেকে ভাবেন, বারবার কাটাকাটি করলে কবিতার মৌলিক আবেগ নষ্ট হয়ে যায়। বাস্তবে, ভালো সম্পাদনা আবেগকে আরও উজ্জ্বল করে তোলে। খাঁটি হীরেও পালিশ করতে হয়। তেমনি খাঁটি অনুভবও নিখুঁত প্রকাশের অপেক্ষায় থাকে। একটি কবিতা যতবার পুনরায় গঠিত হয়, ততবারই সে নিজেকে ছাপিয়ে যেতে পারে। তাই কবিকে সাহস রাখতে হয় কাটাছেঁড়ার। সংশোধনের মাধ্যমে একটি কবিতা ধীরে ধীরে তার নিজস্ব পূর্ণতায় পৌঁছাবে নিশ্চয়ই।