আমি পরদেশী।
কোন বিখ্যাত চলচিত্রের রাজকীয় যুবা নই,
অতি সাধারণ একজন; পেশায় সুইপার-ডোম।
গহীন অন্ধকার থেকে উঠে আসা
সূর্যের মতোন এক উজ্জ্বল আলোর ইতিহাস
তোমাদের চোখের সামনে তুলে ধরার জন্যই
হয়তো, আজও বেঁচে আছি আমি।


বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি ঘৃণ্যতর রাত,
পঁচিশ মার্চ, ঊনিশ শ' একাত্তর;
যাকে বলা হয় কালরাত।
কালনাগিনীর বিষাক্ত ছোবলে নীল হয়ে যাওয়া
এক নদী অমাবস্যার অন্ধকার মাখা
এই ছিলো কালো রাত।
পাকিস্তানী দুর্বৃত্ত দস্যুরা যাকে বলেছিলো,
তথাকথিত 'অপারেশন সার্চলাইট'!
মানুষ হত্যাযজ্ঞের নির্মমতা।
পরিকল্পিত গণহত্যার পাশবিকতায় মত্ত হয়ে
সে-ই রাতে মেতেছিলো তারা,
সমস্ত শহর জুড়ে, গ্রামে-গঞ্জে, সমগ্র বাংলাদেশে।


আচানক ইতিহাসের এ গল্পের সূত্রপাত হয়েছিলো,
তার একদিন পর, সাতাশ মার্চ, একাত্তর।
ভারত, কিষান, লাডু আর আমি,
যারা পেশায় ছিলাম হাসপাতালের ডোম-সুইপার;
এবং আমাদের সাথে ছিলো আরো দু’জন মজুর।
মিটফোর্ট এলাকায় লাশ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে
আমরা সদলবলে ট্রাক নিয়ে যাই।
এ যেন ঝড়ের শেষে আম কুড়ানোর মতো
লাশ কুড়ানোর খেলা।
সশস্ত্র, নিষ্ঠুর পাকিস্তানী অসুরের দল
এখানে সেখানে ছড়ানো ছিটানো লাশ জড়ো করছে;
অগণিত লাশ।
এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
বুকে, পিঠে মেশিন গানের গুলিতে ঝাঁজরা
বাঙালির বীভৎস লাশ!
বানের পানার মতো বেশুমার লাশ।
আমি দেখলামঃ
মানুষের লাশ,
নারী ও পুরুষের লাশ,
যুবক-যুবতীর লাশ,
বৃদ্ধ-বৃদ্ধার লাশ,
বালক-বালিকার লাশ,
কিশোর-কিশোরীর লাশ,
অবুঝ শিশুর বিকৃত দেহের অগণন লাশ!
বুলেটে ঝাঁজরা বীভৎস লাশের অবিন্যস্ত জমিন
ভরে গেছে লাশের মিছিলে।
ষোড়শী-যুবতীর উলঙ্গ লাশ,
কোন কোন যুবতীর স্তন থেঁতলে গেছে,
কারো কারোর স্তন তুলে নেয়া হয়েছে পুরোটা,
যেনো বেয়োনেটের ধার পরীক্ষা করেছিলো তারা।
যুবতীর বক্ষ, যৌনাঙ্গ ক্ষত-বিক্ষত,
তাঁদের ঝাঁকড়া চুল অবিন্যস্ত,
এলোমেলো,  
অথচ, চিত্রা হরিণীর মতো মায়াময় চোখের চাহনি।
কোন কোন স্বাস্থ্যবান যুবকের চোখ বাঁধা লাশ,
পিছনের দিকে শক্ত করে হাত বাঁধা লাশ,
এসিডে, আগুনে ঝলসিত বিকৃত মুখের চেহারা,
মানুষের মাংসের, চর্বির পোড়া, পচা গন্ধ।
এতো বছরের সুইপার জীবনে আমি
এমনটি কখনো দেখিনি।
আমার পাকস্থলী, নাড়ি-ভুঁড়ি ওলট-পালট করে দিচ্ছিলো
বিকৃত লাশের ভয়াবহতায়।  


লাশকাটা ঘরে কতোবার ছুরির ফলায় ছিন্ন ভিন্ন করেছি ,
অপঘাতে মৃত কতো মানুষের লাশ!
কখনো আমার চোখ আর্দ্র হয়ে ওঠেনি,
বিষন্ন হয়নি এ হৃদয়;
অথচ, আজকে ভয়ঙ্কর কর্কশ গর্জনের মুখে এ সকল বস্ত্রহীন
ক্ষত বিক্ষত যুবক-যুবতীদের, বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের, কিশোর-কিশোরীদের,
রমণীয় রমণীর সুন্দর এবং পবিত্র দেহ
আমার প্রাণের ভেতরে দারুণভাবে জতুগৃহের উত্তাপ ছড়ায়;  
আমি কিছুতেই অশ্রু সংবরণ করতে পারিনি।


লাশগুলো ট্রাকে তুলে রাখি
আর বারবার আড়চোখে দেখিঃ
আমার পিছনে দাঁড়ানো পাঞ্জাবী সৈনিকের যুদ্ধংদেহী ভঙ্গীমা;
চাইনিজ রাইফেলের ট্রিগারে হাত রেখে
তার গোঁফের আড়ালে বাঁকানো ঠোঁটের ক্রুর হাসি।
কতিপয় বিহারী নৃত্যের ভঙ্গিমায় ছুটোছুটি করছে
এ ঘর থেকে ও-ঘরে লুন্ঠনের দস্যুতায়।
আমি ভুলে যাই আমার চেতনা,
আমি ভুলে যাই আমার অস্তিত্ব,
আমি ভুলে যাই আমি কি মানুষ ছিলাম?


সে সব লাশের পাহাড়ের নিচে রক্তের ঝর্ণা বহে,
সেই রক্তে স্নান করে
জেগে উঠিছিলো আমাদের স্বাধীনতার স্বর্ণালী সূর্য।
হায়, স্বাধীনতা!
হায়, প্রাণের  স্বাধীনতা!!
তোমার জন্য কতোই মূল্য দিলাম,
তবুও, তুমি প্রাণ খুলে হাসতে পারলে না আজো।
--------------------------------------------------------


( ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ, পাকিস্তান সামরিক জান্তা কর্তৃক ‘‘ অপারেশন সার্চ লাইট’’ নামক জঘন্য হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত করার পর ২৭ মার্চ , শনিবার ঢাকা পৌরসভার তৎকালীন চেয়ারম্যান মেজর সালামত আলি খান শূর-এর প্রশাসনিক কর্মকর্তা  ইদ্রিস-এর নেতৃত্বে তিনটি গ্রুপে ভাগ করে লাশ সংগ্রহ করা হয়। অতঃপর, সে সকল লাশ  ধলপুর ময়লা ডিপোতে ফেলা হয়। পরদেশী  তেমন একটি গ্রুপের সাথে কর্মরত ছিল। তাঁর স্মুতিময় বক্তব্যকে কাব্যিক সুরে তুলে ধরা হলো।)