আমি শ্রাবন্তী, দুঃখ-ঘসা জীবনের সৃষ্টি, এই সমাজের;
আমার ঘুম ভাঙ্গে প্রতিদিন নিয়ম মাফিক, আজানের সুরে;
বিছানা ছেড়ে ধড়ফড় করে উঠি আলস্যহীন, প্রতিদিন;
পাশের চৌকিতে শুয়ে আছেন আমার মা-জন্মদায়িনী মা।
ক্ষয় কাশের সাথে সারা রাত যুদ্ধ করতে করতে নিস্তেজ হয়ে-
এখন ঘুমিয়ে আছেন অবোধ শিশুর মতোন।
কোটরাগত চোখ তার মায়াবতীর মতোন মনে হয়।  
বিছানা-পত্তর  গুছিয়ে স্টোভ জ্বালাই ঘরের কোণে-
চালের সাথে আলু সিদ্ধ করবো এ ইচ্ছা নিয়ে।
সিদ্ধ করি- জীবনের সব সুখ, ভালোবাসা, প্রেম,
আশা-আকাঙ্খা, যৌবন-জ্বালা, শ্যামল ক্ষেতের ফসল।


থালার কোনায় দুর্মূল্যের আমরিচ কিছু আলু-ভর্তা,
চারটি ভাত ঢেকে রাখি সযতনে, মায়ের জন্য।
বাটিতে খানিকটা তুলি- দুপুরে জঠরকে জাবিন দেবো;
বাকিটা ঝেড়ে পুছে খেয়ে দীর্ঘনিশ্বাসের সাথে
ঘর থেকে বের হই, ছুটি ঊর্ধ্বশ্বাসে বড়ো রাস্তার মোড়ে।
অগণন কঙ্কালসার মানুষের মিছিলের আয়োজন-
কিশোর-কিশোরীর, যুবক-যুবতী, পৌঢ়াদের-
আমিও মিছিলে মিলে যাই, হাঁটতে থাকি শ্লোগানহীন-
অজস্র শোকাবহ ক্ষুধাতুরদের মৌন মিছিল।


বস্ত্র বালিকা আমি! নিদারুণ তৃতীয় বিশ্বের এক সমাজের,
নিত্যদিন শুরু হয় এক ঘেয়েমীর বৈচিত্রহীনতায়,
কাজ শেষে যখন বের হই সূর্য ডোবার পরে-
চর্বিওয়ালা মালিকের গার্মেন্টস-এর জেলখানা থেকে;
চতুর পুলিশের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে দারোয়ান,
কখনো 'চেকিং'-এর নামে শরীরের নাজুক স্থানগুলো ছুঁয়ে দেয়;
বিব্রতকর, তবুও যায় না বলা মুখের উপর সত্য কথা।
তার সনদের উপর আমার দাসত্বের চাকুরী ঝুলে আছে।
অনিচ্ছার হাসিতে সুড়সুড়ি লাগার ভান করি;
এটাকে মৌন সম্মতির আস্কারা পেয়ে আরো গভীরে যেতে চায়।
এমন বলে না কেউ করুণ কথার ছলে-
তোমাকে ছুঁয়ে দিলেম , তার বিনিময় মূল্য-
একটি গোলাপের কলি গুঁজে দিলেম খোপায়;
এসো, একটু আদরে চুম্বন করি- অর্থবহ ভালোবাসায়,
অথবা, এসো ছুটির দিন কিছুটা গল্প হবে-
সুখ-আনন্দ-ভালোবাসার দুঃখ পোড়ানোর ছলে।
সবাই মুফতে পেতে চায় রসালো শরীরের ছোঁয়া।


অসুস্থ্ মা আমার সুস্থ্ এখন, মন তার ফুরফুরে;
ভুলে গেছেন তিনি, অতীতের সব জ্বালা, কষ্টের উত্তাপ,
ভুলে আছেন সে-ই প্রলংকরী দিবসের কথা-
যেদিন আমার জন্ম হলো আলোময় সুন্দর প্রভাতে,
তাঁর দু'বছরের পরিচিত স্বামী- আমার জন্মদাতা বাবা-
দরোজার বাহির থেকেই শুনলো আমার আগমনের কথাঃ
'একটি মেয়ের জন্ম হয়েছে তোমার- অনিন্দ্য সুন্দরী!
বয়সকালে যে, যে-কোন পুরুষকে ভেড়া বানাতে পারবে,
রূপ তার চুঁয়ে পড়ে- চোখে মুখে সারা গায়।'
বলেছিলো আমার পাশের বাড়ির ঠাকুর মা।
আমার জন্মদাতা আর ঘরে ঢুঁকে নি;
মেয়ে হওয়ার কলঙ্ক মাথায় নিয়ে বাড়ি ছেড়ে যায়।
অনেক দূরে- হয়তো কোনো পাহাড়ের দেশে,
হয়তো অন্য কোথাও, বে-শরমের পুরুষ-চিত্ত নিয়ে
অন্য কোন নারীর অঙ্কে লুটোপুটি খায়।


ফুরফুরে মা আমার জীবনের সকল দুঃখকে
কঠিন সত্যের আগুনে পোড়ায়ে বললো আমায়ঃ
'ঢাকে কাঠির শব্দ শুনছি-
আমি মায়ের দর্শনে যাবো, নিয়ে চল, মা।'
এই সে-ই মা! জীবনের সব রং ছুড়ে দিয়ে-
কামনা, বাসনার উপর ছাই চাপা রেখে-
দীর্ঘ সময় পথ হেঁটেছে আমাকে বুকে ধরে।


দেবী দর্শনে যাচ্ছি মাকে নিয়ে-
দশভূজা- অস্ত্র-সজ্জিতা, অসুরের বুকে বর্শাফলক,
পেঁচকের পৃষ্ঠে লক্ষ্মী, হংসীর 'পরে ভর করে সরস্বতী,
ময়ূর আসনে কার্তিকেয়, জনগণ দেবতা গণেশ বেষ্টিত,
কাত্যায়নীর অপরূপ রূপ ঝলকিয়ে উঠে মণ্ডপে।
বিদ্যুৎ ঝলকের মতো কাউকে যেনো হঠাৎ দেখেন মা;
অনেকদিনের ম্রিয়মাণ কণ্ঠ থেকে বজ্রনিনাদের শব্দ উঠে,
লাফিয়ে উঠে মন্ডপে, হাতের তুলে নেয় প্রতিমা-দুর্গার বর্শা;
আলো ঝলমল জনারণ্যের ভেতর
একটি ছায়া পুরুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আক্রোশে-
কন্ঠে তার উচ্চারিত হচ্ছে- 'আমি দুর্গা হবো।'
আকাশে-বাতাসে, জলে-স্থলে, বৃক্ষের পত্রে পত্রে,
আলোক-সজ্জিত মণ্ডপের আলোর কণায় কণায়,
প্রতিধ্বনিত হচ্ছে জলমন্দ্রের মতো সে-ই দৃপ্ত বাণী-
'আমি দুর্গা হবো, আমি দুর্গা হবো, আমি দুর্গা হবো ...


(বিঃদ্রঃ- কাত্যায়ণীর আগমনের আনন্দের 'শারদীয় পুজায়' আমি থাকতে পারছি না তোমাদের সাথে; তাই, আগেই পোষ্টটি রেখে গেলাম।)