[একজন বীরাঙ্গনা- একজন মুক্তিযোদ্ধা।]


আমি তখন সদ্যপ্রস্ফুটিত যুবতী ছিলাম
সবেমাত্র কলেজের চৌকাঠ পার হয়েছি
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল জমিনে পা দিয়েছি  
সেই উত্তাল সময়ে মিছিলে মিটিঙে, আন্দোলনে
আমার অবারিত যাতায়ত ছিলো
আমার ভাই তখনকার সময়ের তুখোর ছাত্র নেতা
‘ইকবাল হলে’র ছাত্র ছিলেন তিনি
পঁচিশে মার্চ একাত্তর
মদমত্ত রক্তখেকো পাকিস্তানি হায়েনারা
ঝাঁপিয়ে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ আর ইকবাল হলে
আমাদের স্বপ্নের চাঁদ গিলে খেতে চায় তারা
পত্রপল্লবে সজ্জিত এ দেশকে শ্মশান বানাতে চায় তারা
আমার সাহসী ভাই সূর্যের আলোর অন্বেষনে
ঘর ছেড়ে বের হয়ে যায় মায়ের আশিষবাণী নিয়ে।


এর কয়েকদিন পর-
মানুষের চেহারার কিছু জানোয়ার আমাদের বাড়ি আসে
তারা ভাইয়ের খোঁজ করে, সারা ঘর তল্লাসী চালায়
জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি আমরা
অবোধ মগজ কিংকর্তব্যবিমূঢ়
দেখতে পাচ্ছি না আমি আমার পায়ের কাছে কি পড়ে আছে
আমার নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে
তবুও, আত্মাকে দেহের ভেতরে সজোরে রেখেছি ধরে
দাঁড়িয়ে ছিলাম দরজার পাল্লার ওপারে
আমার স্কুল শিক্ষক বাবা
বাস্তব জ্ঞানের অহমিকা নিয়ে কথা বলে তাদের সঙ্গে
গণতন্ত্রের কথা
ন্যায়-অন্যায়ের কথা
মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসার কথা।


সেইসব নরখাদক পশুদের সাথে কয়েকটা শেয়ালও এসেছিলো
আমাদের মতো চেহারা তাদের
দেশীয় শেয়াল, কুকুরের ঘরে জন্ম হযেছে যাদের
তারা ইতিউতি করে দরজার পেছনে তাকায়, চোখ ফেলে
ভয়ে থরথর করে কেঁপে উঠে আমার শরীর
জলে পরিপূর্ণ পেয়ালা থেকে ছলাৎ ছলাৎ করে
ছিটকে পড়ছে কলসি কলসি থুতু ঘৃণাবোধের আক্রোশে
স্থবির স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে আছি আমি আর বাবা
আমার মা পাকের ঘরে
বাঙালির চিরাগত আতিথিয়তার অভ্যাসে নাস্তা তৈরিতে ব্যস্ত
কয়েক মুহূর্ত কেটে গেলো, কি জানি কি ভেবে  
অজস্র কুৎসিত ভাষায় চিৎকার শুরু করে তাদের দলনেতা
হায়েনারা হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে বাবার উপরে
ছিন্ন-ভিন্ন করে দেয় তাঁর সমস্ত শরীর
ঝা ঝা করে অজস্র গুলি চালায় বাবার বুকে, পেটে, মাথায়
ঝাঝরা করে ফেলে সুখমুখরিত একটি সুন্দর মুখ
পশুদের আপ্যায়ণের উদ্দেশ্যে পাকের ঘরে  মা ছিলেন
ত্রস্তপদে ছুটে আসেন তিনি
তীব্র ঝড়ে আক্রান্ত, ভীত সন্ত্রস্ত এক নারী
আহা! সৌন্দর্যমণ্ডিত সুশ্রী চেহারাখানি কৃষ্ণবর্ণ হয়ে গেলো সহসা
বাবাকে বাঁচানোর কোন ফুসরতই পেলেন না
লুটিয়ে পড়েন বাবার পায়ের কাছে
বড়ো লক্ষ্মী ছিলেন আমার জন্মদাত্রী মা
আমার ইন্দ্রিয়গুলো ভোঁতা হয়ে গেলো
প্রচণ্ড ইচ্ছা হচ্ছিলো সক্রেটিসের সেই বিখ্যাত হেমলক পান করার
আমার দৃষ্টির সীমানায় ঘটে গেলো
পৃথিবী পরিবর্তনের রক্তরাঙা অতিশয় ধ্বংসাত্মক ঘটনা
চেতনহীন আমি অচিন দেশের যুবতী যেন
দুহাতে মুখ ঢেকে ধপ করে পড়ে যাই কপাটের পিছে।


আমার যখন হুঁস হলো
তখন নিজেকে আবিস্কার করি
দরজাবন্ধ জানালাহীন একটি ছো্ট্ট খুপরিঘরে
আমি যেন অয়োময় খাঁচায় বন্দী বিধ্বস্ত এক পাখি
আমার হৃদয় ব্যথা করছে
আর নিদ্রাতুর বিবশতা পীড়ন করে যায়
প্রচন্ড ব্যথায় কুঁকড়ে যাচ্ছে সমস্ত শরীর
নারীত্বের অহংকারের পবিত্র স্থানে
হাবিয়ার আগুনের তীব্র শিখা দাউ দাউ করে জ্বলছে
মেঝেতে রক্তের ধারা-
অজস্র অশোক-শিমুল ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে
গবাক্ষের ফাঁক গলে আসা আলোর রেখা ছাড়া
আর কিছুই দেখতে পারছি না
এই অরণ্যের পরী অসহ্য বেদনা নিয়ে  
অন্ধকার জতুগৃহে কতো লক্ষ বছর বন্দি ছিলেম
আমি কিছুই মনে করতে পারছি না।


আমি একদিন বুঝতে পারলাম  
সবকিছু সুনসান- নেকড়ে, হায়েনা, কুকুর, শেয়ালের
কোন আনাগোনা নেই
কুৎসিত স্বরের কোন চিৎকার নেই
কাঁদার ভেতরে শুয়োরের ঘোঁৎঘোঁৎ নেই
শুঁকতে শুঁকতে আসে না কোন পাষণ্ড পশু
কোন শুয়োরের বাচ্চা
এই খুপরিঘরে
আমার দেহের কাছে
প্রচন্ড ঘৃণার নাগালের মাঝে।


দূরে কোথাও থেকে ভেসে আসছে সমুদ্রের গর্জনের মতো
জলোদ্ভাবিত হিরন্ময় শ্লোগান- ‘জয় বাংলা’ ...।
আমার রক্তে ঝড় ওঠে, বৃষ্টিতে ভেজার উল্লাস নিয়ে
কন্ঠ মেলাতে চাই সেই অমিয় সুরের সাথে
অথচ, অক্ষম আমি
নিস্তেজ শরীরে এলিয়ে পড়ি নিষ্প্রভতায়
অনুভবে ধরা পড়ে
আমার ভেতরে আরেকটা ‘আমি’ নড়েচড়ে ওঠে।


বাধভাঙ্গা জোয়ার জলের মতো অন্ধকার ভেদ করে সমস্ত ঘরে
ছড়িয়ে পড়ে সূর্যালোকের তীব্র আলোর লহরী
উজ্জ্বল আলোর আঘাতে চোখে জ্বালা ধরে যায়
শরীরের সমস্ত শক্তি নিংড়ে উঠে দাঁড়াই
সূর্যের আলোর দিকে ছুটে যাওয়ার প্রচন্ড শক্তি নিয়ে
কিন্তু স্থির থাকতে পারি না
লুটিয়ে পড়ি পক্ষাঘাতগ্রস্ত আমি কর্তিত বৃক্ষের মতো।


আমার সম্মুখে একজন সুপুরুষ
শশ্রুমন্ডিত, রাইফেল কাঁধে দাঁড়িয়ে আছে
এ যেন আমার সে-ই ভাই
যে সূর্য়ের আলোর অন্বেষণে ঘর ছেড়ে চলে গেছে
যে আমাকে আদর করতো পুতুলের মতো
সবচেয়ে উঁচু ডালের পাকা আমটি পেড়ে দিতো
কাঁটার আচড় খেয়েও পেড়ে আনতো বেতুনের ফল
বৈশাখী মেলায় নিয়ে যেতো হাত ধরাধরি করে
কিনে দিতো চুলের রঙিন ফিতা  
বেলোয়ারি চুড়ি,
মাটির পুতুল
সোলার পাখি
আলতার বড়ি।
আমি বিবশিত হয়ে গেলাম
নিংড়ে তোলা শরীরখানি হারিয়ে গেলো আরেক অন্ধকারে।


আমি শুয়ে আছি- প্রেমময় ভাইয়ের কোলে
তাঁর মমতার হাত আমার জট-পাকানো চুলে বিলি কাটছে
দু’চোখে তাঁর অশ্রুর নদী
বরফ গলা জলের ধারা
অনিমেষ চোখে বিহ্বল তাকিয়ে রই
আমার সূর্যসন্তান ভাইয়ের দিকে
আমি চেয়ে থাকি আরেকটি প্রভাত-সূর্যের দিকে।