দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে
উপস্থিত হয়েছিলে তুমি, রেসকোর্স ময়দানে,
উত্তাল তরঙ্গায়িত জনসমুদ্রের তীরে।
অগণিত মানুষের কষ্টের আক্ষেপ নিয়ে
দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে, তুমি উচ্চারণ করে গেলে-
'বাঙালি মরতে শিখেছে, কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না'।
পরনে সফেদ পায়জামা-পাঞ্জাবী, পরিচিত মুজিবকোট,
আঙুলের ফাঁকে রাখা এ্যারিনমোর চুরুটের পাইপ।
অসীম সাহস বুকে, অচঞ্চল ঋজুদেহে
ধীরে ধীরে উঠে এলে, অনাড়ম্ভর মঞ্চের পাতাটনে।
বাঙালির দীর্ঘ করুণ ইতিহাসের অলিগলি ঘুরে,
ফিরে এলে আবার, তোমার প্রিয় বাঙালির কাছে।
'বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়,
বাংলার মানুষ মুক্তি চায়,
বাংলার মানুষ অধিকার চায়...'
চিরন্তন এ সত্যকে বাঙালির মনে
খোদাই করে যে দিলে,
অমিত তেজের দীপ্ত বাটালির নিপুণ কারুকাজে।


তুমি মঞ্চের মাইকে বজ্রনিনাদ স্বরে,
উজ্জীবিত কণ্ঠে, যখন অমর কবিতাখানি আবৃত্তি করছিলে-
পৃথিবীর নিপীড়িত মানুষের মুক্তির দর্শন,
স্বাধীনতার ফরমান।
ওই সময় ইতিহাসের খলনায়ক-
টিক্কা খান, রাও ফরমান আলী,
কুটিল যড়যন্ত্রের ঝুলি নিয়ে
পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ছুটে আসে,
আমার সোনার বাংলাদেশে;
'অপারেশন সার্চলাইট' নামে পরিকল্পিত গণহত্যার।
রাজনৈতিক আলোচনার অন্তরালে
নিরস্ত্র বাঙালি নিধনের যড়যন্ত্রের জাল বুনতে থাকে তারা।
দূরদর্শী কবি!
পাকিস্তানিদের রাজনৈতিক ইতিহাসের অলিগলি
তুমিইতো জানতে উত্তমরূপে;
বুঝেছিলে সেই সব জালিমের কুটিলতা।
বাঙালির প্রাণের কথাও বুঝেছিলে বুঝি?
তাই, অগ্নিদৃপ্ত ভাষণের শব্দের তরঙ্গে
জনসমুদ্রে ভাসিয়ে দিয়েছিলে প্রজ্ঞার ভবিষ্যৎ বাণী-
'শত্রুর মোকাবেলায় ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল'।


পদ্মা-মেঘনা-যমুনার বাংলাদেশ,
আড়মোড়া ভেঙে দাঁড়ায় ঋজু দেহে।
মুক্তিকামী জনতার বাঁচামরার লড়াই-
নয় মাসের তুমুল যুদ্ধ।
অতঃপর, স্বাধীনতা,
প্রিয় স্বাধীনতা!
রক্তেভেজা স্বাধীনতার বীজানু রোপণ হয়েছিলো
একাত্তরের মার্চের সাত তারিখেই।


বাঙালির উদ্দেশ্যে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলো-
''সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী,
রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি''।
হে যোগী রবীন্দ্রনাথ!
তোমার আক্ষেপও অপূর্ণ রাখেনি এ বাঙালি।
কী অদ্ভুত সম্মোহনী শক্তির প্রভাবে,
ঘাত-প্রতিঘাত সয়ে, বাঙালি মানুষ হয়ে ওঠে;
অস্ত্র হাতে ছুটে যায় যুদ্ধের ময়দানে,
দেশ মাতৃকার প্রয়োজনে, প্রেমে, ভালোবাসায়।
মুজিব, তুমি সে-ই হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা,
মন্ত্রমুগ্ধ অমিয় সুরের বাঁশি বাজাতে বাজাতে
আর্য, অনার্য, দ্রাবিড়, মঙ্গোলীয় ঐক্যবদ্ধ করেছিলে
অমিয় সুধাধারায়।
ফিদেল কাস্ত্রোর হিমালয়, হে রাজনৈতিক কবি!  
তুমিই যে আমাদের ভাই, বন্ধু, এবং জনক।


আব্রাহাম লিঙ্কনের ভাষণ,
গেটিসবার্গ এড্রেস, দার্শনিক সার্বজনীনতায়
মার্কিনীদের ছাড়িয়ে গেলো গণতন্ত্রী মানুষের কাছে।
সাতই মার্চের ভাষণ,
অহিংস আন্দোলনের ভিত্তি থেকে অস্ত্রিক যুদ্ধের দর্শন।
দুনিয়ার সকল অত্যাচারিত, নির্যাতিত, নিপীড়িত
মানুষের বিস্ময়কর মুক্তির ডাক।
তোমার ভাষণের ভাষা
কোন রাজসভার পণ্ডিতের নয়, এ যে গণভাষা,
এই ভাষা বাঙালির ভাষা;
তবুও, ব্যঘ্রগর্জনের এ ভাষণ এখন আর বাঙালির নয়;
বিশ্ব ঐতিহ্যের চমকপ্রদ ধারক- বিশ্বের সম্পদ।
হে বিশ্ববিজয়ী নেতা, জনতার কবি!
অমর কবিতাখানি যে ভাষায় হয়েছে রচিত,
সে ভাষায় রবীন্দ্রনাথ নোবেলজয়ী ।


০৭/০৩/২০২০
মিরপুর, ঢাকা।