ধীরে ধীরে নেমে আসে শীতের আমেজ
আমাদের গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-বন্দরে,
নিভৃতের নিরালার এই পাড়াগাঁয়ে।
অথচ, আগের মতো শীতকাল আসে না;
যে সকল শীতকাল ছিলো, স্বপ্নের সুঁতোয় আঁকা
নকসী কাঁথার মতো আদুরে রঙিন।


শিশিরে ভেজানো কালো গ্রাম কুয়াশায় ঢাকা,
নদীর জলের বুক থেকে ধুয়ার কুণ্ডুলি
পাখা মেলে উড়ে যেতো প্রভাতের ইশারায়
মাঠ ভরা শর্ষে ক্ষেতে, হলুদের ভিড়ে।
রোদের পরশ পেয়ে চিকচিক করে,
মোহনীয় আশ্চার্য উল্লাসে।
পুকুর পাড়ের আমগাছে পাখিদের কিচিমিচি,
আনন্দের চিৎকার।
যে সব শব্দের তোড়ে কানে তালা ধরে,
চেনা-অচেনা হাজার পাখিদের গান।
দূর পথে হেঁটে আসে জুবুথুবু গাছি,  
ভারের ভারেতে ন্যুব্জ দেহখানি তার।
খেজুর রসের হাড়ি দু'ভারে ঝুলিয়ে,
ঘন কুয়াশার মসৃণ মশারি ছিঁড়ে,
স্বপ্নপুরুষের মতো হেঁটে আসে ভিন গাঁও হতে।
পিতলের গ্লাসে মেপে দিতেন খেজুরের রস,
প্রতি গ্লাস মাপ ঠিক, আধা সের ধরে।
সে সব শীতল খেজুরের রসে যাদু মাখা যেন,
এক গ্লাস খেলে পরে শীত যায় বেড়ে,
কাটা দিয়ে শীত আসে শরীরের মাঝে;
দুই গ্লাস খেলে তবে শীতেরা পালায়।
এ অদ্ভুত রহস্য ভেদের সমাধান হলো না আজও,
এ বিজ্ঞান জানা নেই কারো।


কচি ভোরে যে রাখাল মাঠে যায় ছুটে,
গরু আর বাছুরটিকে কলুই ক্ষেতে বেঁধে দিতে;
ফিরে আসে সে,
দু'পাও তার কাদায় আচ্ছাদিত,
জুতোর মতোন লেপটে থাকে সমস্ত পা জুড়ে;
অতঃপর, নেচে নেচে ঝেড়ে ফেলে ঘরে ফেরে সে।
আমরা যারা দু'কলম অ আ ক খ
অথবা এ বি সি ডি এবং আলিফ বা তা ছা পড়তাম;
তারাও দলবেঁধে যেতাম মটরশুঁটির ক্ষেতে;
মৌমাছিদের পিছনে পিছনে হলুদের দেশে,
হাত দিয়ে ছুঁয়ে দিতাম শর্ষের হলুদরেণু।
শিশিরভেজা খিরাই ক্ষেতের আ'ল ধরে
হেঁটে যেতাম মজাদার দুধখিরাই খাওয়ার লোভে।
যে সকল কিশোরীরা দিনের বেলায়,
এ সকল ফসলের ক্ষেতে পাহারা দেয়;,
তারা, তখন থাকে না ডেরায়।
ক্ষেত থেকে তুলে আনা শিশিরধোয়া ধনেপাতা,
নুন আর মরিচ গুঁড়োয় বরই খাওয়ার, আহা কী স্বাদ!


গনগনে আগুনের চুলার পাড়েতে বসে
খেজুর রসের গুড়ে চিতুই পিঠার আস্বাদন,
অথবা ছিটপিঠা আর মুরগীর পাতলা ঝোলের ঝাল;
আহা, এখনো জিভে লেগে আছে!
পেট পুরে খাওয়ার পরেও; 'আরেকটা খা'
মায়ের সে-ই আদর মাখানো কাকুতির আবদার,
আর পাবো না কখনোও।


বাড়ির পাশের ডোবা-গড়ে দল বেধে মাছ ধরা,
কাদা মেখে সারা গায়ে ভূতের চেহারা নিয়ে
মাটির পাতিলে মাছ ভরে বাড়ি ফেরা।
মায়ের কঠিন রাগ, শাসনের সুর;
যেন, পৃথিবীতে মাছ ধরা বড়ো অপরাধ।
গরম পানিতে ডলে ডলে ধুতে ধুতে
আদরের শাসন চলতো অনেকক্ষণ ধরে।


শীতকালে মুড়ি ভাজা উৎসব ছিলো যেন,
সিদ্ধহস্তা মুড়ি-কারিগর
গরম বালিতে চাল ছড়িয়ে
কি এক অপূর্ব কৌশলে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে,
অন্ধকার কালচে বালির উষ্ণতা থেকে
স্বপ্নের মতো সুন্দর, সাদা সাদা মুড়ি বের করে নিতো।


কুমিল্লার কাঠের খড়ম পায়ে ঠক ঠক আওয়াজে
উঠোন পার হয়ে যেতেন আমাদের দাদীমা,
এ ঘর থেকে ও ঘরে;
ফোঁকলা দাঁতে মুড়ি চিবুতে পারতেন না তিনি;
তাই, পাটাতে পুতায় ছাতু করে দিতে হতো।
সেই সকল শীতের মোলায়েম কাল,
আরতো আসবে না ফিরে আমাদের এ মাটির পৃথিবীতে।


১০/০১/২০২১
মিরপুর, ঢাকা।