(আমার সমবয়সী চাচাতো ভাই মোঃ শরীফ উল্লাহ, যিনি ইহলোক ত্যাগ করেছেন ২২ জানুয়ারী, ২০২০; তার জানাজায় গিয়ে স্মৃতিগুলো মনের গহীনে আছড়ে পড়লো। ধরে রাখলাম স্মৃতি-পাণ্ডুলিপি করে।)
--------------------------------------------------------------


মাস ছয়েকের বড়ো, ছেলে বেলাকার ভালো বন্ধু,
আমার চাচাতো ভাই, শরিফ উল্লাহ, নিস্পন্দিত আজ।
চোখ দুটি খোলা তাঁর, চেয়ে আছে আকাশের দিকে,
অবিকৃত মুখখানি একটু হা করা,
মনে হলো, আরো কিছু কথা বলতে  চান।
পৃথিবীর তাবৎ দুঃখকে মনের ভেতরে ধরে রেখেছে সে,
তাঁর বুকের ভেতরে,
অব্যক্ত কথার ফল্গুধারা সমুদ্রের মতো।
একখানা মানুষজীবন কর্মহীন, উপার্জনহীন,
কী আশ্চর্যরকমভাবে পার করে গেছেন অবলীলায়!
পরিবার পরিজন করেছে গঞ্জনা, অবহেলা,
সমাজের মানুষেরা কূটিল ভ্রুকুটি হেনেছে বারবার।
তবুও. সে আহত হয়নি কখনোই কোনকালে,
নির্বিকার হয়ে থাকতো নিরন্তর, অবিকার।
সকলের সে সব কথার সবগুলো খাঁটি অভিযোগ,
উড়িয়ে দিয়েছে হেসে,
খণ্ডণ করতে চেয়েছে অতিকথনের ভুলভাল যুক্তি দিয়ে।
সাদাসিদা একজন নিপাট ভদ্রলোক,
সাতেপাঁচে ছিলো না কারোর,
এমনিভাবেই চলে গেছে, অবহেলা, অপমান সয়ে
মানুষ জীবনের ষাটটি বছর।
জটিল ও কুটিল জীবনকে কখনো দেয়নি প্রশ্রয়,
কানকথার কানাকানি ছিলো না তার কাছে।
আকাঙ্খা, চাহিদা, মোহ, লোভ
এইসব বিষয়গুলোতে তার কি ছিলো কোন ক্ষোভ?
তাই, হয়তোবা বড়ো কম ছিল এইসব তার;
অল্পতেই তুষ্ট হতো অদ্ভুতভাবে আজীবন কাল।


কতো স্মৃতি মনে জাগে, কতোশত কথা!
মেঘনা নদীর কালোজলে 'লাইভুরানী' খেলা
যতোক্ষণ লাল হতো না চোখ, সে-ই অবধি।
গোসলের আগে নদীর মিহিন বালিয়াড়িতে
দীর্ঘক্ষণ 'ভাইলাভাইলি' নামে কুস্তি কুস্তি খেলা।
আর, সেই সব কুস্তির কৌশল নিয়ে নিগূঢ় আলাপ-
বেতমোড়, কেওরা, আরো কতো কি!
রঙিন ঘুড়ির ডোরি হাতে ছুটে চলা ধানি-মাঠে ,
চৈত্রচন্দ্রময় রাতে গোল্লাছুট, বৌ-ছি, চোরপলানি এসব খেলা।
গলা ছেড়ে গান গাওয়া
নজরুলগীতি, রবীন্দ্রসঙ্গীত, ভাটিয়ালি, ফকিরি-মার্ফতি,
পাগল বাচ্চুর সে-ই গান- 'তবু, কেনো মনে তারে চায়...'
একসাথে পাঠশালায় যাওয়া-আসা,
টেকপাড়ার ছাড়া-বাড়ি, কষালো বেতেরফল,
জনশূন্য খোলামাঠে তুলা গাছের আগায়
দু'পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে থাকা অদেখা সে স্কন্ধকাটা ভুত!
কাছারির বটগাছ, জ্বীনেরা লেংড়াঘোড়ার রূপ ধরে
ঈদগাহের চারপাশে ছুটে চলে সারারাত,
ধবধবে পাঞ্জাবি পরা রজ্জব আলী কারিসা'ব
মন্ত্রবলে জ্বীনগুলোকে বস করে রাখতেন;
ইত্যকার কতোশত কথা মনে পড়ে আজ।


কতো তুচ্ছ ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে ঝগড়াঝাটিও হতো-
মার্বেল খেলার দান, বৌ-ছির ছোঁয়ছুয়ি নিয়ে;
নৈয়ামারি খেলায় কয়েকটি শীমের দানা,
কিংবা, সিগারেটের খালি খোল ইত্যাদি এইসব।


আজ শুয়ে আছে নিষ্পলক, স্টীলের সুদৃশ্য খাটিয়ার মাঝে;
পরিজন, আত্মীয় বেষ্টিত সাড়ে তিন হাত গোরের নিকটে।
হায়! জীবনের ধারা- ত্যাগ করে সবকিছু,
সবকিছু ধুয়েটুয়ে, সবকিছু অবহেলে-
অর্থ, সম্পদ, সন্তান চলে যেতে হলো
কাঁচা বাঁশের চাঙের গোরের অতলে, অন্ধকার অন্যলোকে।
যতক্ষণ দেহের ভেতরে প্রাণ আছে সাবলীল, চমৎকার!
এ কথা ভাবে না কেউ রাতের নিশিতে একা একা আর।


২২/০১/২০২০
মিরপুর, ঢাকা।