মাতৃভাষা সাথে একটি জাতির জাতিসত্তা অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। আত্মমর্যাদা সম্পন্ন জাতির কাছে মাতৃভাষা এক মূল্যবান সম্পদ তা আমাদের সকলেরই জানা। ওই অমোঘ সত্য উপলব্ধি করে ষোল শতকের কবি সৈয়দ সুলতান (জন্ম চক্রশালা-পটিয়া) তাঁর ‘ওফাতে রসুল’ গ্রন্থে লিখেন,
‘ বঙ্গদেশী সকলের কিরূপে বুঝাইবে
বাখানি আরব ভাষা এ বুঝাইতে নারিব
যারে যেই ভাষে প্রভূ করিল সৃজন
সেই ভাষে হয় তার অমূল্য ধন।’’
যারে যেই ভাষে প্রভূ করিল সৃজন
সেই ভাষে হয় তার অমূল্য ধন।’’
সন্দ্বীপ নিবাসী কবি আবদুল হাকিম তাঁর গ্রন্থে লিখেন,
যে সব বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী
সে সবা কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি
দেশী ভাষা বিদ্যা যার মন ন যুরায়
নিজ দেশ তেয়াগি কেন বিদেশে ন যায়।
মাতা পিতামহক্রমে বঙ্গেতে বসতি
দেশী ভাষা উপদেশ মনে হিত অতি
রামু নিবাসী মধ্যযুগের কবি নসরুল্লাহ খোন্দকার তাঁর ‘মুসার সওয়াল’ গ্রন্থে লিখেন,
বুঝিবারে বাঙ্গালা সে কি ভাবের বাণী
আপনে বুঝন্ত যদি বাঙ্গালের গণ।
ইচ্ছা সুখে কেহ পাপে না দেয়ন্ত মন
অর্থাৎ ধর্ম কথা বাঙ্গালায় বুঝিলে কেহ স্বেচ্ছায় পাপে মন দিবেনা।
কায়েমীস্বার্থবাদী মহল ও ভাষা সংস্কৃতিতে আক্রমণকারী প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ভাষা আন্দোলনের মূল আঘাতটি ১৯৫২ সালে হলেও এ আন্দোলনে এক দিনে হয়ে উঠেনি। বাঙালির দীর্ঘদিনের আন্দোলন-সংগ্রামের ফসল এ আন্দোলন। ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে বাংলা ভাষার পক্ষে কলম সৈনিকরা কলম ধরেছেন। প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক বাংলা ভাষা পক্ষে প্রথম উচ্চারণ হয় রাজশাহী। রাজশাহী থেকে প্রকাশিত ‘নুর-আল-ইমান’ পত্রিকার ভাদ্র ১৩০৭ সংখ্যায় ওই পত্রিকার সম্পাদক মির্জা মোহাম্মদ ইউসুফ আলী ঊর্দু বাঙালি অনুগতদের ‘খেদমৎগার’ হিসেবে উল্লেখ করে লিখেন:
‘‘ শরীফ সন্তানেরা এবং তাহাদের খিদমাৎগারগণ ঊর্দু বলেন, বাংলা ভাষা ঘৃণা করেন, কিন্তু সেই ঊর্দু জবানে মনের ভাব প্রকাশ করা তো দূরে থাকুক, পশ্চিমা লোকেরা লিখিত শব্দগুলিও অনেকে যথাস্থানে শুদ্ধ আকারে যথার্থ অর্থে প্রয়োগ করিতেও অপারগ। অথচ বাংলায় মনের ভাব প্রকাশ করিবার সুবিধা হইলেও ঘৃণা করিয়া তাহা হইতে বিরত হন…. সতেজ স্বাভাবিক বাংলা ভাষা স্বাধীনতা পাইলে তৎসঙ্গে মুসলমান সমাজের উন্নতির যুগান্তর উপস্থিত হইবে। ১
১৯০৬ সালে ঢাকায় নিখিল ভারত মুসলীগ প্রতিষ্ঠা লাভ করে, সে অধিবেশনেও রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নটি ওঠে। ১৯০৭ সালে বিপ্লবী আবদুর রসুল ও আবদুল হালিম গজনবীর উদ্যোগে একটি কোম্পানী লিমিটেড কর্তৃক প্রকাশিথ ‘ দি মুসলমান’ পত্রিকার সম্পাদক মজিবর রহমান এসব উর্দুভাষী বাঙালি ঘৃণা করে ‘দি মুসলমান’পত্রিকাায় কলম ধরেছেন। এ সম্পর্কে সত্যেন সেন ‘বৃটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে মসুলমানদের ভূমিকা নামক গ্রন্থে লেখেন
‘‘শিক্ষিত মসুলমান একটি চিন্তাধারা লক্ষ্য করা যেত তাদের মধ্যে অনেকেই উৎপত্তি ও সংস্কৃতির দিক দিয়ে নিজেদের বাঙালি পরিচয় বলে স্বীকার করতে চাইতনা এবং বাংলা ভাষী হওয়া সত্বেও ঊর্দুকে নিজেদের ভাষা বালে দাবী করতেন। ‘দি মসুলমান’ পত্রিকা সব সময় এই লজ্জাকর মনোবৃত্তির উপর তীব্র কষাঘাত করে এসেছে। ২
মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের দাবিটি সম্ভবত প্রথম তুলেন চট্টগ্রামের পটিয়ার কৃতি সন্তান আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ। ১৯১৮ সালে ভাষা বির্তক চলাকালে ‘আল ইসলাম’ পত্রিকার আশ্বিন ১৩২৫ সংখ্যায় প্রকাশিত ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য বনাম বঙ্গীয় মুসলমান’ নামক প্রবন্ধে লিখেন,
‘ মাতৃভাষাকে জাতীয় ভাষার স্থলে বরণ করা ব্যতিত কোন জাতি কখনও উন্নতির সোপানে আরোহন করতে পারেনা।’
এ দিকে বৃটিশ ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলন ধীরে ধীরে শক্তিশালী হযে উঠতে থাকলে নতুন করে বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রীয় ভাষা মর্যাদা নিয়ে আলাপ আলোচনা শুরু হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর গান্ধী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে চিঠি লিখে জানতে চান, ভারতবর্ষ স্বাধীন হলে তার সাধারণ ভাষা কী হতে পারে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভারতের সাধারণ ভাষা হিসেবে হিন্দীর পক্ষে অভিমত জ্ঞাপন করেন।৩ বাংলার বাইরে অন্যান্য প্রদেশের মুসলমানদের রায় ছিল ঊর্দুর পক্ষে। অপরদিকে বাঙালি মুসলমানদের মধ্য থেকে বাংলার পক্ষে আওয়াজ ওঠে। ১৯১৮সালে রবীন্দ্রনাথ এ বিষয়ে আলোচনার জন্য শান্তি নিকতনে এক আলাচনা সভার আয়োজন করেন। সারা ভারত থেকে আগাত ভাষাতত্ত্ববিদদের সামনে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ একটি প্রবন্ধ পাঠ করে ভারতবর্ষের সাধারণ ভাষার হওয়ার যোগত্যা রাখে বাংলা, হিন্দু ও উর্দু
কথা উল্লেখপূর্বক সাধারণ ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরে শুধু ভারত কেন, সমগ্র এশিয়া মহাদেমেই বাংলা ভাষার স্থান হবে সর্বোচ্চ এবং ভাব সম্পদ ও সাহিত্যগুনে বাংলা ভাষা এশিয়া ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে অদ্বিতীয় বলে উল্লেখ করেন। ড. শহীদুল্লাহর সুক্ষ্মদর্শী প্রস্তাবনা সত্বেও অনাগত স্বাধীন ভাষতবর্ষে রাষ্ট্রভাষা বির্তক প্রধানত হিন্দু ও উর্দুর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। হিন্দুরা হিন্দু পক্ষে, মুসলমানরা উর্দুর পক্ষে। তবে এ হিন্দু ও উর্দু বির্তকের ডামাডোলের মধ্যে বাঙালি মুসলমানদের চিন্তাধারা বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সব সময় এক বিশেষ স্থান লাভ করে। ১৯২১ সালে বৃটিশ সরকারের কাছে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য লিখিতভাবে দাবী উত্থাপন করেন সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী দাবিনামায় তিনি বলেন, ‘ভারতের রাষ্ট্রভাষা যাই হোক, বাংলার রাষ্ট্রভাষা করতে হবে বাংলাকে।’৪
বাঙলা ভাষী শিক্ষার্থীদেরকে উর্দুর মাধ্যমে মাদ্রাসা শিক্ষা দানের প্রচলিত প্রথার বিরুদ্ধে ‘সওগাত’ প্রতিবাদ জানায় ১৯২৬ সালে। ১৯৩৭ সালে মুসলীম লীগের সভাপতি মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ জিন্নাহ উর্দুকে দলের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে প্রবর্তনের উদ্যোগ নিলে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে বাঙালি প্রতিনিধিদের বিরাধীতায় সে উদ্যাগ সফল হয়নি। মাতৃভাষাকে সকল পর্যায়ের শিক্ষার মাধ্যমরূপে গ্রহণ করার জন্য শিখা গোষ্ঠীও সংঘটিতত আন্দোলন চালায় এ সময় থেকেই। এ পটভূমিকায় ড. আনিসুজ্জামান লিখেন.
এটা মোটেও আশ্বর্য ছিল না যে,, রামের জন্মের আগে রামায়নের মতো, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগেই তার রাষ্ট্রভাষার বিষয়টি আলোচিত হয়। ১৯৪৭ সালের ৩ জুন ভারতের গর্ভণর জেনারেল লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন এর নেতৃত্বে মাউনব্যাটেন পরিকল্পনা ঘোষনার পরপরই আবদুল হক ও মাহবুব জামাল জাহেদীর মতো তরুন লেখক এবং ড. শহীদুল্লাহর মতো প্রবীণ ভাষাবিদ ও শিক্ষাবিদ দেশের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে স্বীকৃতি দানের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করেন। ‘মিল্লাত’, ‘ইত্তেহাদ’ সেই মত প্রকাশ করেন এবং গণ আজাদী লীগের ঘোষণা পত্রে এ দাবী লিপিবদ্ধ হয়। ৫
১৩৪৫ বাংলা সনে ভারতে রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। এ সম্পর্কে ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় ভারতের রাষ্ট্রভাষা সম্বন্ধে বিদ্বজ্জনের আলোচনা’ শিরোনামে এক সংবাদ ও আলোচনায় বলা হয়, সম্প্রতি রাষ্ট্রভাষা সম্বন্ধে আলোচনার করার নিমিত্তে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ ভবনে একটি সভার অধিবেশন হয়। সুপন্ডিত হীরেন্দ্রনাথ দত্ত মহাশয় সভাপতির আসন গ্রহণ করেন। তিনি এবং অতুল চন্দ্রগুপ্ত, অর্ধেন্দু কুমার গঙ্গোপাধ্যায়, উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, সুনীতি কমার চট্টোপাধ্যায়, খগেন্দ্র নাথ মিত্র, প্রফুল্ল কুমার সরকার, সুন্দরী মোহন দাস ও দ্বিজেন্দ্র নাথ মৈত্র আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। ‘বাংলার বহুলতার জন্য লিখিত ও অন্যান্য উপায় অবলম্বন করা উচিত: বিশেষ প্রয়োজন ভিন্ন বাঙালি মাত্রেরই দৈনন্দিন কার্য ও ব্যবহারে বাংলা ভাষা ব্যবহার করা কর্তব্য, বাংলাদেশ প্রবাসী অন্য ভাষাভাষী ব্যক্তিদের সহিত যতদূর সম্ভব বাংলা ভাষায় কথোপকথন ও চিন্তার বিনিময় কর্তব্য, এই সভার মতে ভারতীয় রাষ্ট্রের বর্তমান অবস্থায় রাষ্ট্রীয় ভাষা নির্ধারণের চেষ্টা কালোচিত নহে ও অসমীচীন। ভারতবর্ষে পূর্ণ স্বরাজ প্রতিষ্ঠিত হইবার পর ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের অন্তভূক্ত প্রদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিবর্গ কর্তৃক রাষ্ট্রীয় ভাষা নির্দিষ্ট হওয়া উচিত মর্মে আলোচনায় সিদ্ধান্ত হয়। ওই সভায় ড. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার সম্ভাবনা সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করেন এবং বলেন যে, ‘সাহিত্যের গৌরব থাকিলেই ভাষার প্রসার হয় না।’ ব্যস, এখানেই সমাপ্তি ঘটে ভারতের রাষ্ট্রভাষা সম্বন্ধে বিদ্বজ্জনের আলোচনা।
ইতোমধ্যে ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিতিত্তে শুরু হয় পাকিস্তান আন্দোলন। এ আন্দোলনের সময় আবার ওঠে আসে রাষ্ট্রভাষা বাঙলার প্রশ্নটি। ইতোমধ্যে অনেক লেখকরা লিখেন পাকিস্তান নিয়ে বিভিন্ন রকমের বই। ওই সব লেখকদের মধ্যে কতিপয় লেখক উর্দু ভাষার পক্ষে লিখলেও কয়েকজন লেখক বাংলা ভাষার পক্ষেই লেখেন। তার মধ্যে অন্যতম মুজিবুর রহমান খাঁ। মুজীবর রহমান খাঁ তার রচিত ‘পাকিস্তান’ গ্রন্থে ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, ‘মুসলিম লীগ এতদিন উর্দুকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা বলিয়া প্রচার করিয়াছে সত্য। কিন্তু যত দিন লীগ অখন্ড ভারতে বিশ্বাসী ছিল, ততদিন তার এ দাবীর জোর ছিল। লাহোর প্রস্তাব গৃহিত হওয়ার পর পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষা বাংলা ভিন্ন আর কিছুই হতে পারেনা। (পাকিস্তান, মুজীবর রহমান খাঁ, পৃ: ১৭২)। এ প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন, ‘ভারতে উর্দুুর সাথে একমাত্র বাংলা সমমর্যাদা দাবী করিতে পারে। এই উভয় ভাষা যেমন শব্দ সম্পদে উন্নত, তেমনই উভয় সাহিত্যও বিশ্বের বড় বড় সাহিত্যের পার্শ্বে স্থান লাভের যোগ্য। সুতরাং নির্ভয়ে বলা যাইতে পারে, পূর্ব পাকিস্তানে যেমন বাংলা, হিন্দুস্থানে যেমন হিন্দু, তেমনই পশ্চিমা পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষা হইবে উদু। ৬ মুজীবর রহমান খাঁর মতো একই ধরনের মতামত প্রকাশ করেন হাবিবুল্লাহ বাহার এর ‘পাকিস্তান’, তালেবুর রহমানের ‘পাকিস্তানবাদের ক্রমবিকাশ’ ও ‘সর্বহারাদের পাকিস্তান’ অধ্যাপক, আবুল মনসুর আহমদ, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কবি ফররুখ আহমদ ড.ফেরদৌস খান প্রমুখরা তাদের নিজ নিজ গ্রন্থে।
মাসিক মোহাম্মদীতে ১৩৫০ বাংলা সালের কার্তিক সংখ্যায় আবুল মনসুর আহমদ ‘পূর্ব পাকিস্তানের জবান’ শীর্ষক প্রবন্ধে রাষ্ট্রভাষা উর্দু চাপিয়ে দেওয়ার বিরোধীতা করে বলেন, ‘উর্দু নিয়ে এই ধস্তাধস্তি না করে আমরা সোজাসুজি বাংলাকে যদি পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ও জাতীয় ভাষারূপে গ্রহণ করি, তবে পাকিস্তান প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আমরা মুসলিম বাংলার শিক্ষিত সম্প্রদায় নিজেরাই পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রিক, সামাজিক, শিক্ষাগত, অর্থনৈতিক ও শিল্পগত রূপায়নে হাত দিতে পারবো।’
কিন্তু সংখ্যায় কম হলেও ভিন্ন মতাবলম্বীদের অভাব ছিল না এ পূর্ব বাংলায়। ১৯৪৭ সালের মে মাসে হায়দ্রাবাদে অনুষ্ঠিত এক উর্দু সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে কেন্দ্রিয় মুসলীম লীগ নেতা চৌধুরী খালিকুজ্জামান ঘোষণা করেন যে ‘উর্দু হবে পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা।’ বিভাগপূর্বকালে ১৯৪৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালিন এক শ্রেণীর শিক্ষিত ব্যক্তির রাষ্ট্রভাষা বাংলার বিপকেটষ বক্তব্য রাখার কঠোর সমালোচনা করে ‘পাকিস্তান : রাষ্ট্রভাষা ও সাহিত্য শীর্ষক প্রবন্ধে কবি ফররুখ আহমদ বলেন, পাকিস্তানের অন্তত : রাষ্ট্রভাষা যে বাংলা হবে এ কথা সর্ববাদীসম্মত হলেও আমাদের এই পূর্ব পাকিস্তানের কয়েকজন তথাকথিত শিক্ষিত ব্যক্তি বাংলা ভাষার বিপক্ষে এমন অর্বাচীন মত প্রকাশ করেছেন যা নিতান্ত লজ্জাজনক। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষায় রূপায়িত করলে ইসলামী ঐতিহ্যের সর্বনাশ হইবে এই তাদের অভিমত। কী কুৎসিত পরাজয়ী মনোবৃত্তি এর পেছনে কাজ করছে এ কথা ভেবে আমি বিষ্মিত হয়েছি।। যে মনোবৃত্তির ফলে প্রায় ২০০ বছর বাঙলা ভাষায় ইসলামের প্রবেশ প্রায় নিষিদ্ধ ছিল , সেই অন্ধ মনোবৃত্তি নিয়েই আবার আমরা ইসলামকে গলাটিপে মারার জন্য তৎপর হয়ে উঠেছি। (মাসিক সওগাত, আশ্বিন সংখ্যা, ১৩৫৪)।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার এক মাসে আগে (জুলাই মাসে) আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ অভিমত ব্যক্ত করেন, হিন্দীকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর যুঙ্গিসংগত কারণে উদর্ুূকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করা উচিত। ড. জিয়াউদ্দিন আহমদের বক্তব্য খন্ডন করে ২৯ জুলাই দৈনিক আজাদ পত্রিকায় ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ‘আমাদের ভাষা সমস্যা’ নামক প্রবন্ধ লিখে জোরালো প্রতিবাদ করে রাষ্ট্রভাষারুপে বাংলার দাবী তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘কংগ্রেসের নির্দিষ্ট হিন্দীর অনুকরণে উর্দু পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষারূপে গণ্য হইলে তাহা শুধু পশ্চাদগমনই হইবে।… যদি বিদেশী ভাষা বলিয়া ইংরেজি ভাষা পরিত্যক্ত হয়, তবে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ না করার পক্ষে কোন যুক্তি নাই। ….পূর্ব পাকিস্তানের কোর্ট ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলার পরিবর্তে উর্দু বা হিন্দীকে গ্রহণ করা হইলে ইহা রাজনৈতিক পরাধীনতার নামান্তর হইবে। কবি ফররুখ আহমদও কলম ধরেন।
পাকিস্তান ও ভারত সৃষ্টির আগে তথা ১৯৪৭ সালের ফেব্র“য়ারির দিকে ছাত্র ফেডারেশন কর্মী শহীদ সাবের ও সাইমুম শমসের নামে কক্সবাজারের দুই কৃতি সন্তান কক্সবাজার থেকে জাগরণ নামে একটি সাহিত্য প্রকাশ করেন। ‘জাতীয় জাগরনের অগ্রদূত’ স্লোগানে প্রকাশিত ‘জাগরণ’-এ বাংলা ভাষার স্বীকৃতি দানের বিষয়টি তুলে ধরে সম্পাদকীয় লেখেন শহীদ সাবের।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে প্রধানত দুটি পর্বে ভাগ করা যায়। প্রথমত: ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৫১ এবং দ্বিতীয় বা চূড়ান্ত পর্যায় বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে কক্সবাজারের অবদান সম্পর্ক তথ্য অপ্রতুল। ঢাকা ও চট্টগ্রাম ও অন্যান্য এলাকার ভাষা আন্দোলনের বিষয়ে যেভাবে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে কক্সবাজার তা থেকে অনেক দূরে। সাংবাদিকতা জগতে তেমন সচেতন না থাকায় এবং ওই সময়ে কক্সবাজার থেকে কোন পত্রিকা কিংবা জাতীয়/আন্তর্জাতিক পত্রিকায় কাজ করা সাংবাদিক কর্মরত না থাকায় তেমনভাবে ফলাও করে সংবাদ প্রকাশিত হয়নি। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা কিংবা সমকালীন বৈশ্বিক গণমাধ্যমেও এ সম্পর্কিত তথ্য অনুপস্থিত। তবে বিভিন্ন জনের স্মৃতিকথায় এ সম্পর্কিত যৎকিঞ্চিত তথ্য পাওয়া যায়। এজন্য এ রচনায় প্রধানত: নেতৃস্থানীয় ভাষা সংগ্রামীদের সাক্ষাৎকারের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে। ইতিহাস রচনার উৎস হিসেবে সাক্ষাৎকার বা স্মৃতিকথার সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও অন্যান্য উপাদানের অভাবে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন নেতৃস্থানীয় ভাষা সংগ্রামীদের সাক্ষাৎকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্মৃতিকথা বা সাক্ষাৎকারগুলো ব্যবহার করার ক্ষেত্রে এর সীমাবদ্ধতা যেমন তথ্য বিকৃতি, আবেগদৃপ্ত উপস্থাপনা, কথনের অতিরঞ্জন উপস্থাপনা প্রভৃতি ত্র“টির বিষয়ে যথাসম্ভব সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে।
১৯৪০ সালে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক উত্থাপিত লাহোর প্রস্তাবে ভারতের উত্তর পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের সংখ্যাগুরু মুসলিম অঞ্চলগুলি নিয়ে ‘স্বাধীন রাষ্ট্রসমুহ’(Indépendant States) গঠনের কথা উল্লেখ থাকলেও ১৯৪৬ সালের ৯ এপ্রিল দিল্লীতে মুসলিম আইন পরিষদ সম্মেলনে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ একে অসাবধানপ্রসূত ও ছাপাখানার ভুল বলে উল্লেখপূর্বক ‘পাকিস্তান’ এর পক্ষে প্রস্তাব গ্রহণ করে। ফলে আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে কায়েমী স্বার্থবাদী মহলের মিথ্যা প্ররোচনায় বিভ্রান্ত হয়ে এ সময় পূর্ব বাঙলার সারা প্রদেশের ন্যায় অধিকাংশ চট্টগ্রামবাসী পাকিস্তান আন্দোলনের দিকে ঝুঁকে পড়েন। ১৯৪৭ সালের ১৪ ও ১৫ আগস্ট দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান ও ভারত নামক দুটি রাষ্ট্র সৃষ্টি করে বৃটিশরা ভারতবর্ষ থেকে বিতাড়িত হন। ভারত বিভক্তির সাথে সাথে পূর্বাঞ্চলের বেশিরভাগ বিত্তবান শিক্ষিত হিন্দুরা চলে গেল পশ্চিমবঙ্গে আর বাঙালি মুসলমান যারা শিক্ষিত ও নগরকেন্দ্রিক হয়ে উঠলো তারা যেন রাতারাতি আরব সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট হযে ধর্মের আবেগে পাকিস্তানী ভাবধারায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়লো। ফলে সংস্কৃতির অঙ্গনে দেখা দিল শূন্যতা। তবে বাঙালি মুসলমানদের পাকিস্তান প্রেমের আচ্ছন্নতা কেেেট যেতে বেশি সময় লাগেনি। পাকিস্তান কায়েমের এক বছরের মধ্যে কেন্দ্রিয় সরকার পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার বিষয়টি নিষ্পত্তি না করেই এনভেলাপ, পোস্টকার্ড, ডাকটিকেট, মানি অর্ডার, ট্রেন টিকেট ও টাকার উপর ঊর্দু এবং ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করার মধ্য দিয়ে বাঙালির ভাষা সংস্কৃতিতে আঘাত শুরু করে। এ প্রেক্ষাপটে পটিয়ার কৃতি সন্তান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক আবুল কাসেম পাকিস্তান সৃষ্টির ১৭ দিনের মাথায় ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর ঢাকায় গঠন করেন ‘তমদ্দুন মজলিস’। অনেকটা ইসলামী তমদ্দুনকে সমুন্নত করার প্রত্যয়ে এ সংগঠন গঠিত হলেও এ সংগঠনই প্রথম বাংলা ভাষার দাবিতে প্রতিবাদী আন্দোলনের সূচনা করেন। এর ধারাবহিকতায় ওই সনের ১৫ সেপ্টেম্বর তমদ্দুন মজলিস থেকে প্রকাশিত হয় ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না ঊর্দু’ শিরোনামে পুস্তিকা। এই পুস্তিকায় অধ্যাপক আবুল কাসেম ‘আমাদের প্রস্তাব’, অধ্যাপক ড. কাজী মোতাহের হোসেন ‘রাষ্ট্রভাষা ও পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা সমস্যা’ এবং আবুল মনসুর আহমদ ‘বাংলাই আমাদের রাষ্ট্রভাষা হইবে’ নামক তিনটি প্রবন্ধে লিখে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে পাকিস্তান আমলে প্রথম আন্দোলন সংঘটিত করেন। ভাষা আন্দোলনের প্রথম ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে গণ্য এ পুস্তিকা জনমনে রেখাপাত করে এবং ব্যাপক জনমত তৈরী করে। এ অবস্থায় তমদ্দুন মজলিস হাজার হাজার মানুষের দস্তখত সংগ্রহ করে তা স্মারকলিপি আকারে ১৯৪৭ সালের ১৭ নভেম্বর পূর্ব বাঙলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দীনকে প্রদান করে। কিন্তু এতেও শাসক দলের টনক না নড়ায় শিক্ষার্থীরা বিক্ষুব্দ হয়ে সভা সমাবেশের আয়োজনে নামে। ১৯৪৭ সালের ৬ ডিসেম্বর রাষ্ট্রভাষার দাবীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রথম জনসভায় হয়। তমদ্দুন মজলিসের কর্ণধার অধ্যাপক আবুল কাসেম এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের ভাইস প্রেসিডেন্ট ফরিদ আহমদ (পরবর্তীতে মৌলভী ফরিদ আহমদ নামে রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে পরিচিত), অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, আবদুর রহমান চৌধুরী(পরবর্তীতে বিচারপতি), পটিয়ার কৃতিসন্তান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক এ কে এম আহসান, কল্যাণ দাশগুপ্ত, এস. আহমদ প্রমুখ। ডাকসুর সভাপতি হিসেবে ফরিদ আহমদ বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা ও পূর্ব পাকিস্তানের সরকারী ভাষা এবং শিক্ষার মাধ্যম করার লিখিত প্রস্তাব পেশ করে বক্তৃতা করেন।


[img|http://cms.somewhereinblog.net/ciu/image/195454/small


ফরিদ আহমদ তখন একদিনে যেমন ঢাবির আইনের ছাত্র, তেমনি অন্যদিকে ঢাকা গভর্ণমেন্ট কলেজ এর ইংরেজি অধ্যাপক ছিলেন। তিনি আরেকটি প্রস্তাবে রাষ্ট্রভাষা এবং লিংগুয়া ফ্রাংকা নিয়ে যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে তার মূল উদ্দেশ্য আসল সমস্যাকে চাপা দেয়া এবং বাংলা ভাষা ও পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা বলে মন্তব্য করা হয়।৭ সভাশেষে অধ্যাপক আবুল কাসেম এর নেতৃত্বে একটি বিশাল মিছিল সহকারে সেক্রেটারিয়েট অভিমূখে গমন করে মুখ্যমন্ত্রী নাজিম উদ্দিন, নুরুল আমিনর বাসভবন ও সেক্রেটারিয়েট ঘেরাও করা হয়। ৮ এভাবে ধীরে ধীরে ভাষা আন্দোলন অঙ্কুরিত হতে থাকে। এরই মধ্যে ১৯৪৭ সালের ৩০ ডিসেম্বর তমদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে রাষ্ট্রভাষা সাব কমিটি নামে প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। রাষ্ট্রভাষার দাবীতে গঠিত প্রথম এ সংগ্রাম পরিষের আহ্বায়ক নিযুক্ত হন ঢাবির তরুন অধ্যাপক ড. নুরুল হক ভূইয়া, সদস্য- অধ্যাপক আবুল কাসেম, অধ্যাপক আবদুল গফুর, গণতান্ত্রিক যুবলীগের কমরেড মো. তোয়াহা, ডাকসু ভিপি ফরিদ আহমদ, শামসুল আলম, অলি আহাদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, চট্টগ্রামের প্রকৌশলী আজিজুর রহমান, প্রকৌশলী নুরুল হুদা, নুরুল আলম (টাঙ্গাইল), লিলি খান, নইমুদ্দিন, আখলকুর রহমান, আবদুল মতিন খান চৌধুরী, আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী প্রমুখ।
ইতোমধ্যে ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের প্রথম পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষার বিষয় তালিকা হতে বাংলা ভাষাকে বাদ দেওয়ার প্রতিবাদে ১৯৪৮ সালের ৬ জানুয়ারি ঢাকা সরকারি ইন্টারমিডিয়েট কলেজের (বর্তমানে ঢাকা কলেজ) লেকচারার ফরিদ আহমদ পদত্যাগ করেন। (৯ জানুয়ারি ১৯৪৮, দৈনিক আনন্দ বাজার পত্রিকা)। ভাষা আন্দোলনের জড়িত থাকার অভিযোগে পূর্ব পাকিস্তানের চীফ সেক্রেটারি আজিজ তাকে ডেকে সতর্ক করে দিলে, তিনি সঙ্গে সঙ্গে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষার বিষয় তালিকা হতে বাংলা ভাষাকে বাদ দেওয়ার প্রতিবাদে অধ্যাপকের পদ থেকে ইস্তফা দেন।
সরকারী চাকুরী থেকে ইস্তফাকারী ফরিদ আহমদ কক্সবাজারের কৃতি সন্তান হওয়ায় চট্টগ্রাম জেলা জুড়ে এ খবরটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। অবস্থানগত দিক দিয়ে বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণের মহকুমা কক্সবাজারের রামুতেও এ খরবটি পৌঁেছ। অনেক আগে থেকেই তথা খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন চলাকালীন সময়ে আবদুল মজিদ সিকদার, মাওলানা মজহেরুল হক চৌধুরী, রাস মোহন বড়–য়ার বদৌলতে রাজনৈতিক দিক থেকে রামুর পরিচিতি বৃদ্ধি পায়। ব্রটিশ বিরোধী আন্দোলনের সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত রামু খিজারী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে কক্সবাজারে এ আন্দোলনের যাত্রা শুরু হয়। ওই স্কুলের ১০ শ্রেণীর ছাত্র মো. বদরুজ্জামান (পরবর্তীতে ডা. এম বি জামান নামে চট্টগ্রামের বিশিষ্ট শিশু বিশেষজ্ঞ), নবম শ্রেণীর ছাত্র ওবায়দুল হক ( যিনি ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে কক্সবাজার মহকুমা থেকে মুসলিম লীগের প্রার্থী কবির আহমদ চৌধুরী একজন ক্ষুদে কর্মী হিসেবে কাজ করেন এবং পরবর্তীতে ফতেখাঁরকুল ইউপি চেয়ারম্যান ছিলেন), রসিক চন্দ্র বড়–য়া, ৮ম শ্রেণীর ছাত্র নুরুল ইসলাম হেলালী (পরবর্তীতে অধ্যাপক, বর্তমানে বাঙলাদেশ লেখক শিবির-চট্টগ্রাম জেলার সভাপতি) প্রমুখের নেতৃত্বে তৎক্ষনাৎ ক্লাস বর্জন করে মিছিল সহকারে বের হয়ে রামু চৌমুহনীতে মিলিত হন। এ দিকে বড় ভাইদের মিছিলে অংশ গ্রহণ দেখে রামু সেন্ট্রাল প্রাইমারী স্কুলের ৪র্থ শ্রেণীর ছাত্র আমিরুল কবির চৌধুরী, মোশতাক আহমদ (প্রফেসর), ওসমান সরওয়ার আলম চৌধুরী প্রমুখ মিছিলে যোগ দেন। মিছিল পরবর্তী সময়ে রামুর চৌমুহনীতে এক জনসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় বক্তব্য রাখেন মো. বদরুজ্জামান, ওবায়দুল হক, রসিক চন্দ্র বড়–য়া, জাকের আহমদ চৌধুরী, মোশতাক আহমদ, ওসমান সরওয়ার আলম চৌধুরী প্রমুখ। ওই সমাবেশে আমিরুল কবির চৌধুরীর জীবনের প্রথম বক্তৃতা করেছেন বলে তার ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে কক্সবাজার’ শীর্ষক লেখায় উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এ নিয়ে দ্বিমত এই যে, চতুর্থ শ্রেণীর একজন ছাত্র হয়ে কিভাবে বক্তৃতা রাখতে পারে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেন অনেকে। ওই সমাবেশ থেকে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে আমরণ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়।
১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্র“য়ারি পাকিস্তান গণ-পরিষদের অধিবেশনে পূর্ব বাঙলার সদস্য কুমিল্লার ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত গণপরিষদে বাংলা ভাষা ব্যবহারের পক্ষে প্রস্তাব উত্থাপন করলে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান, পূর্ব বাঙলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিনের তীব্র বিরোধীতার মুখে তা নাকচ হয়ে যায়। এর প্রেক্ষিতে ওই সময় তমদ্দুন মজলিস পাকিস্তানে একটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ধারা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটিতে অন্যান্য দলের লোক অন্তর্ভূক্ত করে শামসুল আলমকে আহ্বায়ক করে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটিকে সম্প্রসারিত করে ২ মার্চ ১৯৪৮। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি ঢাকায় এক সভায় মিলিত হয়ে ১১মার্চ ঢাকাসহ সারাদেশের প্রতিবাদ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয় । ১১ মার্চের প্রতিবাদ দিবস সারা প্রদেশব্যাপী পালন করা হয়। এর প্রভাব চট্টগ্রাম জেলা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।
১১ মার্চের প্রবল ছাত্র বিক্ষোভের পর খাজা নাজিম উদ্দিন রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সাথে ৮ দফা চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। যদিও জিন্নাহ তা পরে অস্বীকার করে ‘এটা জোর করে আদায় করা হয়েছে মর্মে ১৯৪৮ সালের ২৪ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে অনুষ্ঠিত সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ঘোষণা করে বলেন, The State language therefore, must obviously be Urdu, a language that has been nurtured by a hundred million Muslims of this sub-continent, a language understood throughout the length and breadth of Pakistan and above all a language which, more than any other provincial language, embodies the best that is in Islamic culture and Muslim tradition and is nearest to the language used in other Islamic countries.”
জিন্নাহ বক্তব্যের সময় আবদুল মতিন (ভাষা মতিন), চট্টগ্রামের পটিয়ার কৃতি সন্তান একেএম হাসান, নইমুদ্দিন, আতাউর রহমান খান ‘নো’, ‘নো’ বলে চিৎকারে তার তীব্র প্রতিবাদ জানায়। বক্তব্যকে পাশ কাটিয়ে জিন্নাহ বলেন, ‘‘ Its is my views. পরক্ষণে তিনি কথা না বাড়িয়ে I hope Bengal will not fail me বলে বক্তব্য শেষ করেন। ওই দিন বিকেলে তমদ্দুন মজলিসের অধ্যাপক আবুল কাসেম, শামসুল হক, তাজউদ্দিন আহমদ, লিলি খান, আজিজ আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কমরেড মো. তোয়াহা, অলি আহাদ, নঈমুদ্দিন ও এম শামসুল আলমের নেতৃত্বে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর সাথে দেখা করেন। প্রায় ৪৫ মিনিট ধরে চলা এ বৈঠকে জিন্নাহ প্রতিনিধি দলকে পাকিস্তানের সংহতির স্বার্থে এক রাষ্ট্রভাষা ওপর গুরত্বারোপ করেন। এ নিয়ে প্রতিনিধি দলের সঙ্গে জিন্নাহর তর্ক হয়। তর্কের এক পর্যায়ে মাগরিবের আজান দিলে নামাজের বিরতিতে শামসুল হক জিন্নাহকে নামাজ পড়ার আহ্বান জানালে পরিবেশ জটিল হয়ে পড়ে (জিন্নাহ ইসলামকে ভালবেসে পাকিস্তান আন্দোলন, পাকিস্তানের জনক, উর্দুকে ভালবাসলেও বিলেত ফেরত ব্যক্তি হিসেবে নামাজ পড়েননি তেমন, পাশাপাশি নামাজ কিভাবে পড়তে হয় তাও জানতেন না, ব্যক্তিগত স্বার্থে নেতা হওয়ার জন্য মুসলীম লীগের সাথে জড়িত হয়েছিলেন। যার কারণে প্রতিনিধিদলের নেতা শামসুল হক নামাজ পড়ার কথা বললে পরিস্থিতি জটিল হয়ে যায়)।৯ এতে বির্তক সংক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। ভাষা প্রশ্নে শেষ না হলেও প্রতিনিধিদল রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে জিন্নাহকে স্মারকলিপি প্রদান করে।
জিন্নাহ ঢাকা সফর শেষে চট্টগ্রামে সফরে আসেন। ১৯৪৮ সালের ২৫-২৭ মার্চ চট্টগ্রামের দামপাড়া পুলিশ লাইনে অবস্থানকালে উর্দু ভাষার পক্ষে এবং আরবী হরফে বাংলা লেখার অভিপ্রায় ব্যক্ত করে। মুসলীম লীগ নেতা এ কে খান ও আহমদ সগীর চৌধুরী এ সভায় বক্তব্য রাখলেও জিন্নাহ সভায় উর্দুর পক্ষে বক্তব্য রাখলেও শ্রোতাদের মধ্যে থেকে জোরালো কোন প্রতিবাদ হয়নি। কিন্তু এ খবরটি বাইরে প্রচার হলে তীব্র সমালোচনার ঝড় উঠে। চট্টগ্রামের ছাত্র সমাজ ক্ষোভে ফেটে উঠে। এর কয়েকদিন পর চট্টগ্রামে সাহিত্যিক মাহবুব আলম চৌধুরী, গোপাল বিশ্বাস, ফরমান উল্লাহ খান, শহীদ সাবের (পরবর্তীতে একাত্তরের শহীদ বুদ্ধিজীবী) প্রমুখ মিলে ‘সংস্কৃতি বৈঠক’, ‘তমদ্দুন মজলিস’, ‘ছাত্র ফেডারেশন’ প্রভৃতি সমমনা দল নিয়ে জেএমসেন হলে জিন্নাহর বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া এক সভার আয়োজন করা হয়। প্রতিবাদ সভার প্রচারের জন্য ঘোড়া গাড়ী নিয়ে মাইকে প্রচারের সময় মুসলিম লীগের প্রতিক্রিয়াশীল অংশের ভাড়াটে গুন্ডারা কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাবাধীন মাহবুব আলম চৌধুরী, ছাত্র ফেডারেশন নেতা শহীদ সাবের ও সাহিত্যিক গোপাল বিশ্বাসের উপর হামলা করে। সেদিন হামলাকারীরা আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভাও পন্ড করে।১০
এরপর আন্দোলন সংগ্রাম চলতে থাকে সারা প্রদেশে। ১৯৪৮ সালের ৮ এপ্রিল পূর্ব বাঙলার প্রাদেশিক পরিষদ অধিবেশনে বাংলাকে (পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা না করে) কেবলমাত্র পূর্ব বাঙলার সরকারী ভাষারূপে ঘোষণা করে মুখ্যমন্ত্রীর ইতোপূর্বে স্বাক্ষরিত ৮ দফা চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে আরবী হরফে বাংলা লেখার অদ্ভুত সুপারিশ করে পাকিস্তান কেন্দ্রিয় শিক্ষাবোর্ড। যার প্রতিক্রিয়া হিসেবে সারা বাঙলায় ছড়িয়ে পড়ে আরবী হরফের বাংলার প্রতিরোধ আন্দোলন। পালিত হয় ধর্মঘটসহ নানা কর্মসূচী। সারাদেশের প্রদেশের ন্যায় রামুতেও পালিত হয় ছাত্র ধর্মঘট। ১১ এপ্রিল মো. বদরুজ্জামানের নেতৃত্বে রামু খিজারী স্কুল থেকে মিছিল সহকারে বের হয়ে রামু চৌমুহনীতে জনসভায় মিলিত হয়। ওই সভায় ওবায়দুল হক, আফসার কামাল চৌধুরী, নুরুল ইসলাম হেলালী, রসিক চন্দ্র বড়–য়া, জাকের আহমদ চৌধুরী, আমিরুল কবির চৌধুরী, মোশতাক আহমদ, ওসমান সরওয়ার আলম চৌধুরী প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।১১ ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনে কক্সবাজারের অন্য কোথাও সক্রিয় অবদান আছে কিনা তা জানা যায়নি। এরপরে ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গটির কথা তেমনভাবে না উঠলেও ১৯৪৯ সালের দিকে শুরু হয়ে চট্টগ্রামে ঝট সামান্য আন্দোলন চলে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত। ১৯৪৯ সালের ৯ মার্চ গঠিত পূর্ব বঙ্গভাষা কমিটি ১৯৫০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পূর্ব বাঙলার স্কুলসমুহে উর্দুকে সরকারী ভাষা করায় প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির প্রতিবাদ সভা, ১৯৪৯ সালে চট্টগ্রামে শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান সফরে আসলে উর্দুর কথা বলায় তাকে অপমানসহ বিভিন্ন আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মূল আঘাতটি আসে ১৯৫২ সালে। ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকারীদের দাবীর প্রেক্ষিতে ১৫ মার্চ স্বাক্ষরিত ৮ দফা চুক্তি (দেখুন পরিশিষ্ট ১) ভঙ্গ করে ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানে মুসলিম লীগের সম্মেলনে পাকিস্তান প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন পুনরায় ঘোষণা করেন, ‘‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হইবে একমাত্র উর্দু ’-এবং ‘‘ঊর্দু হরফে বাংলা লিখনের প্রচেষ্টা সাফল্যমন্ডিত হইতেছে’। তার এ বক্তব্যে পূর্ব পাকিস্তানে জ্বলন্ত আগুনে ঘি ঢালার মতো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এর প্রতিবাদে ২৯ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের এক প্রতিবাদ সভা হয়। ৩০ জানুয়ারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রগণ প্রতীকী ধর্মঘট পালন করেন এবং বিভিন্ন শিক্ষায়তনের ছাত্রদের সহযোগ এক বিরাট শোভাযাত্রা বের করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। ওই দিন নাজিমুদ্দিনের বক্তব্যের প্রতিবাদে পূর্ব পাক মুসলিম ছাত্র লীগের উদ্যোগে বার লাইব্রেরী হলে আহুত সর্বদলীয় এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় পূর্ব পাক মুসলীম ছাত্রলীগ, আওয়ামী মুসলিম লীগ, তমদ্দুন মজলিস, গণতান্ত্রিক যুবলীগ, ইসলামী ভ্রাতৃসংঘ প্রভৃতি রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ছাত্র প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৪০ জন প্রতিনিধি সমন্বয়ে কাজী গোলাম মাহবুবকে আহ্বায়ক করে একটি কেন্দ্রিয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। সর্বদলীয় সভায় বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের অফিসাদির ভাষা এবং কেন্দ্রের অন্যতম রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণের জন্য খাজা নাজিমুদ্দীন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে ১৫ মার্চ ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে যে ৮ দফা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন তা ভঙ্গ করার নিন্দা প্রকাশ করা হয় এবং অনতিবিলম্ভে তার ভাষা সম্পর্কিত উক্তির প্রত্যাহারপূর্বক বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকার করে নেওয়ার দাবী জানানো হয় এবং উর্দু হরফে বাংলা লেখার চক্রান্তের বিরুদ্ধেও এক প্রস্তাবে সরকারকে হুশিয়ারী করে দেয়া হয়।১২
সংগ্রাম পরিষদ ৪ ফেব্র“য়ারি সোমবার ঢাকা শহরের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র ধর্মঘট ও প্রতিবাদ বিক্ষোভ, ১১ ও ১৩ ফেব্র“য়ারি ঢাকায় পতাকা দিবস পালন করে এবং ২১ ফেব্র“য়ারি সারা পূর্ব বাঙলায় সভা, সমাবেশ, মিছিল ও হরতালের কর্মসূচী ঘোষণা করে। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ এ লক্ষ্যে ছাত্র-জনতার মধ্যে লাগাতার প্রচারণা শুরু করে। এই দিকে পুর্ব পাকিস্তান সরকার এতে বিচলিত হয়ে ২০ ফেব্রুয়ারি বুধবার বিকেলে ঢাকা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জনাব কোরাইশি এক মাসের জন্য ১৪৪ ধারার আদেশ জারি করে সভা-সমাবেশ, শোভাযাত্রা প্রভৃতি নিষিদ্ধ করে। ২১ ফেব্র“য়ারি ১৯৫২ দৈনিক আজাদ-এ প্রকাশিত খবরে বলা হয়:ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট গতকল্য (বুধবার) ১৪৪ ধারার আদেশজারী করিয়া এক মাসের জন্য ঢাকা শহরে সভা, শোভাযাত্রা প্রভৃতি নিষিদ্ধ করিয়াছেন। আদেশজারীর কারণস্বরূপ তিনি বলেন যে, একদল লোক শহরে সভা, শোভাযাত্রা ও বিক্ষোভ প্রদর্শনের প্রয়াস পাওয়ায় এবং তদদ্বারা জনসাধারণের শান্তি ও নিরাপত্তা বিনষ্ট হওয়ায়র আশংকা থাকায় এই ব্যবস্থা অবলম্ভিত হইয়াছে। কোতোয়ালী, সূত্রাপর, লালবাগ, রমনা ও তেজগাঁও থানার অন্তর্গত সমুদয় এলাকায় ইহা প্রবর্ত্তিত হইয়াছে। ১৩
পূর্ব পাকিস্তান সরকারের ১৪৪ ধারা জারির প্রেক্ষিতে ছাত্ররা আরো বিক্ষুব্দ হয়ে উঠে। ১৪৪ ধারা জারি ভঙ্গ করে ২১ ফেব্র“য়ারি ঢাকা শহরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা সকাল ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনে সমবেত হয় এবং তারা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে মিছিল নিয়ে ঢাকার রাজপথ প্রকম্পিত করে তোলে। পথিমধ্যে পাহারাত পুলিশের কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ উপেক্ষা করে প্রাদেশিক পরিষদ ভবনকে ঘেরাও করার উদ্দেশ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজের হোস্টেল প্রাঙ্গনে গেলে বিক্ষোভরত ছাত্রদের উপর পুলিশ গুলি চালায়। পুলিশের গুলিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম.এ ক্লাসের ছাত্র মোহাম্মদ সালাহউদ্দীন (২৬) ঘটনাস্থলে নিহত এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবদুল জাব্বার (৩০), আবুল বরকত (২৫), নবাবপুর রোডের রাজমিস্ত্রি হাবিবুর রহমানের ছেলে তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র অহিউল্লাহ, বাদামতলী কর্মাশিয়াল প্রেসের মালিকের পুত্র রফিকুদ্দীন (২৭), সলিমুল্লাহ মোছলেম হলের ছাত্র আনোয়ারুল এছলাম (২৪), জগন্নাথ কলেজের ছাত্র এ আর ফৈয়াজ (১৯), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সিরাজুদ্দীন খান (২২), সরকারী শুল্ক বিভাগের পিয়ন আবদুস সালাম (২৭), এলাহী বখশ (৪০), মনসুর আলী (১৬), বছিরুদীন আহমদ (১৬), তাজুল এছলাম (২২), মাছুদুর রহমান (১৬), আবদুস সালাম (২২), আখতারুজ্জামান (১৯), এ রেজ্জাাক (১৭), মোজাম্মেল হক (২৩), সুলতান আহমদ (১৮), এ রশিদ (১৪), মোহাম্মদসহ বহু সংখ্যক ছাত্র ও পথচারী আহত হয়। পরে ওই দিন রাতে আবদুল জাব্বার (৩০), আবুল বরকত (২৫), নবাবপুর রোডের রাজমিস্ত্রি হাবিবুর রহমানের ছেলে তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র অহিউল্লাহ, বাদামতলী কর্মাশিয়াল প্রেসের মালিকের পুত্র রফিকুদ্দীন আহমদ(২৭) ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান এবং দৈনিক আজাদ’র ৮ এপ্রিল ১৯৫২ একটি সংবাদ অনুযায়ী, ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছে পুলিশের গুলিতে আহত সরকারী শুল্ক বিভাগের পিয়ন আবদুস সালাম (২৭) প্রায় দেড় মাস চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৭ এপ্রিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং ২২ ফেব্র“য়ারি সকাল ১০টায় ঢাকা হাইকোর্টের কর্মচারী সফিউর রহমান নবাবপুর রোড হয়ে কাজে যাওয়ার পথে পুলিশের গুলিতে আহত হয়। ওই দিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডা. এ্যালিনসন এর তত্বাবধানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সন্ধ্যা ৬টায় মারা যান। এ খবর সারা দেশে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। ২২ ফেব্র“য়ারি পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদ অধিবেশন চলাকালে পরিষদ হতে আজাদ সম্পাদক ও পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য আবুল কালাম শামসুদ্দিন, ২৩ ফেব্র“য়ারি শনিবার পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থা পরিষদের সদস্য মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ লীগ পার্লামেন্টারি পার্টি হতে ও ঢাকায় ১৪৪ ধারার প্রবর্তন এবং ২১ ও ২২ ফেব্র“য়ারি ছাত্রদের উপর গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে পূর্ববঙ্গ পরিষদের সদস্য আহমদ হোসেন মোছলেম লীগ পার্লামেন্টারি পার্টি এবং প্রাদেশিক লীগ ওয়ার্কিং কমিটির পদ থেকে এস্তেফা দেন।
রাষ্ট্রভাষা বাঙলার দাবীতে ২১ ফেব্র“য়ারি ঢাকায় শান্তিপূর্ণ মিছিলে গুলি এবং ছাত্র নিহত ঘটনার খবরটি প্রথম কক্সবাজারে আসে টেলিফোনের মাধ্যমে কক্সবাজার মহকুমা প্রশাসক মৌলভী গফুরুজ্জামান চৌধুরীর বাসায়। ওই টেলিফোন সেটের একটি সংযোগ ছিল কক্সবাজার খাস মহলের তৎকালিন কে.টি অর্থাৎ রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তা এস আর খানের বাসায়। সেই সুবাদে মহকুমা প্রশাসকের সাথে এ সম্পর্কে এস আর খান আলাপ করার সময় তার ভাগিনা কক্সবাজার ইংরেজি উচ্চ বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণীর ছাত্র খালেদ মোশাররফ (পরবর্তীতে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার, কে ফোর্সের অধিনায়ক এবং স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের সেনা প্রধান) শুনে ফেলেন। তিনি যথারিতি ২২ ফেব্র“য়ারি শুক্রবার (ওই সময় সাপ্তাহিক ছুটি ছিল রবিবার) স্কুলে গিয়ে তার সহপাঠী ও স্কুলের ছাত্রদের জানালে ছাত্রদের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। সকাল ১০টার দিকে খালেদ মোশাররফ ও একই ক্লাসের ছাত্র আবদুল মাবুদ এখলাসী ও নুরুল হুদা হুদা চৌধুরী এর নেতৃত্বে ছাত্ররা ক্লাস বর্জন করে নিহত ও রাষ্ট্রীয় জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। ১০ম শ্রেণীর ছাত্র আবুল মাবুদ এখলাছী নিজের হাতে স্কুলের ঘন্টা বাজিয়ে স্কুল ছুটি ঘোষণা করে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে মিছিলরত ঢাকায় ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে মিছিলে অংশ গ্রহণ করার আহ্বান জানান। এ সময় ছাত্ররা দুটি ভাগে হয়ে মিছিল সহকারে কক্সবাজার শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে বাহারছড়ায় গিয়ে জনসভা করে। একটি ভাগের নেতৃত্ব দেন দিন খালেদ মোশাররফ। খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে মিছিলে অংশ নেন নুরুল হুদা চৌধুরী (বদরমোকাম, ওই সময়ে ৮ম শ্রেণীর ছাত্র), আকতারুজ্জামান চৌধুরী (তৎকালিন মহকুমা প্রশাসক মৌলভী গফুরুজ্জামান চৌধুরীর ছেলে), আবদুল মাবুদ এখলাসী (চট্টগ্রাম জেলা ও দায়রা জজ আদালত ও কক্সবাজার মহকুমা আদালতের আইনজীবী মৌলভী এখলাছুর রহমানের ছেলে), শামসুল হুদা (ঝিলংজা), ওসমান গণি (মহেশখালী), নুরুল আজিম চৌধুরী (ধলিরছড়া, পরবর্তীতে ইউপি চেয়ারম্যান), ছালেহ আহমদ, বাদশা মিয়া চৌধুরী, জালাল আহমদ (নতুন বাহারছড়া), আবদুর রহমান (টেকপাড়া), নুর আহমদ (এডভোকেট, প্রথম কক্সবাজারের ইতিাস রচয়িতা), টেকপাড়ার কামাল উদ্দিন (সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এডভোকেট আবুল কালাম আজাদ এর বড় ভাই), প্রভাস রক্ষিত, নিখিলেশ্বর চক্রবর্তী (অগ্নিযুগের বিপ্লবী জ্যোতিশ্বর চক্রবর্তীর ছেলে এবং চট্টগ্রাম ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমনের নেতৃত্বকারী শহীদ শৈলেশ্বর চক্রবর্তীর ভাইপো, বর্তমানে লন্ডন প্রবাসী), নাসির উদ্দিন (তৎকালিন কক্সবাজার রেঞ্জ অফিসারের ছেলে) প্রমুখ।
কক্সবাজার হাই স্কুলের ছাত্র সালামত উল্লাহ (এডভোকেট) ও আমিরুল কবির চৌধুরীর নেতৃত্বে ১৫০-২০০ জন ছাত্রের অপর দলটি দক্ষিণ বাহারছড়া হয়ে প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ এবং পথে সভার আয়োজন করে। এ মিছিল ও সমাবেশে আবদুল কাদের (পরবর্তীতে ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক), মোহাম্মদ মুসলিম (ইপিআর-বিডিআর), আবুল কাসেম (পরবর্তীতে লাইন্সম্যান), জয়নাল আবেদিন (বাহারছড়া), সগীর আহমদ (নুনিয়ারছড়া), মোজাম্মেল হক (খুরস্কুল), ওয়াহিদুল আলম (টেকপাড়া), মোস্তাক আহমদ (টেকপাড়া), গোলাম আহমদ (বাহারছড়া), আলতাজ আহমদ(কস্তুরাঘাট)সহ আরো অনেকে অংশ নেন।১৪
খালেদ মোশাররফ এর নেতৃত্বে ২০-৩০ জন ছাত্রের এ দলটি একটি মিছিল নিয়ে বাহারছড়ায় গিয়ে সালামত উল্লাহ ও আমিরুল কবির চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন সভায় মিলিত হন। তাঁরা সি.এ্যান্ড. বি.এর জনৈক ঠিকাদারকে একটি ট্রাক যোগাড় করে দেয়ার অনুরোধ করলে তিনি একটি ট্রাক যোগাড় করে দেন। এই ট্রাক নিয়ে ছাত্ররা ‘রক্তের বদলা রক্ত চাই’, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘ছাত্রহত্যার বিচার চাই’ প্রভৃতি শ্লোগান সহকারে কক্সবাজার শহরে প্রদক্ষিণ করার পর রামু, ঈদগাঁও হয়ে চকরিয়া পর্যন্ত যান এবং সন্ধ্যায় পুনরায় কক্সবাজারে ফিরে আসেন। তৎকালিন মহকুমা প্রশাসক মৌলভী গফরুজ্জামান চৌধুরী রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষ থাকায় ওই সকল মিছিল ও সমাবেশে পুলিশ তথা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোন প্রকার বাঁধ দেয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন এডভোকেট সালামত উল্লাহ ও ক্রীড়াবিদ নুরুল হুদা চৌধুরী।
পরদিন ২৩ ফেব্র“য়ারি খুনী নুরুল আমিনের বিচার চাই, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’সহ বিভিন্ন শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত করে কক্সবাজার শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ পূর্বক কক্সবাজার পাবলিক লাইব্রেরীতে এক জনসভায় মিলিত হন। খালেদ মোশাররফের আত্মীয় আইয়ুব আলীর সভাপতিত্বে প্রতিবাদ সমাবেশে বক্তব্য রাখেন ১০ম শ্রেনীর ছাত্র খালেদ মোশাররফ, আবদুল মাবুদ এখলাছি, আকতারুজ্জামান চৌধুরী, কামাল উদ্দিন, ৮ম শ্রেণীর ছাত্র আমিরুল কবির চৌধুরী, নুরুল হুদা চৌধুরী, নুরুল আজিম চৌধুরী (ধলিরছড়া, পরবর্তীতে ইউপি চেয়ারম্যান), আবদুল কাদের (পরবর্তীতে ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক), সালামত উল্লাহ (এডভোকেট), ছালেহ আহমদ চৌধুরী, আবদুর রহমান (টেকপাড়া), নিখিলেশ্বর চক্রবতী, শামসুল হুদা (ঝিলংজা), ওসমান গণি (মহেশখালী), আবুল কাসেম, নুনিয়াছড়ার সগীর আহমদ, বাহারছড়ার জয়নাল আবেদিন (পরবর্তীতে ব্যাংকার) প্রমুখ। ১৫ -
২১ ও ২২ ফেব্র“য়ারি রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকারীদের উপর পুলিশের গুলি এবং ছাত্রহত্যা ও রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে চকরিয়া হাই স্কুলের ছাত্র এস কে শামসুল হুদা, আবদুল মালেক (পরবর্তীতে আবদুল মালেক মাস্টার নামে পরিচিত), জামাল উদ্দিন আহমদ (পরবর্তীতে ডা. জামাল উদ্দিন আহমদ নামে পরিচিত), নজির আহমদ (পরবর্তীতে বাসস এর প্রধান বার্তা সম্পাদক) এর নেতৃত্বে ক্লাস বর্জনপূর্বক মিছিলে বের হয়।১৬ মিছিলে শত শত ছাত্র-জনতার সমাবেশ হয়।
ঢাকায় ভাষা আন্দোলনের মিছিলে গুলি, ছাত্র হত্যার খবরটি রামুতে পৌঁছে ২৩ ফেব্র“য়ারি। রামু খিজারী হাই স্কুলের অস্টম শ্রেণীর ছাত্র প্রতিনিধি মোশতাক আহমদ (প্রফেসর) এর নিকট চিঠি দেন কক্সবাজারের সালামত উল্লাহ ও আমিরুল কবির চৌধুরী।১৭ চিঠির নির্দেশক্রমে মোশতাক আহমদ নুরুল ইসলাম হেলালী, ওসমান সরওয়ার আলম চৌধুরী, মনির আহমদ, মন্মথ কুমার বড়–য়া ( পরবর্তীতে বৌদ্ধ নেতা ও সাংবাদিক), নিউথু মং, থাংলাগ্য, জাকের আহমদ প্রমুখরা তৎক্ষনাৎ ক্লাস বর্জনপূর্বক স্কুল প্রাঙ্গন থেকে এক জঙ্গী মিছিল শুরু করে রামুর চৌমুহনীতে গিয়ে জন সমাবেশে মিলিত হয়। ওই মিছিলে ১৫০-২০০ ছাত্রসহ অসংখ্য জনতা অংশ নেন বলে এক ব্যক্তিগত সাক্ষাতকারে জানিয়েছেন প্রফেসর মোশতাক আহমদ।
২৪ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নটি অমিমাংসিত রেখে পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থা পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করে ফের পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে বক্তব্য এবং ২৫ ফেব্র“য়ারি সোমবার পুলিশ জন নিরাপত্তা আইনে এমএলএ মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ, খয়রাত হোসেন, গোবিন্দ লাল ব্যানার্জি, মনোরঞ্জন ধর, অবিভক্ত বাংলার মুসলীম লীগের শেষ সাধারণ সম্পাদক, খেলাফত রাব্বানী পার্টির আবুল হাশিম, হামিদুল হক চৌধুরীসহ আটকজনকে গ্রেফতার করার পর সারাদেশ উত্তাল হয়ে উঠে। সারাদেশের ন্যায় ২৪ ফেব্র“য়ারি ও ২৫ ফেব্র“য়ারি কক্সবাজারের সর্বত্র হরতাল পালিত হয়। ২৫ ফেব্র“য়ারি বিকালে কক্সবাজারে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে আরো জোরদার করতে ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে তথা ১৯৪৮ সালের ৬ জানুয়ারি বাংলার দাবীতে সরকারী থেকে পদত্যাগকৃত অধ্যাপক ও সাবেক ডাকসু ভিপি ফরিদ আহমদ এর নেতৃত্বে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় অগ্নিযুগের বিপ্লবী সুরেশ চন্দ্র সেন, জ্যোতিশ্বর চক্রবর্তী প্রমুখের উপস্থিতিতে ২৭ ফেব্রুয়ারি রুমালিয়ারছড়া এক জন সমাবেশের সিদ্ধান্ত এবং সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কমিটি আহুত ৫ মার্চ শহীদ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। সিদ্ধান্ত মোতাবেক ৫ মার্চের জনসভা সফল করতে খালেদ মোশাররফ, পাকিস্তান ন্যাশনাল গার্ড সালারে আওয়াল আবদুল হামিদ খান, আফসার কামাল চৌধুরী, আমিরুল কবির চৌধুরী, নুরুল হুদা চৌধুরীসহ ছাত্র জনতা ব্যাপক প্রচারণা চালায়। রামুতে মিছিলোত্তর এক জনসভা হয়। আওয়ামী মুসলিম লীগ নেতা আফসার কামাল চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় জাকের আহমদ, মোশতাক আহমদ, ওসমান সরওয়ার আলম চৌধুরী, মন্মথ বড়–য়া, মনির আহমদ, নিউথু মং, থাংলাগ্য, আবুল কাশেম, গর্জনিয়ার রশিদ আহমদ চৌধুরী প্রমুখ বক্তব্য রাখেন এবং সভায় অচিরেই ছাত্র হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী উত্থাপিত হয়।
২৭ ফেব্র“য়ারি রুমালিয়ারছড়ায় ফরিদ আহমদ (পরবর্তীতে মৌলভী ফরিদ আহমদ নামে পরিচিত, ওই সময় ফরিদ আহমদ কক্সবাজার কোর্টে ওকালতি করতেন) এর সভাপতিত্বে এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে খালেদ মোশাররফ, আবদুল মাবুদ এখলাছি, আমিরুল কবির চৌধুরী, সালামত উল্লাহ, নুরুল আজিম চৌধুরী, সিরাজ আহমদ, নুরুল হুদা চৌধুরীর নেতৃত্বে মিছিল নিয়ে রুমালিয়ারছড়াস্থ জনসভায় অংশ নেন। সভায় বক্তব্য রাখেন এডভোকেট সুরেশ সেন, এডভোকেট জ্যোতিশ্বর চক্রবর্তী, ক্রীড়াবিদ বদিউল আলম প্রকাশ বদু মাস্টার, সিরাজ আহমদ, ওবাইদুল হাকিম, অমরেন্দু মজুমদার, মনতোষ কুমার চৌধুরী, এডভোকেট মোহাম্মদ আলী প্রমুখ।১৮ ওই সভা থেকে মিছিল সহকারে রামু চৌমুহনীতে জন সমাবেশে গিয়ে মিলিত হন।
ঢাকা সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির ডাকা ৫ মার্চ শহীদ দিবস সারাদেশের ন্যায় কক্সবাজারে পালিত হয়। ভাষা আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে খতমে কোরআন, ছাত্র ধর্মঘট, সব দোকান পাট বন্ধ, কোর্ট-অফিস বন্ধ ছিল সেই দিন। কক্সবাজার হাই স্কুল, চকরিয়া হাই স্কুল, রামু খিজারী স্কুলসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রধর্মঘট পালনের পাশাপাশি রাষ্ট্রভাষার দাবীতে মিছিল করে। কক্সবাজার শহরে কাছারী পাহাড়ে ১৯৩০ সালে সংঘটিত চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ ও জালালাবাদ যুদ্ধের সাহসী সৈনিক সুরেশ সেন, মৌলভী ফরিদ আহমদ, আয়ুব আলী, বদিউল আলম প্রকাশ বদু মাস্টারের পরামর্শে ছাত্র নেতা খালেদ মোশাররফ, আবদুল মাবুদ এখলাছি, আমিরুল কবির চৌধুরী এর নেতৃত্ব এক জঙ্গি মিছিল নিয়ে কাছারী পাহাড়ে হাজারো ছাত্র জনতার সমাবেশ হয়। ওই সমাবেশে সরকারী দমন পীড়নের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিবাদ জানোনা হয়। মো. আইয়ুব আলীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সমাবেশে বক্তব্য রাখেন জ্যোতিশ্বর চক্রবর্তী, সুরেশ সেন, ফরিদ আহমদ, ওবাইদুল হাকিম, খালেদ মোশাররফ, আবদুল হামিদ খান, আবদুল মাবুদ এখলাছী, সগীর আহমদ, জয়নাল আবেদীন, নুরুল আজিম চৌধুরী, আবুল কাশেম প্রমুখ। সভায় প্রদেশের অফিস আদালতের ভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ, গুলিবর্ষনের দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বিচার এবং ভাষা আন্দোলনে ধৃত ব্যক্তিদের মুক্তির দাবী করা হয়। এবং সভা শেষে কক্সবাজার কাছারী পাহাড় থেকে কস্তুরাঘাট, কাছারী পাহাড় থেকে বাজারঘাটা, বাজারঘাটা থেকে সী-বিচ পর্যন্ত তিনটি সড়কের নাম সালাম, জাব্বার ও বরকতের নামে নামকরণ করা হয়েছিল বলে ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে কক্সবাজার’ নামক এক নিবন্ধে উল্লেখ করেন ভাষাসৈনিক বিচারপতি আমিরুল কবির চৌধুরী।
এছাড়া ঈদগাঁও উচ্চ বিদ্যালয়ের তৎকালিন প্রধান শিক্ষক পাকিস্তান আন্দোলনের অন্যতম নেতা আবদুল হামিদ খানের সহায়তায় ওই বিদ্যালয়ের ছাত্র প্রতিনিধি রাখাল ভট্টাচার্য, সুলতানুল আলম সিকদার, (পরবর্তীতে ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক), মনজুরুল ইসলাম চৌধুরী প্রকাশ লেদু মিয়ার নেতৃত্বে ্ঈদগাঁও হাই স্কুলে, এস কে শামসুল হুদা, জামাল উদ্দিন আহমদ ও আবদুল মালেক এর নেতৃত্বে চকরিয়া হাই স্কুল, কুতুবদিয়া ও টেকনাফে ভাষা আন্দোলনের প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে। এসব এলাকায় ভাষা আন্দোলনকারীদের মধ্যে কুতুবদিয়ার মো. রমিজ আহমদ (পরবর্তীতে ধুরং হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালীন কুতুবদিয়ায় সংঘটিত ঘটনায় পাকিস্তান সরকার কর্তৃক দায়েরকৃত রাষ্ট্রদ্রোহী মামলার ২০ নং আসামী), রফিক আহমদ চৌধুরী, টেকনাফের অবিনাশ চন্দ্র, বাবু মংনি, আবদুর রহমান, হাজী আবদুল গণি প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।১৯
তাছাড়া কক্সবাজারের কৃতিসন্তান ঢাকায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে প্রতিটি আন্দোলনে শরীক হন চকরিয়ার শাহাব উদ্দিন চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্রী মাহফিল আরা (তিনি অবিভক্ত বাঙলার জনস্বাস্থ্য ও স্থানীয় স্বায়ত্বশাসন বিষয়ক মন্ত্রী খান বাহাদুর জালাল উদ্দিন আহমদ চৌধুরীর ভাই কবির উদ্দিন চৌধুরীর মেয়ে), ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র মো. বদরুজ্জামান (যার নেতৃত্বে ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনে রামুতে জনসভা এবং মিছিল সমাবেশ হয়)।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে কক্সবাজারের মতো মফস্বল এলাকার অবদান গৌরবদীপ্ত। কক্সবাজারের আন্দোলন ঢাকা-চট্টগ্রামের মতো সহিংস না হলেও তা ছিল যথেষ্ট্ সু সংগঠিত ও জনসমর্থিত। ভাষা আন্দোলনের সে উত্তাল দিনগুলোতে কক্সবাজারের ভূমিকাকে আঞ্চলিকতার দোহাই দিয়ে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। কারণ চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার আক্রমণ, জালালাবাদ যুদ্ধে অংশ তথা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম দুই বিপ্লবী এডভোকেট সুরেশ চন্দ্র সেন, জ্যোতিশ্বর চক্রবর্তী এবং ভাষা আন্দোলনের পক্ষে প্রথম সরকারী চাকুরীতে পদত্যাগকারী অধ্যাপক মৌলভী ফরিদ আহমদ কক্সবাজারের সন্তান ছিলেন এবং ভাষা আন্দোলনে শরীক হয়েছেন। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের পর ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান সরকার বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেয়। রাষ্ট্রভাষা বাংলাকে স্বীকৃত আদায়কারীর অন্যতম জাতীয় পরিষদ সদস্য ছিলেন মৌলভী ফরিদ আহমদ।
আমাদের মানতেই হবে ভাষা আন্দোলনের মহান সৈনিকরা ভাষার মর্যাদা বা সম্মান প্রতিষ্ঠা করলেও তাদের প্রকত উদ্দেশ্য আজো বাস্তবায়িত হয়নি। তাদের উদ্দেশ্য শুধু বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠা ছিল না। ছিল এ ভাষাকেন্দ্রিক সংস্কৃতি ও জীবন ধারার বিকাশও অবশ্যই। যতদিন না বাংলা সংস্কৃতি আর বাঙালির জীবনধারা শতদলে বিকশিত না হচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত মহান ভাষাসৈনিকদের মর্যাদাও প্রতিষ্ঠিত হবে না, অন্তত পরিপূর্ণরূপে।


ঋণী
১. ড.সাইফুদ্দীন চৌধুরী, বাঙালি মুসলমানের বাংলা ভাষা চর্চা, শেখ তোফাজ্জ্বল হোসেন সম্পাদিত ‘বাংলা ভাষায় মুসলমানদের অবদান’, ঢাকা: ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, অক্টোবর ২০০৩, পৃ: ১৪২।
২. সত্যেন সেন, বৃটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলমানদের ভূমিকা, ঢাকা : সাহিত্য প্রকাশনালয় এর তৃতীয় প্রকাশ-মার্চ ২০১১, পৃ : ৫৩
৩. প্রভাত মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্র বর্ষপঞ্জী, কলকাতা, ১৯৬৮, পৃ : ৭৮।
৪. অধ্যাপক আবদুর গফুর, বাংলা ভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠাতায মুসলমান, শেখ তোফাজ্জ্বল হোসেন সম্পাদিত ‘বাংলা ভাষায় মুসলমানদের অবদান’, ঢাকা: ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, অক্টোবর ২০০৩, পৃ: ৯১-৯২।
৫. ড. আনিসুজ্জামান, বাঙলা ভাষা ও বাঙলাদেশ, উদ্ধৃতি: ‘একুশের প্রবন্ধ,’ ঢাকা: বাংলা একাডেমী, ফেব্র“য়ারি ১৯৮৫, পৃ: ১১।
৬. ড. আসকার ইবনে শাইখ, বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম, অধ্যাপক কাযী আযিযউদ্দিন আহমদ সম্পাদিত ‘প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম স্মারকগ্রন্থ’, সেপ্টেম্বর ১৯৯১, চট্টগ্রাম: প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম গণস্মরণ সভা কমিটি, পৃষ্টার নম্বর উল্লেখ নাই।
৭. মোস্তফা কামাল, ‘ভাষা আন্দোলন: সাতচল্লিশ থেকে বায়ান্ন’, দ্বিতীয় প্রকাশ ফেব্র“য়ারি ১৯৯৭, চট্টগ্রাম: বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি লি. পৃ:১৪
৮. বশীর আল হেলাল, ‘ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস’, ফেব্র“য়ারি ১৯৮৫, ঢাকা: বাংলা একাডেমী, পৃ: ১৮৯-৯১।
৯. বদরুদ্দীন উমর, আমাদের ভাষার লড়াই, টাপুর টুপুর গ্রন্থমালা-১, দ্বিতীয় প্রকাশ-মাঘ ১৩৯৫, চট্টগ্রাম: শিশু সাহিত্য বিতান, পৃ: ৩১-৩২।
১০. শরীফ শমশির, চট্টগ্রামে ভাষা আন্দোলন, আগস্ট ২০০৩, ঢাকা: আগামী প্রকাশনী, পৃ: ২০
১১. বিচারপতি আমিরুল কবির চৌধুরী, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে কক্সবাজার, ২১ ফেব্র“য়ারি ২০১১, দৈনিক ইনানী।
১২. সূত্র:- সৈনিক, ৩ ফেব্র“য়ারি ১৯৫২, উদ্ধৃতি: নুরুল ইসলাম, ‘সে আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে’ ঢাকা: বাংলা একাডেমী, জুন ১৯৯০, পৃ:১
১৩. সূত্র: আজাদ, ২১ ফেব্র“য়ারি ১৯৫২, উদ্ধৃতি: নুরুল ইসলাম, ‘সে আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে’, ঢাকা: বাংলা একাডেমী, জুন ১৯৯০, পৃ: ৪
১৪. শরীফ শমশির, ‘চট্টগ্রামে ভাষা আন্দোলন’, আগস্ট ২০০৩, ঢাকা: আগামী প্রকাশনী, পৃ: ৫২
১৫. বিচারপতি আমিরুল কবির চৌধুরী, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে কক্সবাজার, ২১ ফেব্র“য়ারি ২০১১, দৈনিক ইনানী।
১৬. ডা. মাহফুজুর রহমান, ‘বাঙালির জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম’, মার্চ ১৯৯৩, চট্টগ্রাম: বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে গবেষণা কেন্দ্র, পৃ: ২০২।
১৭. ব্যক্তিগত সাক্ষাতকার, প্রফেসর মোশতাক আহমদ, ১২ ফেব্র“য়ারি ২০১০, রামু, কক্সবাজার।
১৮. বদিউল আলম, কক্সবাজারের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বিকাশ, সাগর তীরে, ১৫ জুলাই ২০০৭, রামু: রম্য প্রকাশন, পৃ: ১৭-১৮।
১৯. শরীফ শমশির, চট্টগ্রামে ভাষা আন্দোলন, আগস্ট ২০০৩, ঢাকা: আগামী প্রকাশনী, পৃ: ৫২


এ রচনাটি ‘মুক্তিসংগ্রামে কক্সবাজার’ র্শীষক গবেষণাকর্ম থেকে সংকলিত। এ রচনায় কোন তথ্যগত ভুল কিংবা বাদ পড়ে থাকলে ০১৮১৪৪৯৫৪৬৬ ফোন নাম্বারে জানানোর জন্য অনুরোধ করা হয়।


কালাম আজাদ : লেখক/সাংবাদিক, হাতফোন-০১৮১৪৪৯৫৪৬৬