দশক বিচার একজন কবির সময়কাল নির্ধারণের অন্যতম পন্থা। এর মাধ্যমে কবি কিংবা শিল্পী তাঁর কর্মে কালকে ধরে রাখার প্রয়াস পান। বাংলা কবিতায় দশক বিচারের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় রবীন্দ্রনাথের পর থেকে। কবিতায় তাঁর অভিযাত্রা ছিলো দীর্ঘকাল ব্যাপী। তাঁর নৈপূণ্য এবং কুশলতা কোন নির্দিষ্ট সময় বা দশকের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো না। তিনি ছিলেন সর্বকালীন শাশ্বত প্রবাহের সাক্ষী। অনেক ক্ষেত্রে সময় এবং প্রবাহেরও অগ্রগামী। রবীন্দ্র পরবর্তী তিরিশের দশক থেকে দশক গণনা শুরু হয়। দশক বিচারে কবি মজিদ মাহমুদ আশির দশকের কবি। মজিদ মাহমুদ আশির দশকের সেই শক্তিনাম কবি যার নির্বাচিত কবিতা সংকলন বেরুল একবিংশ শতাব্দীর একুশে বইমেলা ২০০৮। নির্বাচিত প্রকাশের সময়সূত্রেই নয়, বরং কবিতার আরো নানাক্ষেত্রে বৈশিষ্টতা, নিজস্বতা রয়েছে তাঁর কবিতায়। দূর থেকে আপন নিভৃতির জগতে বসে কবিতা লিখতে মগ্ন থেকেছেন। কোন উচ্চাকাংখার ধ্বজা উড়িয়ে নিজেকে শ্রী বর্ধিত করার মনোবাসনাকে ডানা মেলে উড়িয়ে দেন নি। সহজ সরল জীবনবোধের মূল্যায়নে কবিতাকলি পাঠকের কাছে সমাদৃত হোক এই কাম্য ভেবে কবিতা রচনা করে যান তিনি। স্ব-সৃষ্ট বলয়ের বাইরে দুঃসাহসিক অভিযাত্রীর দিকে তাঁর গতি নয়- তিনি সম্পূর্ণ আত্মমগ্নতায় একাগ্র থেকেছেন কবিতাকে ফলবতী করতে। ফলে বহু øিগ্ধ কবিতা নিজে তার কাছে ধরা দিয়েছে। ১৯৮৯ সালে প্রকাশিত “মাহফুজামঙ্গল” কাব্যগ্রন্থ থেকে শুরু করে ২০০৮ সালে প্রকাশিত “ধাত্রী ক্লিনিকের জন্ম” কাব্যগ্রন্থ থেকে কবিতা গ্রহণ করা হয়েছে। মজিদ মাহমুদের প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা ২৩টি (অবশ্য কাব্য গ্রন্থ ৫টি, কিশোর কবিতা ২টি, গবেষণাগ্রন্থ-৬টি, গল্প উপন্যাস-২টি)। এর মধ্যে পরিণত বয়সে লেখা “বল উপাখ্যান” (২০০০) গ্রন্থটি থেকে সবচেয়ে বেশী সংখ্যক কবিতা শ্রেষ্ঠ কবিতায় স্থান পেয়েছে। হয়তো এই গ্রন্থটি তাকে সবচেয়ে বেশী প্রস্ফুটিত করেছে। এ সময় নিমগ্নতার সবচেয়ে বেশী তৃপ্তিতে হয়তো ছিলেন বলেই এই গ্রন্থের প্রতি এমন পক্ষপাত ঘটিয়েছেন। এর সঠিক জবাব কবিই দিতে পারেন। তবে আমার মতে কবি মজিদ মাহমুদের “মাহফুজামঙ্গল”, “মাহফুজা মঙ্গল উত্তর খন্ড” থেকে কবি হিসাবে আলোড়িত হয়েছেন। তার “মাহফুজা মঙ্গল উত্তর খন্ড” তার একটি কবিতা আমাকে বেশী আলোড়িত করেছে। যা কবির কাছে এতকিছু থাকতে মাহফুজার কাছে কেন আশ্রয় চেয়েছেন তা জানতে ইচ্ছে হয়-
“মাহফুজা এবার আমি গ্রহণ করেছি শ্রমণ গোতম বোধিসত্ত্ব মহাস্থবির
মাহফুজা এবার আমি গ্রহণ করেছি প্রবুজিত ভিক্ষুসংঘ
মাহফুজা এবার আমি গ্রহণ করেছি ধর্মং শরণং গচ্ছামি;
মাহফুজা শরণং গচ্ছামি
নির্বাণ শরণং গচ্ছামি” (মাহফুজা শরণং গচ্ছামি, মজিদ মাহমুদের কবিতা- ৫৪)
প্রথম দিকের কাব্য রচনায় কবির রোমান্টিক মন পাখা মেলে দেওয়া বলাকার মতো উড়ে চলে নীড়ের সন্ধানে। এই উড়ে চলায় স্বপ্ন আছে, অন্বেষণ আছে। কবি তাই এক জায়গায় বলেন-
”তোমাকে দেখে আমার তৃপ্তি আসেনা মাহফুজা
তোমাকে ছুঁয়ে আমার তৃপ্তি আসে না
আবার তোমাকে না দেখলে, না ছুঁলে আমি এক
অন্ধকার অসীম শুণ্যতায় নিমজ্জিত হই
তোমাকে আমার দহনে নিয়ে আসি
তোমাকে নিয়ে আসি পরম শীতলতায়
আমার দহনে গলে পড়ে তোমার মন” (দাসের জীবন, মজিদ মাহমুদের কবিতা-৪৯)
“সমুদ্র দেখার পরে” কবিতায় সমুদ্র সম্পর্কে সহজ সত্যটি সহজতর ভাবে বলেছেন কবি-
“তোমার বুকের প্রাণহারী সব ঢেউ
লুটিয়ে পড়ছে আমার করতলে
চুম্বন তোমার ছুঁয়ে যাচ্ছে অশান্ত অম্বরে
আমি আবারও যাব তোমার জলযোনিতে মিশে
লক্ষ কোটি বছর ধরে এই জলাবর্ত শেষে
আমাকে মানব মাতৃগর্ভে দিও
মাুনষের মা’র জন্য আমার মায়া পড়ে আছে খুব।” (সমুদ্র দেখার পরে, মজিদ মাহমুদের কবিতা-৪৬)।
অন্য একটি কবিতায় অদ্ভুতলাগা একটি উচ্চারণ-
“যদিও ভালবাসাকে তুমি তোমার নিজের মতো
করেই ভালবাসো, তবু ভালবাসাই তোমার নিয়ন্তা
ভালবাসাই তোমার প্রভূ”। (ভালবাসা তোমার প্রভু, মজিদ মাহমুদের কবিতা-৩৮)
প্রেমের আকাংখা ব্যক্ত কত সহজ,
“ঈশ্বরকে ডাক দিলে মাহফুজা সামনে এসে দাঁড়ায়
আমি প্রার্থনার জন্য যতবার হাত তুলি সন্ধ্যা বা সকালে
সেই নারী এসে আমার হৃদয় মন তোলপাড় করে যায়। (কুরশি নামা, মজিদ মাহমুদের কবিতা-৪৭)
কী সুন্দর চিত্রকল্প! কী মধুর প্রেমের ধারা প্রবাহিত করেছেন তার কবিতায়, তা জানা আমার বিবেচ্য বিষয়।
রুপ আবেগের কারুকার্যের থেকে অনুভূতির সুক্ষ্মচারিতার কবিতার মন্থন ভালবেসেছেন, শ্রুতিশুভগ না হয়েও অন্তঃকরণে ধ্বনিত ও প্রতিধ্বনিত হওয়াতেই তাঁর কবিতায় যথার্থ মুক্তি। তাঁর বয়ানের থেকেও বেশী উচ্চারণের সমগ্রতায় এমনি করে সম্যক পূর্ণ। তাই আনুষ্ঠানিক ছন্দে ও স্পন্দে অধিকার স্থাপন করেও সে বিষয়ে তাঁর হেলাফেলা। জীবন থেকে উৎসারিত এই মুক্ত ছন্দ কথোপকথনের প্রত্যক্ষতায় ও সারল্য। কবির ভাষায়-
“আমার তো বান্ধবী ছিল না/আমার ছিল ইশ্বরী
আমি তার বুকের কাছে শুয়ে/মুখের কাছে থেকে
জেনেছিলাম জীবনের মানে” (আমার ছিল ইশ্বরী, মজিদ মাহমুদের কবিতা-৭)
মজিদ মাহমুদের কবিতায় পুরান ঐতিহ্য এবং পৌরাণিক আভাস পাওয়া যায়। যে পৌরাণিক থেকে নিজস্ব দর্শন দিয়ে পূর্ণ সৃষ্টির ছক মিলিয়ে তিনি ঢুকে পড়েন আধুনিক-ক্ষেত্র বিশেষে-আধূনিকোত্তর মনীষার শ্বাসমূলে। শাস্ত্র শব্দ তিনি ধর্মাঞ্চল বা উপকথার এলাকা থেকে আহরণ করেন সত্য কিন্তু শাস্ত্র কথায় ধর্মজাত কণ্ঠস্বর কখনো উচ্চারণ করতে দেখা যায়নি। এক দুর্লভ শাস্ত্র নিরপেক্ষ ধ্যানের নিমজ্জন তাঁর শিল্পভাষাতে আধ্যাত্মিকতার সারসত্যে প্রতিষ্ঠা করতে চায়, যা কাব্য পাঠককে এক নতুন সৃষ্টি প্রবাহে নিয়ে চলে-
“আমরা ছিলাম কবিতাতান্ত্রিক পরিবারের সন্তান
জলের যোনি থেকে উৎপন্ন হলেও/ক্যাসিওপিয়া আমার মা
ভূমিতে বিচরণশীল প্রাণীদের মধ্যে মানুষকেই
প্রথম বেছে নিয়েছিলাম
তখন হিমযুগ
পৃথিবীতে দারুণ শীত
মানুষ মাংসের ব্যবহার শেখেনি
সোনা মাছ তেরচা মাছ আর কাঁচা মাছ মাংস দিয়ে
উদর আর নাভিমূল পুরিয়েছে
মানুষ আজ যাকে সভ্যতা বলে জানে
তার নাম আগুন” (প্রমিথিউস,মজিদ মাহমুদের কবিতা-২২)।
দারুণ চিত্রকল্পের মাধ্যমে পৌরাণিক ইতিহাসকে তুলে ধরেছেন উপযুক্ত শব্দ দিয়ে।
প্রত্যেক ব্যক্তি এমন এক আলপিন, যা কৈশোর জীবন পার হতে হয়, তেমনি কবি মজিদ মাহমুদকেও তার কৈশোর জীবন পার হতে হয়েছে। কৈশোরের সরীসৃপ প্রাণীর মত বাঁচানোর স্মৃতি আজো ভূলতে পারে নি কবি-
“আমি যখন বুকে ভর দিয়ে প্রাণ ভয়ে দৌড়াচ্ছিলাম
তুমি তখন সরীসৃপ ছাড়া কিছু বলো নি
বুকের পাঁজর সংকোচন করে হাঁটতে বেশ কষ্ট হয়
সেই সাপ-জীবনের যন্ত্রণা এখনও আমি ভুলতে পারি নি” (সাপ, মজিদ মাহমুদের কবিতা-৩১)
সময় এবং সমাজের পরিবর্তমান প্রেক্ষাপটে মজিদ মাহমুদের শিল্পদৃষ্টির বিস্তৃতি ও বিকাশ বিবেচন যোগ্য। বৈজ্ঞাানিক জীবন জিজ্ঞাসা তাকে ফ্রয়েডীয় মনোবিকল তত্ত্বের অস্পষ্টতা থেকে মার্কসীয় দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদে স্পস্টতায় উত্তরণ ঘটিয়েছে তার বিভিন্ন কবিতা। মার্কসবাদীরা এখন হয়ে গেছে এন.জি.ও কর্মী, পেটি বুর্জোয়া, যারা প্রগতির নামে দলবদল করে ক্ষমতাসীন দলে নাম লিখায়। তারা মার্কসবাদের চেতনাকে ভুলে যায়। তার নিজস্ব শেলফের লাল বই ফুটপাতে আশ্রয় নেয়। মার্কসবাদীরা এখন বুর্জোয়াদের সাথে মিলিয়ে বুর্জোয়া রাইটিষ্ট। কবির ভাষায়-
“আমার মার্কসবাদী বন্ধুদের অনেকেই এখন এন.জি.ও কর্মী
কেউ দলবদল করে ক্ষমতাসীন দলে লিখিয়েছেন নাম
অনেকেই মোটা অঙ্কে বেতন পান। কেউ বাড়িগাড়িও করেছেন
খুব ভালো, তাদের জীবনে সত্যিই মার্কসবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে
ভালো থাকার জন্যই তো সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন
কিন্তু আমরা যারা তারুণ্যে মার্কসবাদ করিনি-
ওদের ভাষায়-‘বুর্জোয়া রাইটিস্ট-প্রগতি-বিরোধী!’
এখন তারাই প্রলেতারিয়েত (আমার মার্কসাবদী বন্ধুরা, মজিদ মাহমুদের কবিতা-৭৫)
মার্কসবাদীদের দৃষ্টিতে লাল বই মানেই বুদ্ধিজীবির ডায়েরী। এই লাল বই অনেকেই গোপনে পড়ে বুদ্ধিজীবী ও মার্কসবাদী বনে গেলেও বর্তমানে দলবদল করে নিজের স্বত্বাকে বিকিয়ে দিয়ে প্রগতির নামে দালালি করে। তাদের লাল বই এখন ফুটপাতের নিয়েছে আশ্রয়। কবির ভাষায়-
“লাল বই মানেই বুদ্ধিজীবীর ডায়েরী-
এখন গোপনে লালবই পড়ি। তবে সবই পুরনো
মার্কসবাদী বন্ধুদের শেলফ থেকে পরিত্যক্ত এসব বই ফুটপাতে নিয়েছে আশ্রয়
সোভিয়েত ভেঙ্গে গেছে
মাওসেতুংয়ের দেশে হয়েছে পুঁজির বিকাশ
রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা নেই, তাই বেওয়ারিশ
বই গুলো এখন ছিন্নভিন্ন প্রোলেতারিয়েত (আমার মার্কসাবদী বন্ধুরা, মজিদ মাহমুদের কবিতা-৭৫/৭৬)
তবে মাংসেতুংয়ের দেশে যে পুঁজির বিকাশ হয়েছে তা মানতে রাজী নয়। সে দেশে পুজির বিকাশ হয়েছে ঠিকই কিন্তু পুঁজিবাদী দেশের মতো ব্যক্তিমালিকানাধীন কোনো সম্পত্তি নেই।
বর্তমানে মার্কসবাদীরা এত সমস্যা বিদ্যমানসত্বেও মার্কসবাদ এখনো এক্যবদ্ধ শ্রমিকের হাত। যে হাত মালিককে যথেচ্ছা হাসতে বাধাঁ প্রদান করে। মার্কসবাদ মানে কারো কাছে মাথানত না করা- শির উঁচু করে সামনে এগিয়ে চলা। এর বাস্তব চিত্র ফূটে উঠেছে কবির কবিতায়-
“মার্কসবাদ মানে ঐক্যবদ্ধ শ্রমিকের হাত/মালিক যথেচ্ছা হাসতে পারে না/মার্কসবাদ মানে কারখানা আগলে থাকা/আইএমএফ, বিশ্বব্যাংকের বাণিজ্য প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া/মার্কসবাদ মানে মরার আগে হাত উত্তোলন করা।
মজিদ মাহমুদের কবিতায় ধর্মীয় মিথের সন্ধান পাওয়া যায়। যে ধর্মীয় মিথ বহু আগের হযরত নূহ (আঃ) এর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। যে পুত্র কানানের জন্য ইশ্বরের কাছে চরম পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়েছিল, সে পুরাণ ধর্মীয় মিথকে দারুণ শব্দ শিল্পের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন তার কবিতায়-“
কেনান! কেনান! বলে ঘুমের মধ্যে কেঁদে উঠে নূহু/প্রভূ! পুত্র ডুবে যায়
অবাধ্য! তবু সে পুত্র আমার
মানুষের পাশে থেকে করেছে বিদ্রোহ
সবাই জানে তোমার নৌকায় সে লেখায়নি নাম
তাই বলে তার ধান ডুবে যাবে
পর্বতের গোড়ালির মতো অহংকার নিয়ে জেগে আছে
মানব-সন্তান
একদিকে নবুয়ত অন্যদিকে পুত্রের মায়া (পুত্র ডুবে যাচ্ছে, মজিদ মাহমুদের কবিতা-১৩)
ধর্মীয় মিথকে ধারণ করে কবি মজিদ যে সব কবিতা লিখেছেন তার মধ্যে “বল উপাখ্যান”, “অব্যক্ত কান্নার গান”, “প্রমিথিউস”, “পরিপ্রেক্ষিত”, “আমার ছিল ইশ্বরী”, “কুরশিনামা”, “এবাদত”, মহাফুজাং শরণাং গচ্ছামি”, “কেয়ামত”, “মূর্তি-পূজক”, “কবরে শুইয়ে দেয়ার পর” ইত্যাদি’।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের মিথ তাঁর কবিতায় উপস্থিত। যে মিথ স্বাধীনতাকে অর্থবহ ও সর্বগ্রাহী করতে সাহায্য করে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে লাখো লাখো প্রাণ খুঁয়েছে, পঙ্গু হয়েছে হাজারো প্রাণ, মুক্তিযুদ্ধ ঝাঁপিয়ে পড়া এমন একজন মুক্তিযোদ্ধা যার পা খোঁয়া গেছে। সে এখন এক পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে চলে- হাজারো উদাহরণ এরকম রয়েছে। কবি মজিদ এমন এক মুক্তিযোদ্ধাকে চিনেন যে, তাঁর কবিতায় শব্দের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন-
“আমি এক মুক্তিযোদ্ধাকে চিনি
যুদ্ধে যার একটি পা খোঁয়া গেছে
এখন এক পায়ে লাফিয়ে চলে
আগে তাকে দেখলে কষ্ট হতো
আমাদের স্বাধীনতা তার একটি পা নিয়েছে
বর্তমানে সে পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা” (মুক্তিযোদ্ধা, মজিদ মাহমুদের কবিতা-৬৩)
এই সংকলনের বেশকিছু কবিতায় আমাদের অনেকের চেনা মজিদ মাহমুদকে অনেকটা অচেনা বলে মনে হয়। দুয়েকটি কবিতা ছাড়া বাকীসব কবিতায় আপাতগ্রাহ্য ব্যক্তিগত লিরিকের আঙ্গিকে। নির্দিষ্ট স্তবক বিভাজন ও অন্ত্য-মধ্যমিলযুক্ত নিরুপিত ছন্দের বিন্যাসে প্রত্যাশিত কারিগরী প্রযত্মে চিহ্নিত। তবু যেন শব্দের সঙ্গে শব্দ যোজনার খেয়ালী উপক্রমে বাচনরীতির উৎকেন্দ্রিকতার বহুলোভনীয় পংক্তির দুর্বোধ্যতাই থেকে যায় শব্দের সঙ্গে শব্দের। একটি পংক্তির সঙ্গে পরবতী পংক্তির উদ্ভুত বিবাহে কেবল ফুটেই উঠতে থাকে বিরল কৌতুকে তাঁর এই কাব্যগ্রন্থ মাহফুজা ও ঈশ্বর শব্দ ধারা বেশী আক্রান্ত হয়েছে।  
রুপকের ব্যবহার কবি মজিদের কবিতাকে বিশিষ্টতা দান করেছে। রূপকের সাহায্যে বিষয়বস্তুকে চিত্রিত করা কবিদের যেমন সহজাত বৈশিষ্ট্য তেমনি মজিদের বেলাও তাঁর কবিতায় প্রচুর রূপকের ছড়াছড়ি। যেমন- নদীর মধ্যে মহিষ, এখনো রাত এল জোৎøায়, কবি গেছে শেয়ার মার্কেটে, তোমার বাতাসকে, বাতাসের কণা, কোম্পানীর দিকে হেঁটে চলছি, ডিম পাড়া হয়ে গেছে শেষ, লিঙ্গ দেখবার মেশিন, পুতুল পূজক,  ইত্যাদি।
কবি মজিদ মাহমুদের কবিতায় কিছু কিছু অনুপ্রয়াসের ব্যবহারও লক্ষনীয়। যেমন- কোষে কোষে, হাঁটতে হাঁটতে, একে একে, চলতে চলতে, লেগে লেগে, বসে বসে, থৈ থৈ, প্রতিদিন, বলতে বলতে ইত্যাদি।
কবিতায় শব্দচয়নের দিকে কবি মজিদ বেশ যতœবান ছিলেন। তার শব্দ ভান্ডার বেশ সমৃদ্ধ। তার কবিতায় প্রচুর দেশি-বিদেশী, তদ্ভব শব্দের ব্যবহার লক্ষনীয়। যেমন- মেয়োসিস, কিশতি, লজ্জা, জারজ, হিস্যা, পিলসুজ, এস্কিমো ইত্যাদি।
নতুন প্রকরণ বা ছন্দ নয় বরং চেতনার বৈচিত্র পূর্ন বি¯তৃতি এ কাব্য প্রধান বৈশিষ্ট্য। চেতনার বিচিত্র মুখিতার কারণে কবিতাগুচ্ছ নতুন উপলব্ধির সামনে দাঁড় করায় পাঠককে যা আগে ছিল অনাস্বাদনীয়। গাছজীবন, পাগল, আপেল কাহিনী, বাতাসের ঘুর্ণাবর্ত, অন্ধকার, বাবা, বিদ্যাসাগরের মা ভগবতী দেবী, জাতক, ইলিশ, ফসল ফলানো গান, ঈশ্বর আমাকে বাঁচতে দেয়নি, ঝরাপাতা, দাত্রী ক্লিনিকের জন্ম, পিতা-মাতার অপরাধে, দাসের জীবন, হারানো গল্প, মাছের পোনা, মাহফুজা শরণাং গচ্ছামি ইত্যাদি কবিতায় আমরা সেই অনাস্বাদনীয় কাব্যরোধ ও কাব্যসাধ খুজে পাই। এই কবিতাগুলো যেন একই কাব্যের বিভিন্ন স্বর্গ, অস্তিত্ব, চেতনা ও অন্তর্গত দ্রোহ-যন্ত্রণা ও স্বপ্নবুননই এসব কবিতার প্রধান সুর।
পরিশেষে বলা যায়, অর্ন্তলোকের অভিসারী কবি মজিদ উজ্জ্বল পংক্তি দ্বারা তাঁর কাব্যরসকে এ কাব্যগ্রন্থে একত্রিত করেছেন। দার্শনিক আভায় পরিস্ফুট এ গ্রন্থকে কবির অস্তিত্বের সত্তার ব্যক্তিগত শৈল্পিক নোটবুক বললেও অত্যুক্তি হবে না এবং সর্বশেষ দুর্দান্ত প্রচ্ছদের জন্য ধ্রুব এষ এবং ভিন্ন ধর্মী কাগজ ও সুশোভিত প্রকাশনা মানের জন্য কাঁটা চামচ প্রকাশন (ঢাকা) কে অজস্র ধন্যবাদ জানাই।
মজিদ মাহমুদের কবিতা। প্রকাশক- ফারহান ইশরাক, সুজন সাইফ, কাঁটাচামচ প্রকাশন-ঢাকা। প্রচ্ছদ- ধ্রুব এষ, প্রকাশকাল- একুশে বইমেলা ২০০৮ইং। পৃষ্টা সংখ্যা- ৮০, দাম- ১০০ টাকা।
                                                                                                                                                             রচনাকাল: ২০ অক্টোবর ২০১0, কক্সবাজার