যমুনায় জল ভরিবার পথে সখীগনের সহিত রাধারাণী কলকাকলিতে রত।  এমত সময় দূর হইতে বাঁশির সুরে যমুনা উতল হইল, ভুবন মাতাল হইল আর আমাদের রাধারাণী ব্যাকুল হইয়া সখীদের উদ্দেশ্যে বলিলেন,


"সখী অমন মধুর সুরে বাঁশি
আমার প্রাণে বাজে আসি
কে যে বাজায় দিবানিশি
দোহাই মরে বল না।


যমুনায় জল আনার সনে
পথ ভুলে যাই নিজের  মনে
মনটা আমার বাঁশীর টানে
হয়ে ওঠে আনমনা।


কলসিতে জল ভরার ছলে
আপন বদন হেরি নদীর জলে,
মন  হারায় কোন অচিন কুলে -
কলসি করে ঠনঠণা।


রেতের বেলা ঘুমাতে নারি,
বাঁশীর জ্বালায় জ্বলে মরি
রাত জাগিয়া কালো করি
আমার চোখের দুইকণা।


বল দেখি সে কোথায় থাকে,
সবাই তারে কি নামে ডাকে
কোথায় কোন গাছের ফাঁকে
বাজায় বাঁশী আনমনা"।


শুনিয়া সখীগণ মুখ টিপিয়া হাসে, অলক্ষ্যে ইঙ্গিত হানে ভ্রুর পাশে, বলে,


"একি আজ হলো রে -
মোদের রাই গরবিনীর
একি আজ হলো রে -
নিঁদ নাই আঁখির পরে
একি আজ হলো রে -
বাঁশীর ডাকে মন হরে
একি আজ হলো রে -
লাজে রাঙ্গা বরণ ধরে
একি আজ হলো রে -
দেখো কপট রাগ করে
একি আজ হলো রে"।


শুনিয়া রাধারাণী উষ্মা প্রকাশ করিয়া কহেন,


"থাক থাক মোর ঘাট হয়েছে
তিল থেকে ওরা তাল করেছে
সখী যাহারা ছিল আমার
শত্রু সনে সাট করেছে"।


জনৈক সখী (পুনঃ মুখ টিপিয়া হাসিয়া) বলে,


"মাপ কর হে রাধারাই
হাসিয়া মোদের ভুল হয়েছে,
বুঝিতে মোরা পারি নাই
সকলে কি কইতে কি কয়েছে,
বাঁশি হাতে কতজনাই
বাজাতে যে শিখিয়াছে
তোমার বাঁশির খবর পাই
এখন বল কাহার কাছে"?


রাধারাণী (পুনরায় উষ্মার সহিত) -
"খবর আমার চাইনা কিছু
যা না তোরা হটে পিছু
কাজের সময় নানা ছুতোয়
ভন্ড করিস সবকিছু"।


দুঃখিত হৃদয়ে সখীগণ সমস্বরে বলে,


"চল চল সবে আমরা যাই
দেমাকে ভারী হয়েছেন রাই,
নাই বা রইলো ধনৈশ্বর্য্য
তা বলে কি মদের সম্মান নাই !
এবার শত চোখের জলেও
মোদের কিন্তু পাইবে না ভাই"।


রাধারাণী শশব্যস্ত হইয়া কহেন -


"ভুলে যা ভাই ভুলে যা -
যাহা কিছু কইনু তোদের
ভুলে যা ভাই ভুলে যা -
দুটি পায়ে ধরি তোদের
ভুলে যা ভাই ভুলে যা" -


পুণরায় -


"মোর মাথার কি ঠিক আছে কিছু?
না ভাবি তাই আগু-পিছু,
ওরে তোদের ছাড়া কি হবে তা
ভাবিয়া না পাই কিছু"।


সখিগণের ক্ষোভ প্রশমিত হইলে একজন শ্রীরাধিকার সম্মুখে যাইয়া বলে -


"শুন শুন রাধারাণী শুন দিয়া মন,
বাঁশির কথা যা জানি তা করি বরণন -
কালো বরণ কৃষ্ণ নামে একজনারে চিনি
নন্দ গোয়ালার পুত বলেই তারে জানি,
মাঠে-ঘাটে ঘুরে ফিরে গোচারণের ক্ষণে
কদমতলায় বাজায় বাঁশি বসে একমনে,
যদি তুমি তাহার কথাই বলিবারে চাও
যমুনাতীরে উত্তরপানে দেখো যদি পাও"।


এই বলিয়া সখীসকল বিদায় লইতে উদ্যত হয়, সেই দেখিয়া রাধারাণী বলিয়া উঠেন,


"দেখিতে আমার বয়ে গেছে
কাজের কি মোর শেষ আছে !
যার বিশ গন্ডা চাকর-বাকর
সে যাবে কি রাখালের পিছে" !


সখীগণ প্রস্থান করিল।  এখন রাধারাণী একাকী।


আখর :


'সখীগণ গেল চলি কার কথা বলিয়া
বাঁশির মত নামটিও যায় মরমে গাঁথিয়া
যেন কত জনম ধরি সেই নাম শুনিছে
শ্রবণে প্রবেশিয়া অঙ্গ অবশ করিছে
অবিরাম ধারা বহে তাহার দুনয়নে
মন জপে কৃষ্ণ নাম বিবশ বদনে
সারা তনুময় শিহরণ, নয়ন মুদিল,
এরপরেতেই জ্ঞান হারাইয়া ভূতলে পড়িল'।


(প্রথম অঙ্ক সমাপ্ত)