অপরদিকে -


আখর:


          কালাশ্যামের আজ হলো কি !
মন নাই বাঁশির পরে -
          কালাশ্যামের আজ হলো কি !
ছন্দ কাটে বাঁশির সুরে -
          কালাশ্যামের আজ হলো কি !
মন উতলা বেড়ায় ঘুরে -
          কালাশ্যামের আজ হলো কি !
কারে যেন খুঁজে মরে -
          কালাশ্যামের আজ হলো কি !


নিজের এই অবস্থা দেখিয়া মুকুন্দবিহারী নিজেই হতবাক হইয়া ভাবিতে থাকেন, "আজ কি এমন হইল?", মনে সদুত্তর না পাইয়া প্রাণপ্রিয় শুক পক্ষীকে প্রশ্ন করেন -


"বল ওরে শুক পাখী          কেমন তুমি জানো দেখি
          আজ কেন হইছে এমন?
বাঁশির পরে নাই মন       কথা ব্রজ বৃন্দাবন
          দিবাস্বপ্ন দেখিছি যেমন,
মনে লাগে শিহরণ          জানিনা তাহার কারণ
          আগে কভু হয়নি এমন
সে অদ্ভূত সুখানুভূতি         কেমন ধারা আকুতি
          বিবশ করে রাখে মন
মনে মোর শান্তি নাই          অকারণে দুঃখ পাই
          কিবা বলো তাহার কারণ?"


শুক উত্তর করে, -


"সকলই জানিবে প্রভু          অজানা কি রবে কভু
          তুমি স্বামী জগতের নাথ
নিজে রচ মায়াজাল           কে তাহার ধরিবে হাল
          বাঁধি-খুলে তুমি দাও গাঁঠ।
নিত্য নিত্য তব লীলা          যুগে যুগে এই খেলা
          ভক্তিভরে করিয়া দরশন
ছিল পাপী-তাপী যারা          অচিরে তরালো তারা
          ঘুচিল এই মায়া আবরণ।
এই যুগে এই ক্ষণে          তব নিকুঞ্জবনে
          লীলা-পালা আজি ঘটিবে,
সেই পালা নিরখি          শুক-সারী দুই পক্ষী
          তব লোকে স্থান লভিবে।
তোমারি অংশদ্ভুতা          রমণীয় দিব্যকান্তা
          আছে এক নারী বৃন্দাবনে
ভাগীরথী যেমতি হায়          সাগর পানেতে ধায়
          ছুটিয়া সে আসে তোমা পানে,
ঘটিবে মিলন তব          আমরা প্রসাদ লব
          লুটাইবো যুগল চরণে।"


শুনিয়া হতবাক শ্রীহরি কহেন, -


"কি কইলি ওরে শুক          বিস্ময়ে আমি হই মূক
          মুখপানে বাক্য নাহি সরে,
কাহারে দেখিব আজি          লতা, গুল্ম, বৃক্ষরাজি
          তাই বুঝি ফুলে-ফলে ভরে !
কেমন তাহার মুখের গঠন          কিবা তাহার গাত্রবরণ
           আলায়িত বুঝি কেশরাশি,
মননে স্মরণ করি          ঐ দিব্য-রূপ হেরি
          কেমনে কহিব ভালোবাসি !"


শুক বলে -


"পতিত পাবন হরি          কত ছলা কলা করি
          খেলিতেছ ওগো মনোময়,
তোমারি এ রঙ্গ বুঝে          কেহ নাই ধরামাঝে
          বৃথা ভাবি দিন বহে যায়।
তবু যাহা বলিবারে          অনুমতি করো মোরে
          কৃপা কর যেন পারি কহিবারে -
অতুলনীয় সেই রূপ          দেবগণে করে চুপ
          পথ ছাড়িয়া দিয়া সরে।
স্বর্ণ-পদ্ম ন্যায় বদন          বাস বহে সুচন্দন
          কলি ভাবি অলি ভুল করে,
তাহে কুমকুম মাখি          নীলাভবরণ আঁখি
          হাসি যেন রাশি মুক্তা ঝরে।  
চপলাঙ্গ প্রাণহর             বরষিজে শরখর
          কতশত লুটায়ে যে পড়ে,
হেন রূপ মনোহর          ত্রিভুবনে নাই আর
          পূর্ণচন্দ্র শরমেতে মরে।
উষসী কঠিনা তিনি           মানভরে গরবিনী
          আজি কাতর প্রেম-জ্বরে,
তুমি নাথ অন্তর্যামী          তোমারে কি কব আমি -
          দুনয়নে বারিধারা ঝরে।"


আখর:


এত বলি শুক-সারী            গলা জড়াজড়ি করি
          দুইজনে কাঁদিতে লাগিল,
আর সেই ব্রজবাসী          ভুলিয়া মোহন বাঁশি
          মরমে মরমে ডুব দিল।


(চতুর্থ অঙ্ক সমাপ্ত)