আখর:
কি করিব বরণন আসিল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ
সবে হইয়াছে উন্মুখ
বিহঙ্গ ডালেতে বসি রবি সাথে লয়ে শশী
দুরুদুরু কাঁপে সবার বুক।
মরালী ফিরিয়া চায়, পতঙ্গ পথ ভুলি যায়
নৃত্য-গীত করে নিজ মনে,
কুরঙ্গ নয়ন মেলে শকলী লাফায় জলে
পুস্প করে কুসুমিত বনে।
বন-মল্লিকাগুলি সবে একসাথে মিলি
পথিমধ্যে ধুলাতে গড়ায়,
দূরে কোন তরুশাখে কোকিলাতে কুহু ডাকে -
মৃদুমন্দ সমীরণ বয়।
আখর ভাবেরে মনে যদি বুঝি এ লগনে
দেহ ত্যাগী প্রাণ বাহিরায় -
সোজা একেবারে যাবে শ্রীচরণে ঠাই পাবে
যেথা সদা ঝোলে ঐ শ্যামরায়।
হঠাৎ দূর হইতে দেখা যায় সখী-সমাবৃতা রাধারাণী আসিতেছেন। সেই দেখিয়া আখর গায় -
'কে ঐ নলিনী আসে সহচরী লয়ে পাশে
মণিমরকত কান্তিছটা -
কনক বদন হেরি ক্ষীণতনু সুন্দরী
কোকোনদ অধরে ফোটা।
বয়ানে ঝলকত অকলঙ্ক শশীযত
ছড়ায়ে রজত কিরণছটা।
প্রমোদা এলোকেশী খুলিয়া কেশরাশি
ঘটায় ঘোর ঘনঘটা;
কুবলয়্দলসম দু-নয়ন মনোরম
চঞ্চল নজরে চিকুর ঝটা,
উরসে কুচকলি জাগিয়াছে কেবলি
আননে লাজে রুধির ছটা।
অলকা ঢলঢল কাঞ্চন কুণ্ডল
নাসানলে বেসরে মণি -
শ্রোণী ধরা সম গুরু উপরে জঘন পুরু
কে বটে ওই কুহকিনী !
কলয়তি আখর হে উহারে জানিবে যে
সে মোদের দেব চক্রপাণি।'
এমতাবস্থায় সখীগণ দূর হইতে কদম্ব বৃক্ষটি নির্দেশ করিয়া শ্রীরাধিকার উদ্দেশ্যে কহিল -
"ওগো রতিবিনোদিনী অভিমানে গরবিনী
চাহিয়া দেখো ওই পানে -
বংশীধারী বসে রয় বংশী পাশে পড়ে রয়
কি যেন ভাবে বসে মনে
বেণুবাদন গিয়াছে ভুলি উড়নি পড়েছে খুলি
কার লাগি কাতর বিহনে।
পূরিল তো তব দেখা আর কি কাজ সখা
চল ফিরে যাই গৃহ পানে।"
আখর:
কহিয়া ফিরিল যেই রাধারাণী তরে
দেখে বৃক্ষতলে সে ভামিনী পড়ে
অঙ্গ কাঁপে থরথর নয়ন মুদিল
হইয়াছে প্রেমজ্বর সকলেই বুঝিল।
তখন আনন্দ ও প্রেমসুখে সখীগণ মাতোয়ারা হইল। সমভিব্যাহারে শ্রীকৃষ্ণ সমীপে গিয়া কহিল :
"শুন শুন ননীচোরা হইলাম মোরা সর্বহারা
মোদের ধন গিয়াছে চুরি -
কোনো এক চিত্চোর নিভৃতে খুলিয়া ডোর
রাইমন নিছে হরণ করি।
প্রাণাধিকা প্রিয় সখী তাহার এই দুর্গতি
বলো কেমনে সহন করি -
আস আস দেখি যাও যদি বুঝিবারে পাও
ধরে দিতে পারো ত্বরা করি।"
আখর:
'এবার যদুবর চলে রে -
কৃতিকানন্দিনী পানে
যদুবর চলে রে -
কত কি যে ভাবে মনে
যদুবর চলে রে -
শুরু হইল লীলা বৃন্দাবনে
যদুবর চলে রে -
প্রেমিক প্রেমিকার সনে
যদুবর চলে রে -'
নিকটে আসিয়া হরি বিস্ময়ে শিহরি
আবেশে ভরে উঠে দেহ-মন
হেন স্বর্ণকান্তিময় মূর্ত প্রতিমা ন্যায়
মোহিনী করিল সম্মোহন,
ঈশ যদি কৃপা করে তুলি তারে বাহুপরে
করি তাহার মস্তক চুম্বন।
এত ভাবি বসে কাছে রাই সৌদামিনী পাশে
ইষু বুঝি ছাড়িল মদন,
ঐসন নিরখিয়া যায় প্রাণ জুড়াইয়া
মুদিয়া যায় দুই নয়ন।
স্বপনেতে মনে মনে চমকি উঠে শিহরণে
করিয়া নিবিড় আলিঙ্গন,
নযনেতে বহে ধারা অঙ্গ অবশ হল সারা
আলুথালু হয় বেশবাস -
এইরূপ কান্ড দেখি সকলে মিলিয়া সখী
করিতে লাগিল উপহাস।
"কি গো রাখালরাজা কেমনতর হইল সাজা
কাহার ধ্যানে হইলে মগন ?
জ্বরে সখীর হুঁশ নাই তব দশাও কি তাই
কি করিবে রোগীর যতন ?
এতক্ষণে বুঝি মনে চিত্চোর কোন জনে
সখী মোদের করিছে হরণ
হেই কালাজ্বরে কাঁপি বুক নড়ে ধাকি ধাকি
প্রেমরোগে হয় অচেতন।
তোমা লাগি এই দশা এরই নাম ভালোবাসা
বুঝিবে কি তুমি বনমালী
পারো তো জাগায়ে দাও মোদের ফিরায়ে দাও
ঘুমায়ে পড়েছে ফুটকলি।"
আখর:
সখীবচন স্মরি প্রেমঘন শ্রীহরি
তুলিলেন তারে বাহুপাশে
আলুলায়িত কেশদাম যতনে তারে সাজান
সরাইয়া দেন মুখপাশে,
থিরি থিরি কাঁপে বুক অনির্বচনীয় সুখ
পলক না চাহে পড়িবারে,
কজ্বলা সুনয়নী বিমসা চন্দ্রিনী
মূর্ছিতা আজি বাহুপরে।
এত ভাবি মনে মনে অতীব সন্তর্পণে
মধুপ বসিল উৎপলে -
কম্পিত বিম্বধরে চুমিল যতন ভরে
দুই ভুরুধনু মধ্যস্থলে।
সহসা কি হল হেরি সকল ব্যোমচারী
আশীর্বাদ করিল যুগলে,
রামধনু বিরচিয়া পুস্পাসার বরষিয়া
সুমধুর গীতি গাহিলে।
আনন্দে ভরিল দিক পুলক মাত্রাধিক
সহচরীসবে চমকায় -
বদন প্রস্ফুরিল পল্লবী প্রস্ফুটিল
লইয়া প্রভূত বিস্ময় -
আবশ আনত চোখে নিহরে নির্নিমেখে
নিখুঞ্জবিহারী পরে
নবজলধর শ্যামা মঞ্জুল মঞ্জিমা
শিখণ্ড রাজিত শিয়রে,
তদুপরে দুনয়ন সরসী কৃষ্ণঘন
মোহিত করে শ্যামলিমা,
কোন কূলে লয়ে যায় মন থই নাহি পায়
ফুটে উঠে মুখে রক্তিমা।
বিটঙ্কে বিহগ পড়ি যেমতি অলস ভরি
চেয়ে রয় ভবিতব্য পানে -
বামা ব্রজেশ্বরী এইছন হেরি
কি ঘটিবে তাহা নাহি জানে;
সসেমিরা হয়ে রয় হেই দেখি আখর কয়
'ডুব দিছে প্রেম সরোবরে
সমাধি যাহারে বলে কত তপস্যায় ফলে
ধনি তাহা লভিল কিকরে ?'
(পঞ্চম অঙ্ক সমাপ্ত)