শ্রীরাধিকা নিজ বাটিকা সম্মুখস্থ বৃক্ষতলে অর্ধশায়িনী। বেশবাস, কেশরাশি অবিন্যস্ত। সেই দেখিয়া আখর গায় -
'গগনে কাদম্বিনী বাজায়ে কিঙ্কিণী
ঘেরে ঘোর ঘনঘটা
নবনীত পরশন আচ্ছাদিত করে মন
লাজে অধরে রুধির ছটা।
মধুলেহী যবে মধু লয়ে যাবে
মঞ্জরী মঞ্জরিয়া যায়
শামর ভ্রমর আসি রঞ্জিলা মহী মিসি
কুঞ্জবনে গুঞ্জন গায়।
গৃহীগৃহে প্রবেশি তস্কর যবে আসি
সর্বস্ব লুন্ঠন করে -
তদ্রূপ রোদন করে রাই অনুক্ষণ
প্রেমরতন হারাইয়া পরে।
উরগ দংশাইলে যেমতি বিষানলে
অঙ্গময় তোলে আলোড়ন -
হেই কালাচাঁদের বিষে জ্বলে পুড়ে মরে শেষে
তনুময় মদন তপন।
সদা মনকদলী খায় প্রতিক্ষণে চমকায়
কালাসুধামদে হইল মেদুর
মৃগতৃষিকা সম নিহরে প্রিয়তম
বিরংসাহেতু সয় সবুর।
আলুথালু বেশবাস যেন লইয়াছে সন্ন্যাস
ধরাপরে জ্ঞান নাহি রয় -
হেই শ্রীবদন স্মরি রাই স্বপনচারী
হিল্লোলে কল্লোল বয়।'
হেনকালে সখীগণ রাধা সমীপে উপগত হয়। শ্রীরাধিকার এইরূপ অবস্থা দেখিয়া বলে -
"কি গো আহ্লাদিনী চন্দ্রবদনিধনী
কি আবেশে হইলে মগন ?
কার কথা স্মরিয়া তনুমন ভরিয়া
জাগিয়া দেখিছ স্বপন ?
মন ধন গেল চুরি মোর ভয়ে ভেবে মরি
তোমা দেখি নেই কোনো ডর
উলটিয়া খুশি খুশি তরুতলেতে বসি
গাও গান গুন গুন স্বর !
এই যদি ছিল মনে মিছামিছি কি কারণে
আমা লাগি করিলে ছলনা -
ভালোবাসিয়াছি তারে বলিতে কি দোষ ধরে
ওগো লীলাপটীয়সী ললনা ?
ঘনশ্যাম ছাইয়াছে তব চিদাকাশ মাঝে
আর কি মনে রহিবে মোদের ?
এত কথা বলি যাই তবু সাড়া নাহি পাই
বুঝি পল আইল বিচ্ছেদের।"
শুনিয়া রাধারাণী অস্ফুট স্বরে বলেন -
"ওলো সখী শুনে যাও কি বলিবারে চাও
মিছে কেন কর ধামালি
তিমিরাবগুন্ঠিত সকলই মোর চিত
কাটা ঘায়ে নুন ছিটালি ;
কোথা রবি দিনপতি খুঁজি তারে আতিপাতি
তারেও কি ভক্ষিলো সে !
কোথা যাবো বলে যাও কি করিব কয়ে যাও
মোর অজপা হরিল যে। "
উত্তরে সখীগণ সকলে মিলিয়া বলিয়া উঠে -
"কি বলি কি বলি রে -
অনুরাগে হইলি রক্তরাগ
কি বলি কি বলি রে -
সাদা মনে ধরে দাগ
কি বলি কি বলি রে -
রসরাজের বশ হলি
কি বলি কি বলি রে -
প্রেমানলে পুড়ে মলি
কি বলি কি বলি রে -"
শুনিয়া রাধারাণী কহেন -
"কহ কহ সখী মোর কহ মোরে আজই
কেমনে টুটিবে এ ডোর তার কারসাজি
পরাণেতে অনুক্ষণ মন্দিরা বাজে
অসিতে হরিল চিত মন নাই কাজে।
যাঁহা যাঁহা নেত্র পড়ে তাঁহা কালা স্ফুরে
কিরিটিধারী মোরে বাঁধিল নিগড়ে
তোমা সব বাল্যপ্রিয়া প্রানসখী মোর
খুলিয়া এ মায়া-শিকল ঘুচাও প্রেমডোর। "
শুনিয়া ললিতা বলে -
"কত ছলা-কলা জানো ওগো ভানুপ্রিয়া
পেটে-মুখে এক হও শুন মন দিয়া -
পীরিতি পরম ধন যেবা করে হেলা
জীবণ বহিয়া যায় রোদনে দুবেলা ,
তার চেয়ে বলি শোনো ডুব প্রেমনীরে
তদপেক্ষা বেশি সুখ নাই ধরাতীরে ,
কন্ঠালগ্না হয়ে রবে দুলিবে দুজনে
আনন্দ প্রসাদ লব মোরা সখীগনে।"
কপট বিস্ময় প্রকাশ করিয়া রাধারাণী কহেন -
"কি কহিলি ললিতে এই ছিল মোর বরাতে
কুল,মান,শীল সব যায়
গোঠের রাখাল রাজা কি ভীষণ দিল সাজা
দেহ ত্যাগী প্রাণ বাহিরায়।
তারে ক্ষমা করি দিব অপমান ভুলি যাব
মোরে দিলি এই মন্ত্রণা !
কোথা ভাবিনু আমি হয়ে তার অনুগামী
দিব তারে একই যন্ত্রণা !"
সখীগণ উত্ফুল্ল চিত্তে তাল মিলাইয়া বলি উঠে -
""তাই হবে গো তাই হবে -
প্রতিশোধ নিব মোরা
তাই হবে গো তাই হবে -
ভাঙিব তার মঞ্জিরা
তাই হবে গো তাই হবে -"
সখী বিশাখা যোগ করে -
"বিষধর অহিপরে পদ ভুলে দিলে
তনুময় নিপীড়ন দগ্ধে বিষানলে
সেমতি কালারে দিব দংশন জ্বালা
প্রেমবিষে দিবানিশি হবে ঝালাপালা
রাই রাই বলি যবে রোদন করিবে
এ ব্যথার মর্ম কি হাড়ে হাড়ে জানিবে।
মোরা সব সখী মিলি এইছন হেরি
হৃষ্ট মনে যাব সবে গৃহপানে ফিরি।"
এই শুনিয়া প্রফুল্ল চিত্তে রাধারাণী কহেন -
"এই বারেতে ঠিক হয়েছে কর্ম যেমন ফল লভেছে
আমি সাতে পাঁচে নাই আমারে ভালোবাসি কয়েছে। "
অতঃপর যেন প্রাণবল্লভ কে শুনাইয়া বলিতেছেন -
"আমারে যা দিছ তুমি তোমারে তা দিব
স্বপনেতে ধরা দিয়া সদা জ্বালাইব।
জাগিয়া দেখিবে মোরে কুহেলিকা সম
ধরিয়া দেখিবে চাহি ঘটিল বিভ্রম ,
আমা লাগি কর কত করিবে রোদন
কোনো ফল নাহি পাবে টুটি যাবে মন।
ঘুমাতে না দিব আমি জাগরণে ঘোর
দিবাস্বপনেতে আসি ভাঙি দিব ডোর। "
আখর :
কে কাহারে দিবে সাজা বিধাতাই জানে
পিরীতির এমন রীতি হার নাহি মানে ,
এত ভাবি সখীগনে করে মিলি শলা
কি করিয়া পড়ে ধরা ব্রজবাসী কালা।
সুচতুরা বৃন্দা বলে, "দেখে আস আগে
রাধিকারঞ্জন কেমন পুড়ে অনুরাগে।
সেইমত জানিয়া চাল নব চাল
ধরিয়া মারিবে তারে রচি প্রেমজাল।"
এই ভাবি সবে মিলি মাতিল আনন্দে
অগতির গতি পানে পাঠাইল বৃন্দে।
(ষষ্ঠ অঙ্ক সমাপ্ত)