আখর :


যবে সব সখীগনে          সম্যক সযতনে
          মূর্ত করিল প্রতিমা
আখর ভাবেরে শুধু          তল নাহি পায় কভু
          কি বর্ণিবে সেই রূপমা।
উজ্জ্বল পীত তনু          গলিত হেম সম
          তাহে কত করিছে বাহার -
ইন্দিরা স্তিমিত          চন্দন চর্চিত
          ভূপরে উপমা নাই যার।
পিন্ধিছে নীলাম্বরী          মখমল ঘাঘরী
          মণি মরকত ঝলমলে ,
পেলব করভ পরে          অঙ্গদ শোভিত করে
          অর্ধানন ঢাকে কুন্তলে।
মেখলা কটিপরে          দৃষ্টি আকৃষ্ট করে
          মন্মথ লইয়া পুস্পধনু
কটাক্ষে পঞ্চশর          হানিছে নিরন্তর
          অন্বেষণ করে সেই কানু।
কপোলে লাবণি          মধুময় নিছনি
          খসি খসি ঝরিতেছে মৌ -
কপাল মধ্যস্থ          অনুরাগে সিক্ত
          ফোঁটা কুমকুমে রাঙা বৌ।
গহন নয়ন পরে          মণিখানি খেলা করে
          মীন যেমতি করে অনুপে ,
লাজে রক্তিম ঠোঁট          কামনায় বিস্ফোট
          সভয়ে থিরিথিরি কাঁপে।
স্বর্ণগৌরী গ্রীবা          তাহা মাঝে পায় শোভা
          হীরক গ্রথিত রত্নহার ,
কর্ণেতে কর্ণিকা          অস্থিরা চন্দ্রিকা
          প্রেমার্ণবে করিছে বিহার।
মল্লিকা মালতী          সুশোভিছে কেশরাশি
          অতসীর মালা দোলে গলে ,
ভীরু পদ পল্লবে          পূরীষ পরাইবে
          মেহেন্দি রচিয়া এই পলে।
আহেলী যৌবন          তাহে প্রেম পরশন
          অনুরাগে রঙ্গিলা রাই ,
মাঙ্গিয়া দর্পণ          মনে ওঠে আলোড়ন
          নিহরে বংশীধারী কানাই।
সুরগণ গগনে         আরতি করে মনে
          পূজে রাই বিনোদিনী পদে ,
স্বর্বধূ মানে হার          অসূয়াতে হয় ভার
          দুহাতে ঘেরে অক্ষি সবে।
হেনকালে কোথা হতে          বিরহের সুরেতে
          বেণু বাজে দূর কোন বনে -
আরশি পড়িল খসি          আকাশ রাঙিল মিসি
          দশদিক মাতিল প্লাবনে।
হৃষিত সখীরা কয়,         "ঐ শোন শ্যামরায়
          আসকে হইল পাগল ,
তপ্ত লৌহ পরে          হাতুড়ি হানো জোরে
          ভাঙি দাও মায়ার শিকল।
চল যাই ত্বরা করি          লুটিত বসন ধরি
          যমুনার কূলে ওই পানে
ভাঙিয়া গড়িব মোরা          রাধা-শ্যাম জোড়া
          নিরখিব তৃষিত নয়ানে। "
এহেন কহিয়া সবে          উত্থিল কলরবে
         কন্ধর ধরি রাধে টানে -
উৎসর্গীকৃত অজে          যেমতি হরষে মজে    
          লয়ে চলে যূপকাষ্ঠ পানে।
কোকিলার আহ্বানে          বসন্ত জাগিল বনে
          রক্তরাগে রাঙিল পলাশ ,
সেই পলাশের রঙ         ভরিল রাধিকা মন
          স্তব্ধ হয় বুঝি নিশ্বাস।
মুকুলে উঠিছে সাজি          আম্র বৃক্ষরাজি
          বিটপী ছাইল কিশলয়ে ,
সরোবরে শতদল          আনন্দে বিহ্বল
          উঁকি মারে কুতুলিত হয়ে।
সরাইয়া জীমূত          নিহরে আদিত্য
          হ্রাস করি আপন কিরণ ,
হিমসিক্ত তৃণ          পথপারে কীর্ণ
         বন্দিছে রাইচরণ।
মরুৎ থমকি হেরে          প্রণাম করে তাহারে
          তটিনীরে কয় , " দেখো চেয়ে  -
গুল্ম যুথিকা যূই          পুলকে মাতিল ওই
          সুরভিত দশ দিক ছেয়ে।
বিহগ সকলি          করিতেছে কাকলি
          উড়িতেছে এদিক - সেদিক ,
অনুরাগে কলাপী          কলাপ মেলিয়া দেখি
          নাচিছে ভুলিয়া দিগ্বিদিক।
শশক হরষে         ঝম্প করিছে কষে
          মৃগ চায় হতবাক নয়ানে -
কে বটে ঐ প্রাণী          আগে কভু দেখিনি
          বিশ্বরূপ ধরিয়া বদনে।
পুরুষের পানে আজি          প্রকৃতি ধাইল বুঝি
          নিজেরে করিতে উজাড়,
যুগে যুগে এই লীলা          বিধাতার প্রেমখেলা
          ঘটাইছে মুক্তি সবার।
তাই বলি এ লগনে          চেয়ে দেখো ওই পানে
          আনন্দে মাতিল ভুবন ,
সে আনন্দধারা          ভিজে হও মাতোয়ারা
         ভক্তিভরে শ্রধা জ্ঞাপন। "
এত বলি সকলে          সবে একসাথে মিলে
          রচে প্রেম-গীতি মধুময় ,
আখর কাঁদেরে শুধু          পান করি সেই মধু
          এত সুখ প্রাণে নাহি সয়।
আজর বিহীন তরী         আসক রতন ভরি
          চলিতেছে প্রেমোদধি পানে
সৌভিক জাদু দিয়া          বশ করিয়াছে হিয়া
          ছুটে চলে বাঁশরীর টানে।
অস্মিতা গেছে ঘুচে          শুধু প্রেমসুধা যাচে
          ধীর ঋতি ভাবিতে ভাবিতে ,
কবে সম্মুখে যাবে          বক্ষেতে ঠাঁই লবে  
          জড়াইবে কন্ঠ দুই হাতে।
ক্রমে হল উপনীত          যমুনা তীরস্থ
          বট বৃক্ষ দেখে ওই -
তদুপরে বিস্ময়          কেহ কথা নাহি কয়
          নীরদবরণ হরি কই ?
নাই শ্যাম তরুতলে          বট বৃক্ষ মূলে
        ভাঙা বেণুখানি পড়ে আছে শুধু
যেন ভাঙা মন ফেলে          চলে গেছে ধরা ভুলে
          চারিধারে মরুভূমি ধূ ধূ ।
সেই দেখে প্রাণ কাঁদে          শূন্য বুকে সুর বাজে
          শোকাতুরা হয় সবে মনে -
উদাসী প্রেমিক হরি          কত ব্যথা বুকে ভরি
          বিদায় লইল নিরজনে।
শ্রীরাধিকা ভেঙে পড়ে          বৃন্দার কন্ঠ ধরে
          সাশ্রু নয়নে বলে, "ভাই -
একি হইল আজি           বিধাতার কারসাজি
          তরুতলে কালা কেন নাই ?
ভয়েতে রুধিল শ্বাস          কি হইল সর্বনাশ
          ডুব দিছে বুঝি যমুনায়
ভালোবাসিবার লাগি          প্রাণ লইলাম মাগি
          কি করিলাম আমি হায় হায় !
মোর প্রতি এই প্রীতি          ছিল রঘুকুলপতি
          আগে যদি তাহা বুঝিতাম ,
ঘটিত কি এ ঘটন          হারাতো কি সে রতন
          অঞ্চলে বাঁধিয়া রাখিতাম।
তোমা সবে সখী মোর          কি ঘটাইলে ঘোর
          এই দিলে সইয়ের সাথ !
নাহি লাভ চিন্তনে          যাবো আমি এইক্ষণে
          যেথা গেছে মোর প্রাণনাথ। "
এত বলি পলকে          ঝাঁপ দিল ঝলকে
          উত্তাল যমুনার ঢেউ ,
সখীসবে হাহারবে          ধাইল ত্রস্ত্যপদে
          লাফ দিল নদে কেউ কেউ।
কৃষ্ণ বর্ণ ধরা         নীপ বৃক্ষ গোড়া
         ভাসিতেছিল এক সেই স্রোতে ,
শঙ্কিত নয়নে          নিহরে সখীগনে
          ধরিল তা রাই কোনমতে।
তদুপরে বিস্ময়          বাক্যস্ফূর্তি নাহি হয়
          এরপরে যাহা দর্শিল -
দেখে রাই বিনোদিনী          কাস্ঠেরে  কৃষ্ণ মানি
          কত যে সোহাগে ভরিল।
হেন দৃশ্য নিরখি          সকলে মিলিয়া সখী
          কাঁদিতে কাঁদিতে ভাবিল -
কৃষ্ণ সর্প বিষে          মোদের সখীরে শেষে
          একেবারে পাগল করিল।
যাহা হউক অতঃপরে          সকলে মিলিয়া ধরে
          রাধারে কূলেতে আনিল ,
মুদিত দুটি আঁখি          যেন ঘুমন্ত পাখি
          ধীরে ধীরে ঘুম ভাঙিল।
চোখ মেলে ব্যথা ভরে          ভামিনী প্রশ্ন করে ,
          "কোথা গেল প্রাণসখা মোর ?
বল বল বল মোরে          কোথায় লুকাইলি তারে
          বন্ধু নয় শত্রু তোরা মোর।
কুটিল ঈর্ষা ভরি          রয়েছে হৃদয় জুড়ি
         আঁধলা করেছে শেষমেষ
কি ক্ষতি করিয়াছি          পাকা ধানে মই দিছি
        মোর লাগি এত বিদ্বেষ !
ছাড়ি দাও মোরে সই          আমি আর আমি নই
          কালার হৃদয়ে মোর বাস ,
দুধে-ঘোলে মিশিয়াছে          আমার যা ছিল গেছে
          দুইয়ে মিলি এক হনু আজ।
আমারে দেখিয়া সবে          কালার দর্শন পাবে          
          কালা ভিন্ন আমি আর নই ,
কোথায় লুকাবে তারে          আমি যে যতন ভরে
          পরাণে ধরেছি তার কই। "
এত বলি অতর্কিতে         সরাইয়া ললিতে
           পাগলি ছুটিল অটবি পানে
যেমতি রে মুনিয়া          সহসা মুক্তি পাইয়া
           পালায় হরষে নীল গগনে।
সঙ্গিনী তরাসে          চোখের জলেতে ভাসে
          কি করিবে ভেবে সারা হয় ,
কিয়ৎক্ষণ পরে          যখন সম্বিত ফেরে  
          সকলে মিলিয়া ছুট দেয়।
সেই অভিমুখ পানে          ব্রজের নিকুঞ্জবনে
          যেথা গেছে অনঙ্গমোহনপ্রিয়া -
'রাধে রাধে' হাঁক দেয়          এ বন সে বনে যায়
         ভীত মনে মরে খুঁজিয়া।
বনের শাখীদল           করে মৃদু হিন্দোল
          ফুলে-ফলে সাজে অনুরাগে ,
পতগের কলতান         ভরে তলে মনপ্রাণ
          সখীমনে দাগ নাহি লাগে।
খুঁজে খুঁজে হয়রান          উদ্বেগে ভরে প্রাণ
          কি করিবে নাহি পায় দিশা।
আখর হাসেরে মনে          হেরিয়া সখীগনে
          (কহে) উওল রবি কাটিল নিশা।


              (দশম অঙ্ক সমাপ্ত)