আখর :
সহসা বিদিশা হতে ঘনাইল ঘনেতে
মেদুর করিল চারিধার ,
মেঘডম্বর দেখে দাদুরী হরষে ডাকে
প্রভঞ্জনে ছাইল আঁধার।
বিপ্লুত সখিগণে থকিত, ত্রসনে
পথহারা হইল সকলে ,
ভয়ে ক্রন্দণ করে ঈশেরে স্মরণ করে ,
"জ্বালো দীপ এই বেভুলে।
নিবিড় কান্তার ধ্বান্ত এ করো পার
ভাঙি দাও ঘোর দুঃস্বপন ,
সখীহারা মোরা সবে তাবাস করি এবে
সেই ধন করো বিমোচন। "
এত বলি যেইক্ষণে অতীব ভক্তিমনে
সহচরী সবে নমিল,
কাটিল নক্তঘন ভেল আকর্ণন
বসন্তে বাঁশরী বাজিল।
দিব্য দিধীতি ঘিরি দশদিক আলো করি
বহে সুবাসিত মলয়ানিল ,
রামধনু মেলে ব্যোম চন্দ্রিমা রচে সোম -
জুড়াইল গোপীদের শীল।
মায়াবাণে অক্ষটি বিসরিল লক্ষ্যটি
মণিহারা ফণী ভুলি যায় ,
প্রাণকাড়া সেই সুরে মন অনুসরণ করে
পতঙ্গ পাবকে ঝাঁপ দেয়।
শস্পাবৃত সৃতি মুকুলিত ব্রততী
সৌরভ তার মধুময় ,
বিটপে বল্লরী বরচন্দনসারী
হেলিয়া দুলিয়া বয়।
বনের রঙ্কুযত হইল নৃত্যরত
বসন্তসখ ধরে পূরবী ,
সুরাপানে ভৃঙ্গ করিতেছে রঙ্গ
প্রেম ইষিকা আঁকিল ছবি।
প্রণয় কটালে টুটিল আগলে
বাঁধ ভাঙা পুলকে ছায় -
সেই সুরে মিলে শেষে রাইআলি আবেশে
গুনগুন স্বরে গান গায়।
ক্রমে ক্রমে এইরূপে মধুবনে চুপে চুপে
প্রবেশিল সখী সকলে
বিলোল সখীযত হইল বিমোহিত
হেরিয়া বৃক্ষান্তরালে -
সমুচ্চ মহীরুহে ঘিরিয়াছে নভেঃ
রুধিয়াছে তপন কিরণ ;
প্রতিসৃত প্রভা অতি মনোহর শোভা
জোছনা যেন দিনমানে।
চুয়া চন্দন বাসে মন প্রেম গাঙে ভাসে
কে করিবে উহার বাখান -
প্রজাপতি ডানা মেলে নাচে দিগ্বিদিক ভুলে
প্রেমাবেশে ভরে মন-প্রাণ।
ফুলে ছাওয়া ভূমি পরে মনে বিস্মায়ন করে -
'কে করিল এরূপ সৃজন ?'
মাধবী বিতানে ঘিরি মখমলে সেজ করি
যেন জাগিয়া দেখিছে স্বপন।
সখীগণ ভাবে মনে এমন গহন বনে
'অনন্তসয্যা রচিল কে ?
বাসক পুষ্পাবৃত বিবশ করিল চিত
মানবের কাজ নহে রে।'
এতভাবি কুতূহলী সহচরী সকলি
ধীরপদে ভেল অগ্রবর্তিনী -
আবডাল গেল সরে হেরিল বিসরে
শ্রীরাধিকা অঙ্কশায়িনী।
মণিকাঞ্চনযোগে রাজীবলোচন পদে
সংবিষ্টা সমাহিতা সিক্তা ,
সুরতি শ্লেষেতে সংলিপ্ত গলেতে
কন্ঠালীনা হৃদ্দেশে সক্তা।
নির্ঝর উচ্ছ্বল হারাইল চাপল
স্থির হোল স্থিতি সরোবরে ,
জ্বালাইয়া প্রেমধূপে বরণ করিছে চুপে
আহূতি দিলে নিজেরে।
যোগক্ষেম ধন তার নবযৌবন ভার
বহন করিছে যতনে ,
প্রেমঘন রসে ভরি ভরন্ত ডাবরী
রস ছলকিয়া যায় আননে।
শীরিন ওষ্ঠ দুটি বিকশিত হয়ে ফুটি
চেয়ে রয় মধুকর পানে -
আপন পুষ্পাসব অর্পণ করি সব
সংহিত পরাগমিলনে।
স্নাতা সুলোচনা চমকিছে নীরকণা
শীকর ঝরে শ্রুতিমূলে ,
স্নাতানুলিপ্ত হইয়াছে ঝলোকিত
প্রেমগাহে স্নান করিলে।
ব্রীড়িতা রঙ্কিনী হইল বৈরাগিনী
বিথান করে বেশবাস ,
রশনা খসি যায় বিমুগ্ধা নাহি চায়
রাহীকান্ত চরণের দাস।
পূজিছে পূজারিনী প্রেমভারে ঋণী
প্রেমঋণ মিটাইল প্রেমে ,
রিক্ত করিয়া নিজে সকলি দিল সেজে
ডালি ভরি প্রেম চরণে।
সব হারাইয়া আলি যে ধন লভিলি
ত্রিভুবনে নাহি তুলনা ,
জনম জনম ঘোরে যদি হরি কৃপা করে
তবে মিলে তার উপমা।
এত ভাবি করজোড়ে সমভিব্যাহারে
প্রণাম করিল জম্পতি ,
বলে,"প্রভু কৃপা করে ঠাঁই দাও পদপরে
ফিরাও আমাদের মতি।
ধন,যশ,মান ত্যাজি ভবদরিয়ার মাঝি
তব প্রেমে ভরে তোলো প্রাণ ,
সেই বিসারিত প্রেমে নাচিব মধুর ঠামে
গাহিব মিলনের গান।
মদনোৎসবে আজি ধরণী উঠিছে সাজি
আকাশ রাঙিল ফাগুয়ায় -
সেই রঙে মিশে মোরা আনন্দে আত্মহারা
দেহ ত্যাগী প্রাণ বাহিরায়।
আসিল পরম ডোল মনে লাগে হিন্দোল
তোমাদিগে সাজাবো যতনে -
ফুলদাম দিয়া গলে বসাইব প্রেমঝুলে
দুলাইবো প্রেম ঝুলনে।
অপরূপ বিহঙ্গ মনোময় অঙ্গ
গ্রথিব হৃদকমলে ,
তুলসী চন্দনে পূজিব সযতনে
আরতি করিব অনলে।
(একাদশ অঙ্ক সমাপ্ত)