আখর :


পুষ্প চয়ন করি          তাহাতে দোলন গড়ি
          দিল আসন যুগলে ,
দাম নিশিগন্ধার          আমোদিত করে ভার
          বাঁধিল উভয়ের গলে।
গোধূলির কিরণে          স্বপ্নাবিষ্ট মনে
          অপলকে সবে চেয়ে রয়
রাধে কৃষ্ণ বলি          মধুর ধ্বনি তুলি    
          সুরভিত সমীরণ বয়।
অজর বীজন করে          বিমল চামরে
          শুকসারী নেচে নেচে কয়,
"প্রেমরঙে রাঙিয়া          দোদুলে দুলিয়া
          খেলিতেছ হোলি মনোময়।
সেই সুরা পিয়া          মদীর হিয়া
           ক্রন্দন করে পুলকে
পিরীতি ফাগে          নব অনুরাগে
          প্রেমরস যায় ছলকে।
জনম জনম ধরি          কত তপস্যা করি
          প্রতীক্ষা করেছি এতকাল ,
তব করুণার ফলে          পুরিল তা এই পলে
          ছিন্ন হইল মায়াজাল।
অব্যক্ত আনন্দে          বিশ্বময় ছন্দে
          মিশিব আজি এক্ষণে ,
উড়িব চারিপাশে          তব চিদাকাশে
          নমিব যুগল চরণে।
এত বলি শুকসারী          নমিল রাইহরি
          উড়িয়া কোলেতে বসিল
দশদিক আলো করি           কনক ময়ূখে ভরি
          স্বর্গ হইতে রথ নামিল।
নাচিতে নাচিতে দোঁহে         চড়িল প্রফুল্ল হয়ে
          পুনঃ পুনঃ করিছে প্রণাম
পক্ষিরূপ গেল খসি          দেবরূপে সুবেশি
          দিল পাড়ি গোলোকধাম।
বিস্ময়ে অভিভূত          হইল সবার চিত
         শ্রদ্ধায় শির অবনত ,
রাধাশ্যাম মহিমা          কি তাহার গরিমা
          উজলিয়া হল প্রকাশিত।
বিশাখা কহে,
"ত্রিভুবন হল এক          ওলো সই চেয়ে দেখ
          মোরা আর নহি মানবী
বনমালী কৃপা করি          সবারে দিছেন তরি
          এবে মোরা স্বর্গের দেবী।
চল সবে নাচি ফিরে          উভয়েরে ঘিরে ঘিরে
          খেলি রং প্রেম আবীরে ,
ওগো রাই ফিরে চাও          হৃদিপরে ঠাঁই দাও
          তোমারে চিনেছি এবারে। "
প্রসুপ্ত প্রসূন          ফুল্লিল এক্ষণ
          তপ্তকাঞ্চনসন্নিভ তন্বী
রম রাসবিহারী          খুঁজে মরে দিশারী
          বিমুঢ় করেছে বহ্নি।
আপন মায়াজালি          প্রেমের চোরাবালি
          হত আজি জগতের নাথ ,
মন শুধু ডুবে যায়          কোথা থই নাহি পায়
          কে তাহার ধরিবে হাত ?
ঈশের বিলসন          করিয়া সৃজন
          আপনি মাতিল আপনায়
শতদল বিরচিয়া          মধুপ সাজিয়া
          পান করে রস মনোময়।
নির্লিপ্ত ব্রহ্মেরে          মহামায়া ঘিরে
          রচিল যে প্রেমঘন লীলা
নিষ্কাম ভালোবাসা           নাহি তার কোনো ভাষা
          এ যেন বিধাতারই  খেলা।
দুইয়ে মিলে এক হলো          পরম সত্য চিনাইল
          সবাকার এ পরম গতি ,
আখর কাঁদিয়া বলে,         "কত শত পুণ্যফলে
          দেখাইল রঘুকুলপতি। "
মন ভাসে আনন্দে          নব প্রেম ছন্দে
          সরে গেল মায়া আবরণ ,
চিনেছি চিনেছি বলে          দুনয়ন ভাসে জলে
          নবরূপে দেখিনু ভুবন।
কাতর অনুনয়          করে বলে, "প্রেমময়
          হরো মোর সকল কামনা,
শুধু ঐ চরণতলে          ঠাঁই মাগি আঁখিজলে
          এ মোর অন্তিম বাসনা।
হৃদিপরে ভরি লব          যুগল মূরতি তব
          ভকতি চন্দনে করি অর্চনা ,
নয়ন অশ্রুবারি          দিয়ে ওগো প্রেমহরি
          ধুইব পদধূলিকণা।
তব নাম পুষ্পে          ধরিব বক্ষে
          জপিব শুধু দিবারাতি ,
কভু যদি কৃপা হয়          প্রস্তর ভাসে হায়
          খুলিয়া রাখি আঁখিপাতি।
মারিলে মারো মোরে          ধরিলে ধরো করে
          ফেলে দিয়ে রেখোনা কভু ,
অভাগা আখর কহে          আর কিছু নাহি চাহে
          এই মোর বিনতি প্রভু।
ভালো যদি বাসো মোরে          রেখো হে চরণ পরে
          না বাসিলে দিও মোরে সাজা ,
দিও নাগো দূর করে          সে ভয়ে আখর মরে
          তুমি মোর হৃদয়ের রাজা।
তুমি বিনা এ ভবে          কিবা আর পড়ে রবে
          যাহা ভালোবাসিবার জন ,
কাহারেও চিনি নাই          তুমি ছাড়া জানি নাই
          আর কেহ নহে গো আপন।
তাই সদা পাই ভয়          যদি কোনো ভুল হয়
          রাগ কোরো প্রভু মোর পানে
দয়া শুধু দয়া কোরো          আখর পাষন্ড বড়ো
          ক্ষমা মাগি প্রভু তোমা সনে।
পাঠক পুণ্যমতি          তাহাদের করো গতি
          বেদনা করো নিরসন ,
ভব ব্যাধি দূর করে          নিষ্কলঙ্ক অন্তরে  
          ভরে তোলো এই ত্রিভুবন।
অন্তে দিও স্থান          তব পরমধাম
          মুক্ত করিয়া এ বাঁধন ,
'হরি হরি' ধ্বনি তোলো          'জয় রাধেশ্যাম' বলো
          তোমরা সকলে এখন। "
দীন অতি কালীচরণ          আখর হইয়া কখন
          রচিল শ্যাম প্রেম গীতি
মনে বড় অভিলাষ          শ্রীহরির সাথে বাস
          করিবেক পাঠকের স্মৃতি।


                   (দ্বাদশ অঙ্ক সমাপ্ত)