বিষাদের ফুল:ফরাসি কবি বোদলেয়ার ও তার কবিতা
খাতুনে জান্নাত...
...


উনিশ শতকের স্বনামধন্য ফরাসি তথা বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম সেরা কবি শার্ল বোদলেয়ার; কবি আর্তুর র‌্যাঁবো(রেঁবো) ’র ভাষায়, ‘প্রথম দ্রষ্টা, কবিদের রাজা, এক সত্যদ্রষ্টা কবি’। জীবনের ক্লেদ থেকে তুলে এনেছেন কবিতার কুসুম ও কাঁটা। জীবন ফুলশয্যা নয় তবুও কবিতায় বিছিয়ে দেওয়া সৌন্দর্যের আবির ও রূপের অনন্য শ্রী ও কল্পনার ময়ূরপঙ্ক্ষী জড়ো করে একজন মানুষের মধ্যে আসা এসব রোমান্টিকতাকে কীভাবে আরও ব্যাপ্তিময় এবং সৌন্দর্যমণ্ডিত করা যায় সেটা শার্ল ভাবতেন। তার কবিতা শৈল্পিক ও গভীর ভাবের দ্যোতনাসমৃদ্ধ। কবি বোদলেয়ার দুঃখ ও বেদনার অতলে নিবিষ্ট থেকে দেখেছেন জীবনের আসল রূপ ও কবিতায় বিধৃত হয়েছে জীবনরূপের অলঙ্করণ ও সত্যকথন। সৌন্দর্যকে বিশেষ উচ্চতায় তুলে নতুন এক জীবন দর্শনের বাস্তবতা বা রিয়েলিজমের অনন্য দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন পাঠকের জন্য। বোদলেয়ার গদ্য কবিতায় স্বতন্ত্রধারা আনেন, পরবর্তী সময়ের কবিদের ওপর গভীর প্রভাব বিস্তার করে। তিনি ছন্দোবদ্ধ কবিতার স্তবক ভেঙে দেন। এই গদ্য কবিতাগুলোও ছিল সে সময়ের গদ্য কবিতার চেয়ে সফল ও গবেষণাধর্মী কবিতা। আধুনিক কবিতার সৃষ্টি ও সৃজনে শার্ল বোদলেয়ারের নান্দনিক অর্জন ও প্রভাব অনস্বীকার্য, কবিতায় তাঁর ভাব, ভাবনা ও ভাষা ব্যতিক্রম।


শার্ল বোদলেয়ার (পুরো নাম Charles-Pierre Baudelaire; জন্ম ৯ এপ্রিল, ১৮২১, মৃত্যু ৩১ আগস্ট, ১৮৬৭)। ব্যক্তিগত জীবন ছিল নানা ঘাত প্রতিঘাতে আকীর্ণ। ৬০ বছরে তার পিতা ফ্রাঁসোয়া বোদলেয়ার একজন আত্মভোলা, সৎ ও শিল্পীমনের অধিকারী চিত্রশিল্পীর ২৬ বছর বয়সী দ্বিতীয় পত্নী ক্যারোলিন তার মা। মা- বাবার বিয়ের দু’বছর পর শার্লের জন্ম। কবি মাকে খুব ভালোবাসতেন। মায়ের প্রতি প্রেম ও বাবার প্রতি ন্যাওটা ও বাবার শৈল্পিক চিত্রকর্মের স্পর্শ নিয়ে বড় হচ্ছিলেন। কিন্তু তার বয়স যখন ৬ তখন ফ্রাঁসোয়া মারা যান ১৮২৭ সালে। ঐ বছর ক্যারোলিন জ্যাক অপিক নামের ফরাসি সেনাবাহিনীর এক কর্নেলকে বিয়ে করেন। আরেকটি ভাই জন্ম হলে মা তাঁর প্রতি উদাসীন হয়ে পড়েন। মানসিক ও আত্মিক ভাবে বোদলেয়ার একা ও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন যদিও জ্যাক অপিক বোদলেয়ারকে ভালোবাসতেন। তাঁকে হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া করান। ছেলেবেলায় বোদলেয়ার মায়ের কাছে ইংরেজি শিখেছিলেন। এরপর স্কুলে ভর্তি হয়ে পরবর্তী তিন বছর তাঁর ইংরেজি-চর্চা অব্যাহত থাকে। এ-সময়ে তিনি ফরাসি ও ইংরেজি সাহিত্যের প্রতি গভীরভাবে মগ্ন থেকে লিখে চলেন একের পর এক কবিতা। নিজেকে যেন খুঁজে পেলেন স্যাতঁ-ব্যভের ‘কবিতা’ এবং তাঁর উপন্যাস ‘ইন্দ্রিয়বিলাস’ এই দুটি গ্রন্থের মধ্যে। দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো, শিক্ষকরা ছাত্র বোদলেয়ারের উপর নানা কারণে ত্যক্ত ও বিরক্ত হয়ে রইলেন। এদিকে বোদলেয়ার ইতিহাসকে ‘অর্থহীন এক বিষয়’ বলে কর্তৃপক্ষের আঁতে ঘা দিতে থাকলে তাঁকে স্কুল থেকে বিতাড়িত করা হলো। পরবর্তী দু-বছর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি না হয়েই লাতিন কোয়ার্টারে বাসা নিয়ে থাকতে শুরু করেন এবং প্যারিসীয় ছাত্রদের মতো উচ্ছৃঙ্খল জীবনে অভ্যস্ত হয়ে আফিমসহ নানা নেশায় অভ্যস্ত ও বুঁদ হয়ে লুশেৎ নামে এক রক্ষিতা রাখলেন। ধারণা করা হয়, এখান থেকেই তিনি সিফিলিস রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। এ-রোগই পরবর্তীকালে তাঁর মৃত্যুর কারণ হয়ে ওঠে।


বোদলেয়ারের লেখালেখির হাতেখড়ি লাতিন কবিতা দিয়ে। হোস্টেলেই কিশোর বয়সে কবিতা লেখা শুরু করেন। পরে আইন নিয়ে পড়া শুরু করেন ও ১৮৩৯ সালে তিনি পাস করেন। যদিও আইন নয় তার পেশা কবিতা লেখা এটা মনে মনে স্থির করেন।তাঁর আত্মগত অনুভূতি ও ধারণা ছিল:‘অদৃশ্যকে দেখতে হবে, অশ্রুতকে শুনতে হবে, ইন্দ্রিয়সমূহের বিপুল ও সচেতন বিপর্যয় সাধনের দ্বারা পৌঁছাতে হবে অজানায়, জানতে হবে প্রেমের, দুঃখের, উন্মাদনার সব প্রকরণ; খুঁজতে হবে নিজেকে, সব গরল আত্মসাৎ করে নিতে হবে, পেতে হবে অকথ্য যন্ত্রণা, অলৌকিক শক্তি, হতে হবে মহারোগী, মহাদুর্জন, পরম নারকীয়, জ্ঞানীর শিরোমণি। আর এমন করেই অজানায় পৌঁছান।’নগর জীবনের দক্ষ-দ্রষ্টা কবি জীবনের কঠিনতম অভিজ্ঞতায় কবিতাকে করেছেন বিশ্ব বিস্তৃত ও আধুনিক কবিদের জন্য নতুনতর বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। তিনি রিয়েলিজমেরও অন্যতম রূপকার। তিনি প্যারিস নগরীকে তাঁর কবিতায় অনেকবার স্থান দিয়েছেন, ফরাসি কবিতার পাঠকরা সেসব কবিতা পড়ে এক অন্য-জগতের সন্ধান খুঁজে পান। শার্ল বোদলেয়ার, স্টেপেন মালার্মে এবং পল ভারলেইন এই তিনজন কবি প্রতীকবাদী সাহিত্যের অন্যতম রূপকার। আধুনিক কবিতা বলতে যা বোঝায়, তা কোনও না কোনোভাবে বোদলেয়ারের কবিতার চিত্তনির্যাস ও অনুরণন, তেমনি পশ্চিমি কবিতার প্রায় প্রতিটি স্তরেই বোদলেয়ার কবিতার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব দৃষ্ট হয়।তাঁর জীবন এক নিরবচ্ছিন্ন দুঃখময় কালের পাহাড়। তিনি যেদিকে তাকান শূন্য ও অন্তঃসারশূন্যতা দেখেছেন। পরিবার ও প্রেম যেন পরাজিতের অট্টহাসি। দেখে দেখে মনে জমে যায় বিষাদ। তিনি নিজেকে ডুবিয়ে দেন সমাজের ক্লেদ, ঘৃণা ও নষ্টের ভেতর। পতিতালয়ে গমন শুরু করেন। কখনো পড়ে থাকতেন দিনের পর দিন। তা থেকে উদ্ধার করতে মা ও দ্বিতীয় বাবা তাঁকে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে ভ্রমণে অভিজ্ঞ নেরভালের পরামর্শে১৮৪১ সালের ৯ জুন তিনি বর্ডো থেকে ‘দক্ষিণ আকাশ’ নামে জাহাজে করে ভারত তথা কলকাতার উদ্দেশে পাঠিয়ে দেন। দুর্ভাগ্যবশত জাহাজটি উত্তমাশা অন্তরীপে এক ভয়াবহ ঝড়ের মুখে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে তিন সপ্তাহের জন্য মরিশাস দ্বীপে আটকে থাকে। ফলে তিনি ভারত সমুদ্রের রেনুয়ার দ্বীপ থেকে অন্য জাহাজে করে প্যারির উদ্দেশে যাত্রা করেন ও ১৮৪২ সারের ১৬ ফেব্রুয়ারি মাসে ফেরত আসেন ফ্রান্সে। এ-বছরটি বোদলেয়ারের কাব্যজীবনের অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য একটি বছর। কারণ এ-বছরই তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ তেওদর দ্য বাভিল প্রকাশিত হয়। এ সময় বয়সের ভিত্তিতে পৈতৃক সূত্রে অনেক টাকা পান ও বিলাসী ও বিনাশি জীবনে প্রবেশ করেন। ফলে তাঁর জীবনযাপনে দেখা দেয় ধনাঢ্য ব্যক্তির উচ্ছ্বাস। সস্তা লাতিন কোয়ার্টার পঁসিয় ছেড়ে উঠেন উঁচুদরের হোটেল ‘পিমদাঁ’য়। পরবর্তী দু-বছর তিনি ডুবে থাকলেন নানা ধরণের নেশায়– আফিম, সিদ্ধি ও বিচিত্র ধরনের মদের বিক্ষিপ্ত নেশা। অতিথিকে বিহ্বল করে তোলার জন্য ঘরের মেঝেতে বিছিয়ে রাখতেন দামি গালিচা, গৃহ সজ্জিত করেন প্রাচীন কবিদের সোনা-বাঁধানো মূল্যবান সংস্করণ দিয়ে; চিত্র ও অন্যান্য শিল্পদ্রব্যের সমাহারে ভরে ওঠে বাসগৃহ। এ-সময় তিনি ধার করে কেনেন বহু চিত্র ও শিল্পকর্ম। এজন্য জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তাঁকে এই ঋণের বোঝা টানতে হয়েছিল।এ সময় শিল্পের নন্দনতত্ত্ববিষয়ক Salon de (১৯৪৫-৪৬) প্রকাশিত হয়। তারপর উপন্যাস La Fanfario (১৮৪৭)। পরে লেখেন তার বিখ্যাত কবিতাগ্রন্থ Les Fleurs du mal লে ফ্ল্যর দ্যু মাল (১৮৫৭)।


পরবর্তীকালে আর্থিক অবস্থা সঙ্কটাপন্ন হয়ে পড়লে অনুবাদে হাত দেন ও লিখে টাকা আয় করতে চান। ফরাসি সাহিত্যের অন্যতম কবি, অনুবাদক, প্রাবন্ধিক ও শিল্প-সমালোচক হিসেবে তার কাজও উল্লেখের দাবি রাখে। ফরাসিতে এডগার অ্যালান পো’র অন্যতম প্রথম অনুবাদক তিনি। ‘যমজ আত্মা’ নামে দুই খণ্ড এডগার অ্যালান পো’র গল্প ও প্রবন্ধের অনুবাদ প্রকাশ করেন। এরপর আরও তিন খণ্ড বের হয় ১৮৫৮, ১৮৬৩ ও ৬৫ সালে। এই পাঁচ খণ্ড অনুবাদই বোদলেয়ারের সাহিত্যিক জীবনের বড় প্রাপ্তি বলে মনে করা হয়।


কবিতা……….‘কবিতা, মানসী, তুই প্রাসাদের উপাসক জানি।
কিন্তু বল, যখন প্রদোষকালে,
হিমেল বাতাসে,নির্বেদে, নীহারপুঞ্জে
জানুয়ারি কালো হয়ে আসে-নীলাভ চরণে
তোর তাপ দিবি, আছে তো জ্বালানি?… (পণ্য কবিতা)।(অনুবাদ : বুদ্ধদেব বসু)
...
মারব আমি তোকে, যেন কসাই,
ঘৃণার লেশ নেই, শূন্য মন, কিংবা শিলাতটে মুশা যেমন!
তাহলে আঁখি তোর যদি খসায় আমার সাহারার সান্ত্বনাতে
দুঃখধারা এক উচ্ছ্বসিত…
ছন্নছাড়া আমি শূন্যবাসী আপন হৃদয়ের রক্ত গিলে,
কখনো প্রীত হতে শিখিনি বলে আমার আছে শুধু অট্টহাসি। (আত্ম প্রতিহিংসা)(অনুবাদ : বুদ্ধদেব বসু)।


সঙ্গী হয়ে রয় কবিতা সঙ্গিনী
সে-রাতে ছিলাম কদাকার ইহুদিনীর পাশে,
পাশাপাশি দুটো মৃতদেহ যেন এ ওকে টানে;
ব্যর্থ বাসনা; পণ্য দেহের সন্নিধানে
সে-বিষাদময়ী রূপসী আমার স্বপ্নে ভাসে। (সুন্দর জাহাজ)।(অনুবাদ : বুদ্ধদেব বসু)।


তিনি সমকামী ও পতিতাদের নিয়ে কবিতা লেখেন। প্রেমের প্রতি ঘৃণা ও অবক্ষয়ের কবিতাসহ ঈশ্বর নিন্দা ও স্যাটানিক প্রকৃতির বেশ কিছু কবিতা লেখেন। যার ফলে তার বই ‘ক্লেদাক্ত কুসুম’ বা শয়তানের ফুল Les Fleurs du Mal (১৮৫৭) নিষিদ্ধ হয় আদালতে। তাঁর ছয়টি কবিতাকে অশ্লিলতার দায়ে দুষ্ট করা হয়। তিনি ঐ ছয়টি কবিতা বাদ দেয়ার শর্তে বইটা আবার প্রকাশ করতে উদ্যোগ নেন। কিন্তু তাঁর প্রকাশক পুলে মালাসি দেউলিয়া হয়ে ব্রাসেলসে পাড়ি জমান। ফরাসি বিপ্লবের সে সময়ে তিনিও ব্রাসেলসে চলে যান।১৮৬৩ সালে সে-সময়কার নামকরা পত্রিকা ফিগারোতে তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘আধুনিক জীবনের শিল্পী’ প্রকাশিত হয়। প্রবন্ধটির বিষয়বস্তু হচ্ছে ব্যঙ্গচিত্রকর ‘কুস্তাঁত্যাঁ গি’। এই প্রবন্ধটির জন্য সমালোচনা লিখলেন বুঁর্দ্যা, যিনি এর আগে ‘লে ফ্ল্যর দ্যু মাল’ সম্পর্কে বিষোদ্গার করেছিলেন এই ফিগারো পত্রিকাতেই। একই সময়ে তিনি পাঁচ বছরের জন্য তাঁর লিপিকা ‘প্যারি সপ্লিন’ বিক্রি করেন এক প্রকাশকের কাছে। সেখান থেকে কিছু ফ্রাঁ অগ্রিম হাতে আসে। এ ছাড়া পাঁচ খণ্ডের পো-র অনুবাদও প্রকাশক মিশেল লেভির কাছে দুই হাজার ফ্রাঁর বিনিময়ে পাঁচ বছরের জন্য বিক্রি করেন। এ টাকার সবই ঋণ শোধ করতে ব্যয় হয়ে যায়।


১৮৬৫ সালের জুলাইয়ে হঠাৎ একদিন আলুথালু বেশে মালপত্রহীনভাবে প্যারিতে এসে হাজির হন বোদলেয়ার। রেলস্টেশন থেকে বেরিয়েই দেখা হয়ে যায় তরুণ কবি কাত্যুল মাঁদেসের সঙ্গে। রাতে একমনে বসে বসে কী যেন হিসাব করছেন দেখে মাঁদেস জানতে চান তিনি কী হিসাব করছেন? সেই প্রশ্নের উত্তরে বোদলেয়ার মাঁদেসকে জানালেন যে, তাঁর সারাজীবনের সাহিত্যের মূল্য, অর্থাৎ বিগত পঁচিশ বছরে লেখালেখি করে তিনি রোজগার করেছেন মাত্র পনেরো হাজার আটশো বিরানব্বই ফ্রাঁ ষাট সঁতিম। রাত গভীর হলে বোদলেয়ারের কান্নার শব্দ শুনতে পান মাঁদেস। মাঁদেসের বাসায় রাত্রিযাপন করে ভোর হতে না হতেই একটি চিরকুটে ‘বিদায়’ কথাটি লিখে রেখে বেরিয়ে যান বোদলেয়ার।আবারো ব্রাসেলসে ফিরে আসেন বোদলেয়ার। হাতে সময় কম বুঝতে পেরে সময় নষ্ট করলেন না। ১৮৬৬ সালে ব্রাসেলসেই প্রকাশ করলেন ‘বেওয়ারিশ মাল’ কাব্যগ্রন্থটি। নতুন কবিতার সঙ্গে যোগ হলো পুরনো সেই দণ্ড-প্রাপ্ত ছয়টি কবিতা। ‘ল্য পার্নাস কঁতেঁপরেন’ পত্রিকায় বের হলো আরো পনেরোটি কবিতা। যখন ‘লে ফ্ল্যর দ্যু মাল’ এর তৃতীয় সংস্করণে হাত দিলে আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। সেই বছরের মার্চে প্যারিতে পাকাপোক্তভাবে ফিরে যাওয়ার মনস্থির করেন। কিন্তু অসুস্থতা হেতু অবস্থার ব্যাপক অবনতি হলে মায়ের কাছে চিঠি পাঠালেন। মাদাম ওপিক তাঁর দায়িত্ব নিতে প্রৌঢ় আইনজীবী আঁসেলকে বোদলেয়ারের কাছে পাঠান। আঁসেল ব্রাসেলসে বোদলেয়ারকে নার্সিংহোমে ভর্তি করান। সেখানে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলে মাদাম ওপিক ছেলেকে নিয়ে একটি আবাসিক হোটেলে উঠেন। পক্ষাঘাতে অচল বোদলেয়ার যখন কিছুটা সুস্থ হয়ে লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়ালেন, বন্ধুরা চাঁদা তুলে ট্রেনের কামরা রিজার্ভ করে ১৮৬৬ সালের ২ জুলাই বোদলেয়ারকে প্যারিতে ফিরিয়ে আনলেন। এখানে একটি নার্সিংহোমের নিচতলায় স্থায়ীভাবে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হলো। তাঁর প্রিয় বইয়ে সাজানো হলো ঘর, দেয়ালে টানানো হলো প্রিয় চিত্রকর্মগুলো। ঘরের সামনেই একটি ছোট বাগান। মাঝে মাঝে একমনে তিনি তাকিয়ে থাকতেন। বন্ধুরা এলে তাঁদের কথা শুনতেন, কখনো কখনো হেঁটেও বেড়াতেন। চিকিৎসকরা আশা করেছিলেন তিনি আস্তে আস্তে সেরে উঠবেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ১৮৬৭ সালের মে মাসে তাঁর অবস্থার চরম অবনতি হয়। নিজের নাম ও চেহারা ভুলে গেলেন। আয়নায় নিজকে দেখে অপরিচিত ব্যক্তি ভেবে অভিবাদন জানাতেন। নিজেকে মাঝে-মধ্যে নের্ভাল ভেবে কথা বলার চেষ্টা করতেন। কখনো বা দুহাত কোলের ওপর রেখে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকতেন। জুনের প্রথম সপ্তাহে পুরোপুরি শয্যাশায়ী হলেন। এর পরের দু-মাস জ্ঞানহীন মুমূর্ষু অবস্থায় কাটল তাঁর। সে বছর, অর্থাৎ ১৮৬৭ সালের ৩১ আগস্ট প্যারির সময় বেলা এগারোটায় ছেচল্লিশ বছর চার মাস বয়সে তিনি মায়ের কোলে মাথা রেখে ইহলোক ত্যাগ করেন।তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রকাশিত গ্রন্থ: Teodar de Vabil 1842, Salon de 1845, (1845) Salon de 1846, (1846,, La Fanfario (1847) Les Fleurs du mal (1857) Les paradis artificiels (1860) Réflexions sur Quelques-uns de mes Contemporains, (1861) Le Peintre de la Vie Moderne, (1863) Curiosités Esthétiques, (1868) L’art romantique, (1868) Le Speen de Paris (1869)


তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর সব কবিতা বিধি নিষেধের পার ভেঙে ছাপা হয়। জীবিতকালে কবিতার কোনও মূল্যায়ন পাননি। সমকালের কবিদের দ্বারাও নিগৃহীত হন। জীবিতকালে নিন্দিত ও মৃত্যুর পরে নন্দিত এ মহান কবি আধুনিক কবিতার প্রধানরূপে চিত্রিত হয়ে আছেন বর্তমান সময় পর্যন্ত। তিনি যখন বলেন,


‘ধর্ষণ বা অগ্নিসংযোগ হলে,বিষ বা ছুরি
এর মধ্যে কোন আনন্দদায়ক নিদর্শন বোনা আছে–
এই অনুজ্জ্বল ক্যানভাসগুলোকেও
আমরা জীবন হিসাবে গ্রহণ করি-
কারণ আমরা যথেষ্ট সাহসী নই!’(অনুবাদ : খাতুনে জান্নাত)।


এভাবেই জীবনের টুকরো টুকরো ছবি দিয়ে মোহগ্রস্ত করে ফেলেন পাঠককে। তাঁর অনেক কবিতায় আধ্যাত্মবাদের ধ্বনিও পরিব্যাপ্ত রয়েছে।এসব কবিতার প্রতীক, ধ্বনি ও মাধুর্য প্রতিধ্বনি তোলে পাঠক বিশেষ করে জীবনের কঙ্কর ও ধূলায় আবর্তিত নগর জীবনে। গ্রাম ছেড়ে আসা মানুষের জীবন ও সংগ্রামে লিপ্ত হতে হতে যাদের লুপ্ত হয়ে যায় হৃদয়ের আরক। প্রিয়জন প্রিয় থাকে না স্বার্থের দ্বন্ধ আর কোন্দলে বা অন্তকোন্দলে হারিয়ে ফেলে প্রাণ। যদিও বাইরে থেকে ফিটফাট, ঝকঝকে শহরের চিত্ত ও চিত্র। কবির কলম এ অন্তঃসারশূন্যতাকে শিল্পময় করে কবিতার রূপ পরিগ্রহ করেছেন।