১০টি গদ্য কবিতা
খাতুনে জান্নাত
.........................


তুমি শুনতে পাও


কী যেন হচ্ছে কোথাও–কোন গোপন সন্ধি– কোন গূঢ় আয়োজন! স্রোতের শেওলায় জড়িয়ে থাকা ইচ্ছে-মাছ; কোথাও অভিন্ন আর্তনাদ, পাথর বা কয়লার গুড়ো ভাবনার চোখে। চিতাবাঘের চামড়া লেপ্টে স্বপ্নে মায়াকণায়। হারিয়ে হারিয়ে স্মৃতির টুকরো ছবি ভেসে উঠে ক্ষত। নিঃস্তব্ধতার ফসিলে অস্পষ্ট শব্দ ও দহন কী লেখে? কোথাও জংলী লতা পায়ে নূপুরের মতো; তুমি কী শুনতে পাও জালের ঝপাৎ ধ্বনিতে জীবনের আয়োজন? শালুকের অভেদ্য আলোক, শামুকের নির্জন অভিসার। ভগ্নতার ফসিল বেয়ে নেমে যায় বাতিওলা পাহাড়ের খাড়াই বেয়ে। সমরূপে শঙ্খপদধ্বনি আর মরা বিড়ালের উৎসব! তুমি কী বুনছো বিরহের মাতমমোড়া সংসারী ছায়াঘর!
...................................................................................


কামারের হাঁপর যেন দিনকাল


গলিটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। দু একজন করোনা পরিত্রাণ মাস্ক পরিহীত কাতরায় ‘ অক্সিজেন অক্সিজেন ‘–চুরি হয়ে গেছে হসপিটাল। কামারের হাঁপরের হাওয়া দিনগুলো। বৈজ্ঞানিক ল্যাব সুদখোর মহাজনীয় পানাগার। ভাঙা হাত-পা, ফুলে ওঠা কণ্ঠনালী, ক্লান্ত জরায়ু, হৃৎপিণ্ডের কাতরানি শুনছে না কেউ। বরফ যুগে চাপা উৎসবকাল । কেউ মাখছে না ভোরের ভৈরবী, সাঁঝের ইমন। ঝাঁপ ফেলা রাতের বেহাগ ভুল করে কোয়ারেন্টিনে থাকা দুঃসময়। বিশ্বাস যেন অতিথি পাখি সেও পরে আছে করোনা পোশাক।
...................................................................................


সন্ধি


কাচভাঙা সময়ের উরু বেয়ে উঠছি সন্ধির বালুতটে।পাঁজরের ক্ষত, মৃত দিনলিপি, ঠোঁটে প্রাকৃত জনের বিচ্ছেদের গান। আমরা চলছি, যে পথ ভেঙে গেছে হাজার বছরের বাঁক বদলের ফাঁক গলে। কোথাও দলিত জনের আর্তনাদ, কোথাও মেনি বিড়ালের মতো ভিজে যাওয়া উৎসব, নবান্নের পালাগান। কণ্ঠে শীলার মতো বিলাস বৈভব । অচেনা পালক অদল-বদল; ধরা যায় না আসল রঙ ও ভেদ। অচেনা সময় লিখে অচেনা পল্লবিত বৃক্ষ ও নটিনি নদের গান। পাখার শব্দে দূর্বা-শিশির চোখ মোছে, আঙুলের স্পর্শ বাঁচিয়ে রাখার প্রজ্ঞা ও পূণঃর্গঠনের ছাপ ছোট কুঁড়েঘরে; সে ঘরও ভেঙে যায় আম্পান ঝড়ে…
...................................................................................


আহরণ


না ঘুমানো প্রসবপ্রসু রাত। নিঃসঙ্গতার বালিশে হেলান দিয়ে অতলছোঁয়া মিহিভাবনা তুমি লিখে নিতে পারো। কৌশলে কেউ কেউ ভেঙে দেয় ইচ্ছে ডানা, চলনের কৃৎকৌশল। তোমার চোখের আর্দ্র আভার মতো স্বচ্ছ আকাশ কোথাও দেখি না। পাতিহাঁস ডানার বিকেলে লাল জলপাই পাতার নূপুর, কড়ি কুড়ুনির জংধরা গীতে শিউলিতলায় কোরাসের হুড়মুড়। শিশুদের সাঁতারের ঝাঁকে ঢেউখেলা গুঁড়িপানা। এসব আনন্দ নিকেতন ধরে হারিয়ে যাওয়া গল্পের মোহনায়! কুঠারের কাব্যহরণের কুহকে বৃক্ষদের জন্য এক মিনিট নীরবতা পালন করি। নিপবন ছেড়ে প্রান্তরে খোলা কুমুদিনী সভায় অভিসার ভেলা । নক্ষত্রের ইশারায় পাঠাই বৃক্ষের চিঠি মানসমণ্ডলে; হরিৎ বিকেল গা এলিয়ে হাসে। এই যে পথের সরল সমীকরণ, এই যে হন্যে হয়ে নিজেকে খোঁজা সে তো তোমার ঝিনুক চোখের মায়ার আহরণ ।
...................................................................................


শিল্প সময়


তুমি ঠিক কোমল কোমল মেহগনি ফুল! বিকেলের নীরব ওষ্ঠে ফোঁটা ফোঁটা মৌ। কার্বন মোড়ানো সংসার, চালতা-মন আবৃত চোখে আগ্রহী পুঞ্জাক্ষী। ভুলভুলাইয়া ঝড়ে ডুমুরের মতো সৃষ্টি-আদিকূল। যখন সৌন্দর্যের প্রাণপিয়াসীরা দুর্বৃত্তের কামমুকুল; হাতের তালুতে নাচে মণিবাঁধা সাপ। বিষপ্রসবিনী মায়েরা মাঘের থ্যাঁতলানো কোমর জড়িয়ে। এর মাঝে তোমার কথাগুচ্ছ মৌমাছি গুঞ্জনে আহ্লাদী পানসী ঘাটের ভাটিয়ালি। আরো দূরে সর্ষের আলোর মতো সরল মানুষের কুটির জীবন। স্পর্শ করুক বিমূর্ত-মূর্ত ও মুক্তির অনন্ত শ্লোগান। মিছিলের আগেভাগে উজ্জ্বল তরুণীর উড়ু আঁচল মনি সিং, ইলা মিত্র স্মরণ। সংগ্রাম-সাম্যতা জীবনের পাদদেশে রক্তিমাভা। বিবর্তিত হও অটল সেগুন আর মটরশুঁটি মায়াডাল; রঙধনু-কাল শিল্পপায়ে হেঁটে যাক অনাগত আগামীর চোখে। পথ পিছলে না পড়ার দৃঢ়তায় ইস্পাত কঠিন হেনরী হাতুড়ি; ভেঙে দাও চুকবুক লালাধারী বিবশ বিবেক বা বিবেকহীন চুলবুলের ঢেউ খেলা দমবন্ধ পাণ্ডুর সময়।
................................................................................


দৈনন্দিনতা


পরোটা বেলতে বেলতেই বেলা হল হেলা। পোড়ামাটির গনগনে ঝাপ-তেলে ভাজি ম্যাড়ম্যাড়ে অলস বিকেল। অনীহার কাঁকর গুঁড়ো অদম্য পাটাপুতায়। সন্ধ্যার বেলকনিতে কোলে নেমে আসে ভারমুক্ত আকাশ। বৃষ্টির উদাসী বার্তা সূঁচে গাঁথি। বেদনার কাঁচে ঝমঝমঝম কালিদাস বর্ষার মেঘমালার দেশ ধর্ষিতার শাড়ির মতো পেঁচিয়ে পেঁচিয়েও দেখায় নকশিকাঁথা রাত। হারায় সাওতাল কন্যার ধোঁয়াশা যাদু। কচুরিবনে জমে থাকে বেগুনি আফিম। মুকুলফোটা বেলা চায়ের টেবিলে আসর বসায়। নির্যাতিত দিনগুলো রক্তের ঢেউয়ে। আজকাল ভোর যেন প্রেমিক সকাল। বালিশে গোঁজে জীবন মাড়ানো অশ্রুর স্ফটিক। শিশুর চকলেট হাসিতে ক্ষয়ে যায় ক্ষয় রোগের প্রাতঃকাল... পাথরকুচি বন থেকে ভেসে উঠে বেহুলার দৃশ্যকাব্য।  করুণা দাসীর বেদনাস্নাত নদীর ধারের বেতসী ঝোপেঝাড়ে আতঙ্কিত পাখিদের কলকাকলি হারানো ছন্দের মিড়-তাল। আজকাল দুশ্চিন্তার বলিরেখায় মাধবীকুঞ্জ। বাসন মাজতে মাজতে ধুয়ে ফেলি বিকলন। ছুরতা কাটে কট কট কট ভাবনার খণ্ড-ভার, লিখতে না পারার অনাহূত ছেদ পরিহৃত হয় মেঝের মোছনে। আজকাল বার বার হাত ধুতে ধুতে দৌড়াতে থাকি দুঃখ।
..................................................................................


রাতদিনের নীতিকাব্য


চুলায় জ্বলছে মৃন্ময়ী শরীর, রিংটোনে হুড়মুড়িয়ে ঢুকছে সন্ধ্যা; সন্ধ্যা ছুটছে রাত্রির দিকে। রাত্রির বেলবটমে টমটম নৃত্য। প্রাগৈতিহাসিক শহরের ইতিবৃত্ত। ডাস্টবিনের খাবারে যার দিনরাত্রি তাকে শেখায় স্বাস্থ্যবিধি নিঃস্বার্থ মন্ত্রণালয়। বুড়িগঙ্গা পারের টেনারিগুলো উপড়ানো শহররক্ষা কারিক্যুলাম। তবুও নর্দমায় পড়ে থাকে অনাহূত মাতৃত্ব। পিতৃত্বের স্নেহ অনাগত সুখপাখিগান। রাত্রি আর্তনাদ করে তৈলাক্ত থামে। এই জ্বরজ্বর শহরের কার্নিশে কাক পাখিরা চিৎকারে লাঘব করে বিরহের  আসমুদ্রহিমাচল। আর্তনাদ-ক্রন্দন পিঠাপিঠি ভাইবোন। মায়ের সমান্তরাল কোল থেকে ধর্মীয় রোষাগারে। কোষাগারে জমা বিভেদের কালো টিপসই। সাজিয়ে যাচ্ছে কারা উন্নয়ন সিডিউল? মডিউলের ফাঁকটুকু নজর এড়িয়ে গেছে কোঅর্ডিনেটরের বাজেটের নীতিমালা।
.................................................................................


পথের ভেতর পথ

তুমি-আমি অনন্তের ছায়াছবি। লাল-নীল রাত্রির কথোপকথন । ভৈরবীর বহমান সুরসাগর। ঢেঁকীর তালে তাল রেখে নৃত্যরত ফাগুন সকাল। শহীদের মাল্য অর্পণ শেষে ওরা কারা ছোটে ভিন ভাষার গান! আমরা সে মরীচিকা পথ পেরিয়ে এসেছি। প্রভাতফেরির ছায়ায় দেশ ও মাটির লিখন; কৃষ্ণচূড়া সরগম। কিছু কিছু ভুলরাত্রির মতো কথকতা মিশে থাকে পথের আলনায়। ইরেজারে মুছি ত্রিভুজ ভুলের সম্পাদ্য। সাহারার তৃষ্ণায় ফোটে প্রেমফুল; ঢেউ ভাঙে, ভাঙে কূল। গড়ে চর ও বসতি। চোখাচোখি চখা-চখি, মরাল-মরালী, । চলন্ত পায়ের মুদ্রার ছাপ স্রোতে। স্রোত পৃথিবীর প্রান্ত ছোঁয়া মায়াবতী শিল্পের আঙুল; পারাপারে পাথর ভেঙে ভাসে সাম্পান। আরশিতে দেখা টেমসের জলে পুবদেশের ভেলা; কচুবনের কীর্তন। কে তুমি কৃষ্ণজন ভাঙতে চাও অভিযোগের বুকে দাঁড়িয়ে কষ্টের ছাউনি। কষ্টের রঙ এঁকেছে আকাশের মায়া, পল্লবিত হিল্লোল ভেঙে চলছে বিভেদের পাটাতন। মেদবহুল পথ থেকে ছেঁকে নিই শোভা। ধুলোর পলেস্তারায় ডুবে ছিল বহুকাল। বহুকাল কৃতদাসের ঘায়ে উরু ও আঙুল। বহু চেষ্টা করেও মায়েরা ভাঙতে পারেনি পরজীবি জীবন। সাপের মতো পেঁচিয়ে যাওয়া, বেতবনের মতো আকর্ষীর আঁশ; বহু সাধনার পানসী পথহারা। এসব ক্ষয়ের  দৃশ্য ভুলে আঙুলে জড়িয়ে রাখি রোদের কিন্নর। বলের গতির কাছে বেঁধে দি নিয়ন্ত্রণের সমাপিকা সূত্র।
...................................................................................


পাঠ


তোমাকে পড়তে পড়তে খুলে যায় চোখ। ঠোঁটের মুদ্রায় ডালিমের হাসি। অলঙ্কারিক বিভাসে উর্ণনাভ বুননে পথের রূপরেখা। পিচ্ছিল কালক্রম। তোমাকে লিখতে লিখতে আয়ুর্বেদ সৃজন। নিরবধি বৈঠার শব্দ কত পূণিমার দোল খাওয়া অনাদি রাতের স্নেহ মায়ের কোল হতে ঝাপিয়ে পড়ে সংগ্রামে; বিজয়গাথার অশ্রু মোছে মোহের আগুন। আমরা পুড়েছি অনিচ্ছার হোমে। ইচ্ছার আলোর গুড়ো প্রতিজ্ঞ আজ শব্দের বন্যায় ভেসে যাবে কালোরাত্রির জৈব সমাচার ; ইরেজারে মুছে মুছে ফিরিয়ে আনি অভিমান ও কল্পদিনের রাগ-অনুরাগ। শেয়ার বাজার ধ্বস থেকে এভাবেই যদি উঠে যেত পতনের দাগ...
...................................................................................


শেষ বেলার পদ্য


বন্ধুর বিদায়ে লিখে রাখি নীরবতা। চৌচির শব্দে উড়ে যায় চিল। পথের উপর খসে পড়া পালকের বিলাপে আমরা লিখেছি প্রাচীন বনের উপপাদ্য। হিমালয়ের পাদদেশের প্রেম ইতিহাস। ত্রিভূজ কালের খেয়ায় ভাসা তালপাতা হাসি। বাতাসের ফ্রেমে মায়েদের সোনামুখের রোদছায়া। হাতের আলুনি ভাত। লেবুপাতা দিনের নক্সা। একই ডায়েরিতে লিখেছি শ্রাবণ, নারিকেল পাতার শিস, পৌষের কাছাকাছি রোদমাখা হাসি। লুকোচুরির বেতবন পেরিয়ে হারিয়ে যাবার না জানা কথা। এক কবিতায় দু-অভিমান। এখন তো উড়ে যাবার সাহস নেই। জীবনের রূপকথাকে গুছিয়ে এনেছি প্রায়...