কবিতার অনুভাবনা ও বুননের সারকথা
.....................
আগুনে পাতা হাত; ফোস্কা উঠা দাগ। বিজয়ীর আশ্বাসে ট্রেনের জন্য হাত বাড়াতে বাড়াতে হারিয়ে ফেলা গতি। ডাল থেকে ফাগুনের ফোটা ফুল ছেঁড়ার আর্তি। এসবই তো তুলে আনতে চাই কবিতায়। কবিতা নিসর্গের আদিভূমি। মনের গভীরে জমে ওঠা ছেঁড়া অভিমান। গুঞ্জনে গুঞ্জনে লিখে রাখে একাকী রাতজাগার নীরব অভিধান। নিঃশব্দে উঠে আসে কবিতায় ঐতিহ্য ও স্মৃতির মেদুর আদিবাষ্প। কে আমি? কেন এই স্বল্প সময়ের দীর্ঘ অভিযান। এই যে সম্পর্কের সাথে সম্পর্কের তুঁতিগাথা। তার কী প্রয়োজন? তা কি এ স্বল্প সময়ের বাক্‌বিতণ্ডা অভিরুচি অথবা আছে তার কোন গভীর কারণ। অতি গভীর রহস্য শিলাস্তরে লুকনো নৃতাত্ত্বিক যেভাবে খুঁড়ে খুঁড়ে বের করে ঐতিহ্যের গভীর মর্মগাথা। কখনো শতকের ঘর গুণন করতে করতে শূন্যের নামতায় দিকহীন ঘোরাঘুরি। এসব নাও হতে পারে-- অতি সাধারণ মনের কথা ব্যক্ত করার গভীর ইচ্ছা। পাখি যেমন গান করে, নদী যেমন কুলকুল রবে বয়ে যায়, শিশুর আগ্রহী চোখের সাথে আধো আধো বোল। কবিতা প্রিয় হয়ে উঠে, একাকী ঘরের ঘোরে প্রিয় স্বজন। প্রাত্যহিক স্বজন বেষ্টিত হলে কবিতা কি দূরে সরে যায়? হয়তো নয়। স্বজনের হাত ছুঁয়ে যাওয়া ঘ্রাণ, আঙুলের স্পর্শ নির্মিতি ও দোলা অথবা স্বজনকে একপাশে রেখে উঠে আসে রাতজাগা ক্লান্তির চোখ। প্রেম ও প্রণয়ের পুঞ্জীভূত ধূপ রাশি। শৈশবের কোলে শুয়ে হাতে ছুঁয়ে দেখা ফেলে আসা চরণের দাগ। ভুল ভুল আর ভুলের আর্তি; এ জীবন কী ক্রন্দনের সুর!


কেন কবিতা লিখি? ধোঁয়া উঠা পোড়া জীবনের বাষ্প সরাতেও কবিতা লিখি। একটি কবিতা লিখলে যেন একটি জীবন জয়। সময়ের পিঠে চড়ে দূর সময়ের কাছে পৌঁছে যাবার আর্তি থেকেও কবিতা লেখা হয়। কবিতার ছন্দ, অলঙ্কার, বেশভূষা, সফলতা- ব্যর্থতা এসবের হিসাব না করেও। কখনো হিসাবের ইচ্ছা সফলতা বয়ে আনে। এ সমাজে চলতে থাকা ভুল, ক্লান্তি, ক্ষুধা-মন্দা, আলো-আঁধারি, বিভেদ, ধ্বংস, লোভ আর প্রলোভের অশ্বে চড়া চারপাশ। মানুষের নৈতিকতা অবক্ষয়ের অপভ্রংশ ছুঁতে চাওয়ার ইচ্ছা থেকেও কবিতা উঠে আসে কখনো কখনো। কবিতা হচ্ছে বা হয়নি কে বলতে পারে!। আমিও পারি না। যেমন পারি না সবার সাথে দল বেঁধে ছুটে যেতে কোলাহলের স্তর পেরিয়ে মহাকোলাহলে বিলীন হতে। ছুটতে ছুটতেও শেষমেশ একা হয়ে যাওয়ার ক্ষরণ থেকে অথবা একা থাকার গরিমা থেকেও কবিতা লেখা হয়।


মনের পুঞ্জীভূত শব্দ রাশি অনুভূতির দীপ্ত আলোকের সহযোগ। মননের ঘরে জোড়াতালি আলোআঁধারি। প্রেম ও প্রণয়ের ধূপরাশি। কবিতাকে তাৎক্ষণিক সমাজ বদলের হাতিয়ার মনে করি না । কবিতা মননের ধার সুসংহত করে। পাঠকের সাথে এক অন্তনীহিত সংযোগ সৃষ্টি করে। ধীরে ধীরে কবিতার রস সংযুক্ত হতে হতে হয়তো পুরো সমাজটাই বদলে এক মানবীয় সৌন্দর্য মণ্ডিত হয়ে উঠবে বলয়। এরকম একটি আশা খুব সংগোপন জলের লিরিকে মাছের মতো পাখনা সাঁৎরায়। হাঁটতে হাঁটতে কিংবা ভাসতে ভাসতে চলে এসেছি দীর্ঘ পথ। পথ চলতে চলতে নিয়ত লিখে রাখতে চাই প্রেমের পরাগ। মুহূর্ত টুকুকে অতিজাগতিক রূপে মূর্ত করে বিমূর্ত ভাবনার আকাশে দোলায়িত করে জীবন চাকতি অথবা প্রেমহীন জীবনের আদি ও অন্তিমতা। প্রতারণার প্রদাহ এসবকে পাশ কাটিয়ে ছুটে চলার ধাবমান ঘোড়ার লাগাম ছুটিয়ে স্বপ্নের দোরে কড়া নাড়ার ইচ্ছা ও অভিলাষ। কবিতা লুকিয়ে রাখে সুক্তির বুকে মুক্তোর আলো। বেঁচে থাকার বাড়ানো হাত, ভেসে যাওয়ার সাহস ও বাহন...