মুস্তাফিজ শফি: ব্যক্তিত্বের উজ্জ্বল সমাহার
খাতুনে জান্নাত
.............................................
গড়িয়ে গড়িয়ে জীবন বহুদূরে চলে এলো। কখনো ডুবুরির মতো হারানো সুর অন্বেষণে, কখনো পাখির মতো মনের ডানা মেলতে মেলতে সীমায় পৌঁছানোর আকাঙ্ক্ষা, উদ্যম ও ডানা কেটে দেয়ার বেদনাবাহী হয়ে। পথ চলতে চলতে কখনো বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে আলো ধরতে হয়। একলা চলার সাহস ও সঞ্জীবনী কুড়ায় মনের উদ্যমে উৎকণ্ঠাকে হারিয়ে দিয়ে। আমার এ চলার সাথে আপনত্বে জড়িয়ে থাকা একটি নাম মুস্তাফিজ শফি। নস্টালজিকতার সলতে উস্কে দিয়ে রোমন্থনের গভীর তলদেশে ভাঁজ করে রাখা দিনগুলোর ভেতর উঁকি দিলে যে আত্মকথন তা প্রেম-প্রতারণার পরও বেরিয়ে আসে কটি হিরক খচিত দিন। তেমনি দিনের আলোছায়া মায়াময় একটি মুখ যার নাম মুস্তাফিজ শফি, আমরা ডাকতাম মোস্তাফিজ । আমাদের জীবনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার একান্ত অংশীদার; তার ভাইয়ের কারণে পরিচয়ের সূত্র হলেও ভাবীর সম্পর্কের পরেও এক মানবীয় বুনন সমৃদ্ধ জীবনের গুঞ্জন আলাদা সত্তা হয়ে গান গেয়ে ওঠে। কণ্টকাকীর্ণ জীবনের কতগুলো দিন কেটেছে তার ঘর ও আবাস ঘেঁষে অন্তহীন। অস্থির জীবনের পাশে সহমর্মিতার ছায়া ও তা থেকে উত্তরণের অবিরাম প্রচেষ্টা করে যাওয়ার মহত্ত্ব রয়েছে তার মধ্যে। তা কখনো আবেগ জড়িয়ে বেদনার ভারে একেবারে আবৃত হয়নি বলা যাবে না।
মুস্তাফিজের মুখের গঠন আকর্ষণীয় উজ্জ্বল ও মায়াবী-- বুদ্ধিদীপ্ত প্রশান্ত চোখ; প্রথম দর্শনেই দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতো ব্যক্তিত্ব ও ইনোসেন্টন্যাস রয়েছে তার বাহ্যিক অবয়বে। ব্যবহারে ততোধিক মায়াবী আপনত্বের গভীর বাঁধনে বেঁধে রাখার এক অতিলৌকিক ক্ষমতা আছে তার। যদিও আড়ম্বর বা হৈ চৈ ফেলার মতো চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তার নয়। নিজস্ব ব্যক্তি জীবনও সাজিয়েছে আপন ইচ্ছার তুঁতি গেঁথে; বিড়ম্বনাহীন সুস্থির সরল রৈখিক জীবনধারা। যেখানে নেই ভাঙনের কোন পদধ্বনি। প্রতিষ্ঠিত তথাকথিত ব্যক্তিদের মতো মনের আলোকে হারিয়ে যেতে না দিয়ে চর্চা করে যাচ্ছে মানবিকতার সুর; মানবিকতাকে দলিত মথিত হতে দেখে তার কলমে ফুটে উঠে প্রতিবাদ ও অগ্রসরমান সাহিত্যরশ্মির জীবন গীতিকা। তার ভাষা তার মতোই নীরব বহমান কুলকুল স্রোত। তাই তো পারিপাশ্বিকতার সাথে সম্পর্ক হারিয়ে হারিয়েও রয়ে যায় অনন্য একচ্ছত্র বিমূর্ত-মূর্ত মায়ার বন্ধন।
শাহবাগের পাবলিক লাইব্রেরীর প্রশান্ত সজীবতায় ( বর্তমানে যার নাম গণ গ্রন্থাগার) প্রথম দেখা হয় তার সাথে ১৯৯০ সালে। তখন তার পরিচয় আমার কাছে ছিল কবি। তার সাথে পরিচয় ও এগিয়ে যাওয়া দিনগুলো গুণন করলে অতিদীর্ঘ তালিকা হয়ে যায়।‘ ভালোবাসা ভাবা যায় কেবল কবিতায়/ এই হোক এই যেন একটি কবিতা।/ তার একটি সে সময়ে লেখা কবিতা তার বোনের বিয়ের স্মরণিকায় প্রকাশ এখনও মাথার ভেতর হতে মনের গুঞ্জনে গুনগুন করে। ` তখন সে পড়ালেখার পাশাপাশি ‘সিলেটের ডাক' পত্রিকায় কাজ করত। আবাসস্থল নিজস্ব জন্ম ঠিকান :
সিলেট জেলার বিয়ানিবাজার উপজেলা ও লাউতা ইউনিয়নের আষ্টসাঙ্গন গ্রাম। তারপর ঢাকায় লালসবুজ, আজকের কাগজ তারপর প্রথম আলোসহ আরও অনেক দৈনিক পত্রিকা। প্রতিষ্ঠিত অনেক পত্রিকার ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে তার সক্রিয় ও সচেষ্ট সহায়তায়। বর্তমানে থিতু হয়েছে সমকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হয়ে। শুধু কাজের প্রতি একনিষ্ঠতা ও কঠোর শ্রম ও সহৃদয়তা তাকে তিলে তিলে সফলতার শিখরে তুলে দিয়েছে।
মুস্তাফিজ শফি পঞ্চাশ বছরে পা দিয়েছে-- তার এ পঞ্চাশকে নিঃসন্দেহে আখ্যা দেয়া যায় ‘সফল-সমৃদ্ধ পঞ্চাশ। জন্ম ২০ জানুয়ারি ১৯৭১। সে হিসাবে বাংলাদেশের বয়সের সমান বয়সী সে। এ বছরই ২৬শে মার্চ বাংলাদেশ পঞ্চাশ পুরণ করবে। সাংবাদিকতার পাশাপাশি সাহিত্যের সব শাখায় অবাধ বিচরণ তার। এ থেকে বোঝা যায় মনে মননে সে লালন করে সাহিত্য, লালন করে শিল্প। সাংবাদিক হিসাবে মুখ্য পরিচয় ধারণ করে চললেও একাধারে কবি, সাহিত্যিক, গবেষক। সেখানেও রেখেছে উজ্জ্বলতর লেখকের ছাপ। তেমনি জীবনবাজি রেখে প্রতিবেদনের আন্তরিকতায় সমাজের পতিত শ্রেণিকে তুলে এনেছে চকচকে জীবনের সমরূপতায়। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে এ সমাজ তথা দেশের গভীর ক্ষত। পতিতাপল্লী, ডোম ও পোস্টমর্টেম ও মুক্তিযুদ্ধের বীরাঙ্গনাদের জীবনকাহিনী নিয়ে বই তার ঝলঝলে সাক্ষ্য বহন করে। কবিতায় এক অনন্য রুপশ্রী সৃষ্টিকারী বেদনাঘন মন নিয়ে জীবনের কাটাকাটি করে। প্রেমের অধীর আকুলতার পেছনে দেখে বিরহের-দহনের হাঁসফাঁস। মন উড়ে যাবার বা হারিয়ে যাবার ব্যগ্রতায় ব্যাকুল। মানব মনের অন্তর্নিহিত যন্ত্রণা বা কুয়াশা কবিতার অক্ষরে প্রস্ফুটিত হয়। স্মৃতির অমল কমলে হারিয়ে যায় ও তুলে নিয়ে আসে খণ্ড খণ্ড পরাগ ও পাপড়ি আর হারানোর ঘন-ক্ষত মিশ্রিত চিত্রের জালে আঁকা এক বিমূর্ত ক্যানভাস।
‘এখানে মায়াগুলো গোল হয়ে বসে সমাবেশ করে
...
নক্ষত্রের মাঠে, রাইফুলের ক্ষেতে তারা গড়াগড়ি যায়
..
এভাবেই খরস্রোতা নদীগুলো মাছেদের স্বপ্ন ভালোবাসে।’
অথবা
‘চলো আজ উচ্ছাসে পান করি সমুদ্রের গর্জন।’ ‘চলো আজ খেলি মরীচিকা মরীচিকা’
শালিকের ডানায় তুমি বেঁধেছ শাড়ির আঁচল
আমি শুধু বরুণের ডালে দুপুরের চঞ্চল রোদ
“ পড়ো তোমার প্রেমিকার নামে” দিয়ে যাত্রা শুরু কবিতার। তারপর দহনের রাত, মধ্যবিত্ত কবিতাগুচ্ছ, কবির বিষণ্ণ বান্ধবিরা’
কোলাহল গেছে সব যাক
আমি শুধু পুষে রাখি গভীর গোপন ঢেউ
লুপ্ত দিনের শেষে প্রত্নের খোঁজে
হয়তো আসবে কেউ...

উপন্যাসও জীবন ঘনিষ্ঠ, জীবনের তলদেশ স্পর্শ করার প্রচেষ্টা রয়েছে তাতে। ডোমদের উপজীব্য করে লেখা উপন্যাস“ জিন্দালাশ ও রমেশ ডোম” এ দেখতে পাই মর্মস্পর্শী সত্যকথন--
“ লাছের বুকে ছুরি চালাইতে চালাইতে আমরা তো হালায় ছার জিন্দা লাছ হইয়্যা গেছি। আমাগো কোন জীবন নাই এ মর্গই আমাগো ঘর আমাগো ছংছার।’ জীবনের তলদেশে জমে থাকা ক্ষত বেরিয়ে আসে শাশ্বত উচ্চারণে-
‘আমরা কেবলই চাপা পড়ে যাই লাশের পাহাড়ে।’
তার ভাষায় তার উপন্যাসে “স্বপ্নময় সমাজ নির্মাণের আকাঙ্ক্ষা খুঁজে পাবেন পাঠক।” প্রথম উপন্যাস ঈশ্বরের সন্তানেরা’ এ সমাজের অবৈধ সন্তানদের ঈশ্বরের সন্তান নামে পরিচিত করার সাহস ও মানবিকতাবোধ রয়েছে তার মধ্যে। কাজের পরিসর যদি হয় জীবনের আঁকবাঁক অন্বেষণ ও উদঘাটন, সংবাদের রহস্য উন্মোচন ও পরিমার্জন। তখন লেখনিও বাস্তবতার হাত ধরে কল্পিত অবয়বে সত্তা হয়ে দাঁড়ায়। তাঁর উপন্যাস ও গল্প সজীবতায় নির্মিত সমাজকথন। কোন কোন উপন্যাস তো সংবাদ সংগ্রহের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছে। প্রোথিত, নির্মিত ও গ্রন্থিত হয়েছে। এ যেন সামাজিক বৈষম্য ও দ্বান্ধিকতার অবয়ব খুলে মানবিকতার শ্বাস ফেলা। মানুষের মানবিক চাওয়া-পাওয়া, প্রচেষ্টা ও না পাওয়ার হাহাকারের অবিমিশ্র সফল রূপায়ন। সাহিত্য ও জীবন সমরূপতায় মিশে গেছে এক পরিমার্জিত ভাষা, চিত্রকল্প, উপমা, উৎপ্রেক্ষা, অলঙ্কারের সার্থক রসায়নে,
যাতে দেখা যায় পরিপক্ষ পদক্ষেপ প্রক্ষেপণে সংমিশ্রণ।
শিশুদের জন্য গ্রন্থিত হয়েছে মানবিক বোধে উজ্জীবিত ভূতপদ্য ও গল্প। ভূতের সঙ্গে পদ্য ও এই ভূত ভালো ভূত বা মায়াবী ভূত কন্যা। তার মতে বাস্তবতায় ভূত না থাকলেও তা রয়েছে আমাদের কল্পনায়। তাই তার ভূত ভয়ের প্রতিচ্ছবি নয়। ভূতেরা সমাজের ভালো কাজ করে বেড়ায়। শিশুদের অনিবার্য বন্ধু হয়ে যায়। চিন্তাটা নিঃসন্দেহে নতুন অনুকরণীয়...
“মিলে মিশে হেসে খেলে
হেলেদুলে সদ্য,
ভূতের সঙ্গে বসে বসে
লিখব নতুন পদ্য।
পদ্যগুলোর সাত মাথা
সাতরকম মত,
পদ্যগুলো স্বপ্ন দেখায়
সামনে চলার পথ।”
আর এ কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ পেয়েছে অসংখ্য পুরস্কার। যদিও পাঠকের ভালোবাসা, বইয়ের প্রতি মনোযোগ ও পাঠের আগ্রহই লেখকের সবচেয়ে বড় পুরস্কার। তার বই অন্তর্ভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচীতে। তার ১৪টি গ্রন্থের রয়েছে বিশাল পাঠককুল। । পৃথিবী বিখ্যাত বা সুখ্যাতদের চিত্রকলা সংগ্রহ করা তার সখ ও লব্ধ। আর সংগৃহীত সজীব বৃক্ষ, লতাগুল্মে সাজিয়ে রাখা নিজস্ব ঘর ও অফিসগৃহ।
সম্পর্ক যাইহোক, যেভাবেই নির্মিত হোক অতি আপন এক মাধুরিমাময়, আত্মার আত্মীয় ভাবনার অনুকুলতা সাথে নিয়ে এগিয়ে গেলে সবকিছু ছাপিয়ে আমার কাছে ব্যক্তি স্বাতন্ত্রে উজ্জ্বল ও মননশীল, ব্যক্তিত্বে সমুজ্জ্বল মুস্তাফিজ শফির মানবিক ভাই বা বন্ধু পরিচয় বড় হয়ে উঠে। তার সার্বিক সফল জীবনের কামনা রইল।