বছর ঘুরতে সাগর রাক্ষস ফুঁসে ওঠে
তছনছ করে চরের নরম ঘর, শিশুর কল হাট
ডুবে যায় নোনা জলাধারে
দুঃখময় জীবনের অবশিষ্ট পাঠ।


জীবনের আরেক নাম সংগ্রাম। তিলে তিলে সংগ্রহ করে মানুষ সম্পদ; তেমনি বছর বছরের আদর ও সৌহার্দ জমিয়ে তৈরি হয় সম্পর্ক। হঠাৎ হঠাৎ সাগরের ফুঁসে ওঠা জলোচ্ছ্বাস বা ঘূর্ণিতে বিধ্বস্ত হয়ে যায় সে জীবন যে কটি অঞ্চলের নোয়াখালী  তাদের অন্তর্ভুক্ত। এ দুর্বিপাক তাদের দমিত না করে জীবনকে গড়ার প্রত্যয়ে উদ্দীপ্ত করে। তারা কাজ করে, সঞ্চয় করে কখনো কখনো সে কাজ করতে গিয়ে অপরকে আহতও করে খেয়াল না করেই।


নোয়াখালী প্রাচীন সমতট জনপদের একাংশ। তার পূর্ববর্তী নাম ছিল ভুলুয়া। এখানকার লোক সংস্কৃতি বা লোক সাহিত্য অন্য অঞ্চলের তুলনায় অনেকটা সমৃদ্ধ এবং জীবন ঘনিষ্ঠ; তা এ অঞ্চলের প্রবাদ-প্রবচন, আঞ্চলিক গান, মুখে মুখে ফেরা কবিতা, ধাঁ-ধাঁ, ছড়া থেকে সহজেই অনুমান করা যায়। কৃষি, পশু ও মৎস্য পালন এলাকার মূল পেশা। লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, ফেনী এ তিনটি অঞ্চল ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকে আগে এক ছিল। যার নাম ছিল নোয়াখালী। বর্তমানে রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে তিন ভাগে বিভক্ত হলেও হৃদ্যতা, চলন, আত্মীয়তা ও স্বভাবজাত ভাবে এক। এখানের ভাষা, ঐতিহ্য ভিন্ন-এক বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। তেমনি লোককথা, উপকথার অতুলনীয় ভাণ্ডার রক্ষিত রয়েছে এর অন্তঃকরণ। সাগরের কোলঘেঁষা এ অঞ্চলের মাটি ও মানুষ; একদিকে সৌন্দর্যের অফুরন্ত ভাণ্ডার আম, জাম, নারিকেল, সুপারির ছায়াঘেরা বন ও বাগিচা অন্যদিকে ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, নদী ও ভাঙন এখানকার জন জীবনের অংশ; এ  ভাঙন-গড়ন মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করছে, প্রবাহিত করছে মনোজগৎ। তৈরি করছে সাংস্কৃতিক প্রবাহ।


এ অঞ্চলের মানুষ কাজের ফাঁকে বা অবসরে গল্পে বা কথায় ছড়া কাটে, কৌতুক করে, কবিতা সাজায়। সহজাত রসিকতা জনজীবনের একাংশ। এ কৌতুক বা রসপ্রিয়তা প্রভাবিত করে উজানি সময়কে; পরস্পরের প্রতি সহমর্মিতা, আতিথ্য, আন্তরিকতা, জোটবদ্ধভাবে এগিয়ে নিয়ে চলছে বৃহত্তর নোয়াখালীর জনগোষ্ঠীকে।  সব মিলিয়ে এ জনগোষ্ঠী ভিন্নভাবে ভাষার ভিন্নতর চাঞ্চল্য ও সৃষ্টি আনুকূল্যে উপস্থিত সমগ্র বাংলাদেশে, বিশ্ব পরিবেশে।


পূর্ববর্তী সময়ে  শিশুরা নানা আঞ্চলিক শ্লোক বা ছড়া গানের মাধ্যমে খেলাধুলা করত। শিশুদের আনন্দে ভরিয়ে রাখাও ছিল বড়দের কাজ। সব ছড়া-কবিতায় জড়িয়ে থাকে আন্তরিকতা ও বিনোদন সম্ভার। ঘর, ঘরের বৈঠকখানা, বাড়ির উঠান জুড়ে নিজ-বাড়ির বা পড়শী বাড়ির শিশু ও কিশোর বা কিশোরীরা ঝাঁক বেঁধে সুর ও ছন্দে ভরিয়ে তুলত। এ খেলাধুলায় বড়দেরও সায় থাকে। এ গদ্যে সে ছড়াগানগুলোকে উপস্থাপন করার প্রয়াস। এখানের ছড়া মানেই  যেন গান। সুরে সুরে মুখরিত করার প্রয়াস। এক মনোজ্ঞ  আন্তরিকতা ও হৃদয়গ্রাহী উপস্থাপন। কবে কখন এ ছড়াগুলোর আবির্ভাব তা জানা যায় না। তবে ছড়ার বাণী ও সুরই এর ইতিহাস ও বর্তমান।


১.
আঙ্গো লেদি বালা
আদরের তালা
মা কয় কু চালা
বাপে কয় বিয়া দি হালা...
উল্লেখিত শ্লোক বা ছড়াটি মেয়ে শিশুকে কেন্দ্র করে। অর্থাৎ মেয়েটি আদরের তালা যদিও জ্বালাচ্ছে। মা তাকে কুচালা মানে খারাপ স্বভাবের বলছে ; বাপ বলে বিয়ে দিয়ে ফেলো।  এটা রসের। ছোট বাবুটি গানের সুরে ভুলে যায় কান্না। যোগ দেয় সুরে- হাসিতে- আনন্দে। এটা রসের আবর্তনে আবৃত হলেও ভেতরে গভীর বেদনাবোধ রয়েছে কোথাও যা খুব বিরহ ভোরের মতো প্রাণে মোচড় মারে...


২.
‘ঝিঁয়া ঝিঁয়া হেলা খাইতাম গেছিলাম
কাঁডা হুঁড়ি মইচ্ছিলাম
কাঁডায় লইলো শুলানি
বুইড়ায় দিল দৌড়ানি
কিরে বুইড়া দৌড়াস কা?
ওগ্গা বৌ বারা বাঁধে
আরুগ্গা বৌ চিঁড়া দোয়
চিঁড়াত কা ধান?
চুলো দরি টান
চুল কা কালা?
নাক কাডি হালা
নাকো কা কালি?
চ্ছিঁয়াবিঁয়ার হালি।।


এটা একটা খেলা। বাচ্চারা গোল হয়ে বসে উঠানে সমস্বরে এসব ছড়াগান গায়। একজনের হাতের পিঠে আরেকজন চিমটি দিয়ে ধরে ও সবগুলো হাত উপরের দিকে এক চমৎকার চিমটে ধরানো শিকল যেন। গান উদ্দেশ্যহীন হলেও এ গানে জীবনচিত্র উজ্জ্বল। হেলা শুদ্ধ হলে পেলা এটি অনেকটা বটের মতো দেখতে গোলাকৃতি ছোট টক-মিষ্টি ফল। ঝিঁঝির ডাকের ভেতর যে যাওয়া হয়তো সন্ধ্যা বা রাতে   কারো পেলা গাছ থেকে পেলা চুরি করতে গিয়ে  কাঁটা ফুটায় ও মালিকের তাড়ানো খায়। সে দুঃখে সে মালিকের বৌদের কর্মকাণ্ডের খিস্তি। এক বৌ ধান ভানে আরেক বৌ চিঁড়া কুটে। চিঁড়ায় ধান থাকার কারণে চুলোচুলি হয়। ছড়াটির শেষে আরেকটু অংশ থাকে। সকলে পাটিতে বা মাটিতে উপুড় হাত চ্যাপ্টা করে ফেলে রাখে। একজন সে হাতাগুলোর উপর নিজস্ব হাত ম্যাজিক দেখানোর  মতো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বলে, ‘চুনের হোঁডা চাঁত’।’ সাথে সাথে উপুড় হওয়া হাত চিৎ হয়ে যায়। দৃশ্যটা অসাধারণ। তারপর হাতের আঙুল খাড়া ও গোল করে সামনে রাখে সকলে। একজন আঙুল দিয়ে একেক জনের হাত দেখিয়ে বলে,
‘-এডা কী
-ঝুমঝুমি(সমস্বরে)
-ধর শালার কান টানি
-এডা কী
-ঝুমঝুমি(সমস্বরে)
-ধর শালার কান টানি।’


সবাই অন্যের কান টেনে ধরে কিছুক্ষণ ঢুলতে থাকে, মৃদু ব্যথা ও আনন্দে  হাসির ফোয়ারা ছুটিয়ে  খেলা শেষ হয়।


৩.
খেজুর পাতার মাঝখানের নরোম অংশ ছিঁড়ে ছিঁড়ে  একটার ভেতর আরেকটা ঢুকিয়ে মাঝখানে একটা ছোট কাঠি দেয়া হয়। দু জনে দুদিক থেকে
দু্ই হাতে পাতার অগ্রভাগ  টানে আর গায় নিচের ছড়াটি। এটা মূলত দুইজনের খেলা। উঠানে পাটি বিছিয়ে বা পাকা বৈঠকখানা, মসজিদের পাকাথানে অথবা কাছারি ঘর বা ঘরের সিঁড়িতে পা ছড়িয়ে পায়ের আঙুলে মাঝের ছোট লাঠি আটকিয়ে এ খেলা হয়। গানের সাথে সাথে মাঝে রাখা সরু লাঠিতে জমতে থাকে খেজুর পাতার সুতা। সে সুতা কারও কাজে লাগুক বা না লাগুক মুখরিত সময় টা উপভোগ করে উপস্থিত অন্যরা। এতে বাচ্চাদের মনে সংগীতের স্পৃহা ও সাহস জাগায়। শিশুকাল ও পরিবেশ মুখরিত থাকে আনন্দের বানে। দুজন একসাথে গাইতে থাকে...


“চরকা চরকা হুতা কাড
কাইল বেয়েনে নগর আঁড
নগর আঁডো যাবি নি
বাঁডা মাচ্ছ কিনবি নি
বাঁডা মাচ্ছের তেলে
মোমবাত্তি জ্বলে
কোনাই কোনাই জ্বলে
সিরি গাছের তলে
সিরি গাছের অগ্গা হাতা
ঝিকমিক করে
বড়মিয়া গো বেরা গো
হালকি লই আইও গো
হালকির বিত্তে যুগীর মাইয়া
যুন্নুর যুন্নুর করে...'


চরকায় সুতা কেটে পরবর্তী দিনের শহুরে হাটে যাবে ও হাট থেকে বাঁডা মাছ কেনার আগ্রহ; যে মাছের অতিরিক্ত তেলে মোমবাতি জ্বলবে-  সিরি গাছের নিচে। সিরি গাছের একটা পাতা ঝিকমিক করে। তার ভিন্নসুর ও চিত্র। বড়মিয়াদের বেয়ারারা যে নাচুনে মেয়েদের নিয়ে আসত, তাদের বলা হত যুগি। পালকির ভেতর যাদের পায়ের ঘুঙুর ঝুনঝুন বাজে। এসব ছড়া গান বিচিত্র সুরের মাধুর্যে অপরূপ চিত্রকল্প তুলে ধরে। কিছুটা ধনীদের বা বড় মিয়াদের জন্য খোঁচা। সমাজ জীবনের ছন্দ দোলা আশা উদ্দীপনা জাগায় মনের অন্তকূহরে যা সত্যি চমকপ্রদ।


৪.
একছি বেকছি কাগুজি
কাগুজির গন্ধে
খোঁপা নিছে নন্দে


ননদ ভাবীর রসের কাড়াকাড়ি। অতিরিক্ত মজার জন্য ননদেরা ভাবীর সাথে মশকরায় লিপ্ত থাকে। এটা-সেটা লুকিয়ে রাখে; ছো মেরে নিয়ে দৌড় দেয়। ভাবীকে বোকা বানানোর মজা। ননদ ভাবীর আনন্দ কৌতুকের ভেতর দিয়ে পূর্ণতা পায় গৃহস্থালি।


৫.
প্রশ্ন উত্তরের এ খেলা সহজাত শিশুদের আনন্দ আর স্বতঃস্ফূর্ত উজ্জ্বল চিত্র। কখনো কখনো ছোট শিশুদের ভাঁজ করা পায়ে তুলে দোলনার মতো দুলিয়ে দুলিয়ে ছড়ার এ গান উচ্চশব্দে গাওয়া হয়। যখন ছড়াগান শেষ হয় ডিঁ ডিঁ ডিঁ ডিঁ বলার সময় হাঁটু দিয়ে শিশুর পেটে কাতুকুতু বা সুড়সুড়ি তোলা হয় শিশু হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে। কখনো দুই জনের বা দুই দলের প্রশ্ন-উত্তরের  বুনন-গাথা গ্রামীন এ কাব্যের সমাহার।


“-বাঁডি বাঁডি দা দে
-দা কিত্ত?
-বাঁশ কাটতো
-বাঁশ কিত্ত?
-গর তুইলতো
-গর কিত্ত?
-বুড়ি থুইতো
-বুড়ি কিত্ত?
-খইলতা চ্ছিলাইতো
-খইলতা কিত্ত?
-টিঁয়া থুইতো
-টিঁয়া কিত্ত?
-গোঁড়া কিনতো
-গোঁড়া কিত্ত?
-হরীর হউর বাইত যাইতো
-কোনদিক দি?
-উরে গো দূরে দি
বেল গাছ তলে দি
অগ্গা রাতা দেখছ নি?
-দেখছি
-দুধভাত খাওয়াইচ্ছো নি?
-খাওয়াইচ্ছি
-অন বোলাইলে জব দিব নি?
-দি বো
-কুক্কুরুকুক কুক্কুরুকুক
ডিঁ ডিঁ ডিঁ ডিঁ


একজন আরেকজনের কাছে খা টো দা চায় যা দিয়ে বাঁশ কাটবে ও ঘর বানাবে। সে ঘরে বুড়িকে রাখবে যে টাকার থলি সেলাই করবে। সে টাকা দিয়ে ঘোড়া কিনবে; ঘোড়া হরীর শশুর বাড়ি যাবে। উরেদের দূূর দিয়ে,  বেল গাছের নিচ দিয়ে ; যেখানে একটা মোরগ রয়েছে।  যাকে দুধভাত খাওয়ানো হয়েছে। যাকে ডাক দিলে জবাব দেয় কুককুরুকুক। এটা ছেলে শিশুদের উদ্দেশ্য করে বানানো হয়েছে যেহেতু ঘোড়া চড়ে শশুরবাড়ি  যাবে সে।  যা অফুরন্ত আনন্দের উৎস হয়ে গ্রামের প্রাণকে মুখরিত করে রাখে। হরণ করে রাখে মুহূর্ত।


৬.
মায়ের কাছে শিশুর আব্দার এবারের ছড়া। মাকে কেন্দ্র করে এ ছড়াটি রচিত। যা সুরের অপরূপ নান্দনিকতায় ভরপুর। মায়ের কাছে শেখা বোল শিশুরাই নিজেদের মধ্যে বিনিময় করে।  বিনিময় করে সখ্যতা, বিনিময় করে হৃদ্যতা।


“মাগো মা-
মালা দেন খেলাইতাম,
বাঁশি দেন বাজাইতাম
বাঁশির বিত্তে কদুর দানা
টিপ দিলে কয় ডাক্তরখানা
ডাক্তরখানা বৈরাগী
আঁ-রে এককান জিরাফি
জিরাফি খাইতে মিষ্টি লাগে
হইসা দিতে কষ্ট লাগে...'


নারিকেল কোটার পর যে খোলস  পড়ে থাকে- এটাকে মালা বলা হয়। বড়রা আগুন জ্বালাতে ব্যবহার করে। এটি দিয়ে ছোটরা রান্নাবান্না খেলে। নারিকেল পাতা দিয়ে বানানো হয় বাঁশি। ছড়া যেন জীবনের স্তর ভেদ করে।  ডাক্তারের চিকিৎসার প্রতি একধরনের শ্লেষ। অথবা নিছক শিশুদের আবোলতাবোল বোল। বাঁশির ভেতরে লাউয়ের বিচি যা টিপলে ডাক্তার খানার কথা বলে। ডাক্তার খানাকে বৈরাগী বলা হচ্ছে।  মানে চিকিৎসার সুযোগ নেই।   তাই তো ঔষধ নয় খেতে চায় জিলাপি। জিলাপি খেতে মজা ও টাকা দিতে কষ্ট লাগার কথা।  এখানে খাদক বা কৃপনের ইঙ্গিত বা খোঁচা ধরে নেয়া যায়। যা অন্যদিকে অনটনবাহী পরিবেশে পারস্পরিক দ্বন্দ্বকেও স্পষ্ট করে। সব ছাপিয়ে চলে সুরের মোহনা, সুরের ব্যঞ্জনার অপরূপ গুঞ্জন ।


৭.
বৃষ্টি -বাদলা নোয়াখালী অঞ্চলের জীবনযাত্রার সাথে অঙ্গাঙ্গিভাব জড়িত।  প্রাকৃতিক কারণে বেশি বৃষ্টিপাত ও তা ফসল উৎপাদন ও ফসল কাটাতে প্রভাব বিস্তার করে।  এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবারের আঞ্চলিক ছড়াগান  বা গীতিকা।


জড়ি আইয়েরে তুরুল্যা
হাঁতরে খেঁতে বদিল্যা
ইঁছা গুঁড়ার সসিন্দা
হায়রে আমার বদিল্যা


বৃষ্টি আসলে তুরুল্যা ডাক ছাড়ে। কাঁচা ঘরের পৈঠা বা পিঁড়ায় তাদের বসতি। এর সাথে ক্ষেতে কর্মরত   দিনমজুর। যাকে খেতে দেয়া হয় চিসিঙ্গা ধরনের তরকারি ও ছোট চিংড়ি। দিনমজুরের জীবনের কষ্ট বিধৃত এ গীতিকায়...যদিও ঝড়ো বৃষ্টিতে ঘরে বন্দি শিশুদের সমস্বরে গাইতে শোনা যায় এ ধরনের ছড়া...


৮.
পরিপূর্ণ রসাত্মক ও শ্রুতিমধুর পরবর্তী এ ছড়ার পালা। একজন আরেকজনকে পরাস্ত করার প্রতিযোগিতা। যে পালায় উঠে এসেছে গ্রাম, ঘর, গেরস্থালী,  হালচাষের এক মায়াময়ী জীবনচিত্র। এখানে এ রহস্যময় পালায় যেন বোঝায় জীবন এক প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র ভূমি। এখানে সুখ আছে, ব্যথা আছে, আছে  বিজয়ের আনন্দ ও পরাজয়ের গ্লানি। এটিও প্রশ্ন-উত্তরের ফাঁদে আবদ্ধ। এলোমেলো প্রশ্ন ও ততোধিক এলোমেলো উত্তর। প্রতিপক্ষকে আটকে দেয়ার ফাঁদ পাতা আর প্রতিপক্ষ তার থেকে বেরিয়ে পড়ার কৌশল রপ্ত করার কারুকাজ ঠাঁসা এ দীর্ঘ ছড়া রসালো ও আনন্দদায়ক এবং সংগ্রামী জীবনালেখ্য।


'-এককান কতা
-ব্যাঙের মাতা
-কী ব্যাঁঙ?
-সরু ব্যাঙ
-কী সরু?
-বামন গরু
-কী বামুন?
-বুড়া বামুন
-কী বুড়া?
-বাঁশ মুড়া
-কী বাঁশ?
-মুলি বাঁশ
-কী মুলি?
-দুয়ার খুলি
-কী দুয়ার?
-মইদার দুয়ার
-কী মইদা?
-বালা মইদা
-কী বালা?
-বইরের নালা
-কী বইর?
-নাকের খইর
-কী নাক?
-রাতার বাঁট
-কী রাতা?
-চিরা খেঁতা
-কী চিরা?
-শিন্নি চিরা
-কী শিন্নি?
-গরু কিনি
-কী গরু?
-আলের গরু
-কী আল?
-চ্ছাগলের  খাল
-কী চ্ছাগল?
-হুরা হাগল।'


একটা কথা তাকে দমিয়ে দিতে বলা হয় ব্যাঙের মাথা কিন্তু না দমে সে বলে, কী ব্যাঙ? উত্তর- সরু ব্যাঙ। কী সরুর উত্তরে বামুন বা ছোট জাতের গরু। কী বামুন? উত্তর বুড়া বামুন। সেখান থেকে বাঁশমুড়াতে চলে যাওয়া- যে বাঁশ মুলি বাঁশ। যার অন্তমিল দুয়ার খুলি দিয়ে যে দুয়ার বানানো হয় তা সুপারি গাছের পিঠের অংশ দিয়ে যাকে বলে মইদা।  ভালার সাথে অন্তমিল পায়ের নালা। যার সাথে নাকের শুকনো ময়লা। নাকের সাথে মোরগের মাথার ঝুটি। তার সাথে ছেঁড়া কাঁথা। কী ছেঁড়া শিন্নি ছেঁড়া সে এক অদ্ভুত শব্দঝুঁটি। যার সাথে হালের গরু কেনা যার অন্তমিল ছাগলের খাল বা চামড়া দিয়ে এবং শেষে পুরা পাগল বানিয়ে  ঠকিয়ে দেয়া। পাগল বানানোর পর আর কথা চলে না... অনেকটা “বাঘারে বাঘা” খেলার মতো এক ডাল থেকে আরেক ডাল এক গাছ থেকে আরেক গাছে ছুটে চলা।   মজাদার এ ছড়াগান অত্যন্ত জনপ্রিয়। বাচ্চারা মুখোমুখি হলেই শুরু করে । পরিবেশ মুগ্ধ করে, কৌতুকে ঋদ্ধ করে।


এমনই আরো বহ মুখে মুখে প্রচলিত ছড়াগান উত্তরসূরিদের মধ্যে চারিত হচ্ছে। কে কখন লিখেছেন তা জানা যায় না। মানুষ অভিজ্ঞ হচ্ছে, প্রাণীত হচ্ছে। এসব সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত হওয়া অতি জরুরি। নয়তো হারিয়ে যাবে একদিন। বর্তমান ডিজিটাল যুগের বলয়ে শিশুরা এখন আর এসব খেলাধুলো মুখর নয়- তা পল্লিগ্রামে গেলে বোঝা যায়। উপরন্তু ধর্মীয় অতিপীড়ন ও অপরাজনীতির করাল গ্রাসের ফলে বাড়ছে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, মাদকবাজী। মানুষে মানুষে ব্যবধান বাড়ছে, বাড়ছে শিশুদের মাঝেও ব্যবধান। আগের সে গ্রাম দাপিয়ে বেড়ানো খেলাধুলা আর নাই। নাই বাড়ির, কাছারি ঘরের, ভিটা বাগান ও ক্ষেতের উতরোল ও প্রতিযোগিতার স্বরগ্রাম।   কমে যাচ্ছে একাত্মতা, আতিথেয়তা, সহৃদয়তা, আন্তরিকতা...