শব্দের মোড়কে দ্যুতি জমিয়ে চলা কবি তুষার কবির
খাতুনে জান্নাত
......................................................................


তুষার কবির ভালবাসেন প্রকৃতি।হৃদয়ে ও মননে লালন করেন ইতিহাস ও ঐতিহ্য।  কবিতার পথ পাড়ি দিয়েছেন দীর্ঘ। যদিও জীবনের পথ ততটা দীর্ঘ
নয়।বয়সের দিক থেকে তাঁকে এখনো তরুণ কবি বলা যায়। কিন্তু কবিতার বইয়ের সংখ্যার দিক থেকে তিনি পূর্ণ যুবক বা পরিপক্ব ।


তুষার কবির ডুবে থাকেন মোহময় এক ভাবের গভীরে। প্রকৃতির অগাধ সৌন্দর্যে ডুবে থাকা কবি লালন করেন এর সৌন্দর্য ও আবির। শুধু ডুবে থাকা নন তুষার সদা অন্বেষণ রত প্রকৃতির গভীরে কোন সূক্ষ্ম আলোকমালা ও নৈব্যক্তিক  আলোড়ন। প্রত্নতাত্ত্বিক যেমন খুঁড়ে খুঁড়ে আবিষ্কার করেন হারিয়ে ফেলা সৌধ ও নির্জনতা। কবিও তেমনি  মুগ্ধকর উপমা, রূপকল্প, জ্যোতির্ময় চিত্রকল্প আর গতির আবেষ্টিত রূপ পরিগ্রাহী কবিতার ছত্রে ছত্রে সাজিয়ে দেন  তার অনুভূতি, বোধ, বিভেদ, অভীপ্সা।


তুষারের কবিতায় ভেসে উঠে ষড়ঋতুর গান। ঋতু বৈচিত্র অবগাহনরত পরিব্রাজক কবি খুঁজতে থাকেন শীতের ঘুম, হেমন্তের চিঠি, বৈশাখের সারোদ। জীবনের রূপ অন্বেষণ রত কবির আঁজলায় উঠে আসে সন্ধ্যা নর্তকীর নূপুরের নিক্বন আর পাপে নিমজ্জমান নাবিকের পতনের দাগ।


কবির কবিতার শব্দান্বয়ষণে ভিন্নতার ছাপ। অনুপ্রাসের দারুণ দ্যোতনা কবিতার শরীরে শরীরে দ্যুতিমান। নতুন নতুন শব্দের আবহে নিরন্তর চমক সৃষ্টিকারী  কবি চলছেন আপন বলয়ে। কখনো অন্তঃমিলের আলোড়ন কখনো ভাবের গভীর আবেগ ও অনুভবের আলো বিচ্ছুরিত হতে হতে কবির কবিতা নিরন্তর ভ্রমণশীল। যিনি তৈরি করছেন ঘোর আর জীবন কুহক।তুষার কবির নস্টালজিকতায় ডুব দিয়ে জেগে উঠেন। ঘুম ভেঙে দেখেন
"খুলে যায়  ঝিনুকের রাতচেরা গান!
স্মৃতিগুলো বিশদ হাতড়ে
খুঁজে পাই সেই রক্তঘুম- কোরকের ওম-
....
পদ্মভাসা সরোবরে খুঁজে পাই
ভেজা স্তনগুচ্ছ, যোনিমুক্তো;
কোমল কাঁচুলি খুলে বের হয়
বর্তুল মাংসের আভা...”


নারীর শরীর যেন জীবন ও তার উৎসস্থল। সাংসারিক বেষ্টনীর বাইরে নারী এক শিল্প ও শিল্পের স্মারক। এখানে প্রাত্যহিক জীবন যেন বৈদিক জীবনস্পর্শে নির্বাণ স্তরে পৌঁছে লাভ করতে চায় মহাজাগতিক অবিনশ্বরতা---
তুষার কবির শব্দ বন্দনা করেন। অনুধ্যানিক দ্যোতনায় বেজে ওঠে পুনরাবৃত্তির আলয়ে--বনঘুঘুর পায়েল, ডাহুকির আর্তনাদ, অন্তর্বাসের ঘ্রাণ, জাহাজের মাস্তুল, রতির পালক, ধূলিমাখা খাম,  জলের দ্রাঘিমা, দূরের মাস্তুল, ময়ূরীর মনোলগ, ভ্রামণিক ভাঁটফুল, পালকের ওম, তিয়াশার তৃণলিপি, মেঘের ঘুঙুর, ঝিনুকের অনুষ্টুপ্‌,  কোরকের ওম।


কবির ভ্রামণিক পথ যেন আটকে দেয়া ঘেরাটোপের মতো পুরনো বৃত্তে হোঁচট খেতে খেতে এগিয়ে যাওয়া...
কবির কবিতা পাঠে পাঠক মুগ্ধ হয়ে উঠেন মনের আলো জেগে উঠে। কবিতার সাথে ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন ও অন্তঃর্জাগতিক রূপাস্বাদন করে শুদ্ধতার অমিয় সুধায় অগ্রবর্তী হন। তেমনি বেদনার ভাষাও অন্তর্গত বেদনায় মূহ্যমান হয়ে পড়েন।


‘ঘাসের ঘুঙুরে বেজে ওঠা
এই হর্ষ-হ্রেষা; মৃদু হাওয়ার স্বরলিপি
পুরনো পয়ার খুলে শুনতে কি পাওনা
অমুদ্রিত প্রেমগাথা;কীটদষ্ট পাতার গোঙানি’
...........কবুতর..(ঘুঙুর ছড়ানো ঘুম)


তুষার কবিরের কয়েকটি কবিতার বই আমি পড়েছি। তবে ভিন্ন নামের বইগুলোকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা কঠিন। শব্দ, ভাব, অনুভব  ও ব্যঞ্জনা যেন একসাথে মিলেমিশে  একটি মালা তৈরি করেছে। যার নাম কাব্যমালা। কোথাও গুঞ্জন কোথাও পীড়ন। কবির কবিতা বিষয়ে যে কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় তা হলো কবি শব্দ সচেতন ও ছন্দ সচেতন। খুব নিঃখুতভাবে ছন্দ নদীর স্রোতের অনুকূলে দাঁড় বেয়ে পাড়ি দিয়েছেন অলঙ্কারবাহী শব্দতরী কবি নিজেই তার কর্ণধার। বাংলা প্রাকৃত শব্দের পাশাপাশি অনেক সংস্কৃত শব্দও তিনি নিরলস ভাবে ব্যবহার করে গেছেন। তাঁর ভাষা  মোলায়েম ও মন দোলানো, স্নিগ্ধ ও রূপময়। তা কখনো কখনো ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ধারণ করে আরও মনোলোভা, অরুণ ও দৃশ্যময়। বিশ্ব ইতিহাসের অনুপম ধারায়ও প্রবাহমান।


তিনি যখন লেখেন,
‘জঙ্গলের পাশ ঘেঁষে হেঁটে যাই জংধরা পুরনো সাইকেলে চড়ে--নিজেকে যেন বা মনে হতে থাকে এক অলীক পিয়ন যে প্রেমিকের চিঠি হাতে নিয়ে ছুটে যাচ্ছে আফ্রোদিতির গহিন ডেরায়।’...(জঙ্গলে ও জোছনায় তাবু কাব্য)
আরেকটি উদাহরণ
“ এ বর্ষায় তুমি খোঁপায় কামিনী ফুলের মালা পরে অপেক্ষায় থেকো--ডাকপিয়নের সাইকেলের ঘণ্টিতে শুনে নিও অবাক দোতারা!’...(তাবু কাব্য)


এই যে সাইকেল ও পোস্টম্যান কখনো কবি নিজেই পোস্টম্যান কখনো অন্যে। তাঁর কবিতার শব্দের পূনঃরুক্তির মতো বাক্যেরও পূনরাবির্ভাব ঘটেছে বহু বার। আমার মনে হচ্ছে কবি ইচ্ছে করেই করছেন প্রিয় রূপ ও পরিচয় কে  পূনরোক্ত ও পূনরাবির্ভাবের মতো। কোন কোন শব্দের প্রতি, কোন কোন পরিচয়ের প্রতি দুর্বলতা থেকে থাকে কারো।কবিকে মনে হয় দুঃখ ও শোকগাথা ছুঁয়ে ছুঁয়ে তিনি ছুটে চলছেন। তিনি নন দুঃখে নিমজ্জিত বা শোকতপ্ত বা ভীতিতে সন্ত্রস্ত। অথবা প্রেমের অতলে ডুবে জীবন জয়ের অতলান্তিক সুখাবেশে হাবুডুবু। তিনি যেন ভাসমান তরী বা বিশ্ব ভ্রমনরত একজন পর্যটক বিশ্ব দেখছেন আর জমিয়ে রাখছেন শব্দখাম। আবার কবিতার চরণে চরণে গেঁথে দিচ্ছেন নিপুণ মিস্ত্রির মতো অথবা বাবুইয়ের মতো তন্তুময়। প্রাত্যহিক জগতের বাইরে যেন সে জগৎ সুর ও ধ্বনিময়। তাই তো তাঁর কবিতাগুলো ব্যক্তিকেন্দ্রিক  হয়েও যেন ব্যক্তি কোথাও রয়ে যায়।
একেক কবির লিখন, মনন, চিন্তন একেরকম। প্রত্যেকের রয়েছে নিজস্ব গতিপথ। কবি নিজের প্রয়োজনে নিজের গতিপথ পরিবর্তন করেন অথবা স্থির থাকেন আপন অক্ষে।  তা কারও ভালো লাগতে পারে কারো নয়। কবি চলতে থাকেন এবং চলতেই থাকেন...


কবির কুহক’ কবিতা দিয়ে শেষ করি।


‘এ যেন মুদ্রার ধ্বনি বৃষ্টি হয়ে ঝরে
পয়ার পেরেক ঝরে কবির খাতায়
জলের সরোদ বাজে ভাঁটফুল ওড়ে
বৃষ্টির মন্দিরা শোনো ডাহুক গ্রীবায়।


মেঘের জংশনে ওড়ে বিরিশিরি ঘুম
জারুল ঘুমের ঘোরে কবির জঠরে
সোমেশ্বরী কথা বলে কুমুদ কুসুম
হাওরে হরিৎ মেয়ে মেঘের কোটরে।


এ কেমন বৃষ্টিতে কাঁদে ঘুমের ঘুঙুর
টিনের চালের ধ্বনি জাগে মধুবালা
অলীক পিয়ন আসে ব্যথার দুপুর
কোরকের ওমে জাগে মহুয়ার পালা।


তবে কি বৃষ্টির কাছে শুনবে সানাই
পাথরের পার্শ্বচিত্রে যুবতী রোদন?
নদীতীরে শ্যামাচূড়া নদীর নাটাই
এবার শঙ্খের বুকে স্বাতীর কহন।


..........................................