রেলস্টেশন ছেড়ে মৌড়াইল মোল্লাবাড়ী পার হতেই,
এক স্নেহমাখা প্রৌঢ় কন্ঠ পেছন থেকে ডাকে আমায়।
কে তুমি বাবা? এই সাত সকালে কোথায় যাও?
সেই ডাকের মাঝে অদ্ভুত একটা মায়া ছিল,
আমি হাতের ভারি ব্যাগ সামলাতে সামলাতে
পিছনে ফিরে চেয়ে দেখি কবি আল মাহমুদ!
বসে আছেন মোড়ায়, চৌচালা ঘরের বারান্দায়,
চোখে ভারি চশমা, হাতে পেটমোটা বই।
বিহ্বলতা কাটিয়ে দ্রুত উত্তর দিই,
পাশের পাড়া কাউতলীতে থাকি আমি,
আমার দাদাকে আপনি চিনেন হয়তো,
কবি নজরুলের বন্ধু ছিলেন!
তা আপনি কেমন আছেন?
তাড়া না থাকলে বসে যাও একটু,
পাশের মোড়ার দিকে ইংগিত করে বলেন।
দৈব বাণীর মতো সে আহবান ফেরানো কঠিন।
আমি বসি তার পায়ের কাছে রাখা আসনে।
এতো সকালে এসেছো, ক্ষুধার্ত নিশ্চয়?
পরম আত্মীয়ের মতো জিজ্ঞাসা করেন।
আমার সম্মতি সূচক হাসি দেখে বলেন,
মা নতুন চালের ভাঁপা পিঠা বানাচ্ছে,
শোলমাছ আর লাউয়ের ঝোল দিয়ে ভালোই লাগবে।
আরো খাবারের ফর্দ শোনান তিনি,
তিতাসের তাজা শোল, আব্বা কাল সন্ধ্যায় এনেছেন।
আমি স্বপ্নের ঘোরের মতো তার কথা শুনি।
আমার মনে খটকা লাগে,
এখন দু হাজার বাইশ, দু হাজার উনিশে তো উনি…
আমার ভাবনা থেমে যায় তার কথায়,
আম্মার হাতের ছিটারূটি পিঠা খেয়েছো?
কৈ মাছের দু’পেয়াজা আর আর আমার বোনের
রান্না করা তাজা চিংড়ির মালাইকারী দিয়ে?


কথার মাঝে তার হাতের বইয়ের দিকে তাকাই,
এ যে দেখছি ডায়েরি, ভুলে বই ভেবেছিলাম।
ডায়েরির সব পাতা সাদা, লিখা নেই কোনো!
তা হলে এতো মনোযোগ দিয়ে কি পড়ছিলেন!
আমার দৃষ্টি দেখে তিনি বলে উঠলেন,
অনেক কিছু লিখার বাকি আছে, বুঝলে?
শ্যামনগরের কৈবর্তদের কথা,
গোকর্ণ ঘাটের কুলিদের কথা,
গয়না নৌকার মাঝিদের কথা,
বিশ্বাস অবিশ্বাসের দ্বন্দ্বের কথা,
বোয়ালিয়া বিলের শালুক, ইচা বৈচার কথা,
আমন ধান কাটতে আসা চৌরাদের কথা,
রসুলপুরের সব হারানো কিষাণের কথা,
আর ভরা তিতাসের শুষ্কতায় মরে যাবার কথা।
আমি যতই লিখি, সব পাতা সাদা থেকে যায়,
যতই কলম বদলাই, তবু সব সাদা থেকে যায়।
তুমি কি আমার হয়ে লিখতে পারবে?
একই শিকড় তোমার আমার,
একই কাঁদা জলে বেড়ে উঠা আমাদের।
তোমার না পারার কোনো কারন নেই!
তার কথায় ভয়ে আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে।
আমি বিনীত ভাবে বলি,
আমি অতি সাধারণ একজন,
কবিতার কিছুই জানি না, আমাকে দিয়ে হবে না।
তিনি জোর করে আমার হাতে ডায়রিটি গুঁজে দেন।
আমি যতই না বলি, ততই তিনি কাঁপা কাঁপা হাতে
চেপে ধরেন আমার হাতের কব্জি।
ডায়েরি হাতে আমি বিড়বিড় করে বলতে থাকি,
হবেনা, আমাকে দিয়ে কবিতা হবেনা।
হঠাৎ চৈতন্য ফিরে পরিচিত এক কিশোরের ডাকে,
কাহা, সক্কাল সক্কাল গোরস্থানে কি করেন?
ঢাকা থেইক্কা কহন আইছেন?
তাইতো!
আমি অবাক হয়ে দেখি,
বসে আছি দক্ষিন মৌড়াইল গোরস্থানে,
কবি আল মাহমুদের কবরের পাশে।


(ঢাকা ০৮/১০/২০২২)