আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অধিকাংশ সাহাবী (সঙ্গী/সহচর) বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে কবিতা আবৃত্তি করতেন এবং তাদের কেউ কেউ কবি হিসেবে বিশেষ ভাবে পরিচিত ও বিখ্যাত ছিলেন। প্রাক-ইসলামী যুগের প্রখ্যাত কবি হাস্সান ইবনে সাবিত, আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা, কা'ব ইবনে মালিক (রা.) পরবর্তীতে ইসলামে প্রবেশ করেন এবং কাব্য রচনা অব্যাহত রাখেন। রাসূল (সা.) তাদের কবিতা আবৃত্তি করতেন এবং প্রশংসাও করতেন।1


#সাহাবীদের_কবিতা_পাঠ:
জাবির ইবনু সামুরাহ (রাযিঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে শতাধিক বৈঠকে ছিলাম। সে সব বৈঠকে তার সাহাবীগণ কবিতা আবৃত্তি করতেন এবং জাহিলিয়াত যুগের বিভিন্ন বিষয় আলোচনা করতেন। তিনি সেগুলো চুপ করে শুনতেন এবং কখনো কখনো মুচকি হাসতেন। (তিরমিযী:২৮৫০)২


মুতাররিফ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনুস শিখখীর (রহঃ) বলেন, বসরা যেতে আমি সাহাবী ইমরান ইবনুল হুসাইন (রাঃ)র সফরসংগী হলাম। সফরে প্রতি দিনই তিনি আমাদের কবিতা আবৃত্তি করে শুনিয়েছেন। তিনি আরো বলেছেন, পরোক্ষ বচন মিথ্যাকে এড়ানোর নিরাপদ উপায়। (আদাবুল মুফরাদ:৮৯৩)৩


সাহাবী আশ-শারীদ (রাঃ) বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে কবি উমাইয়্যা ইবনে আবুস সালতের কবিতা আবৃত্তি করে তাঁকে শুনাতে বলেন। আমি তাঁকে তা আবৃত্তি করে শুনালাম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতে থাকলেনঃ চালাতে থাকো, চালাতে থাকো। শেষ পর্যন্ত আমি তাঁকে এক শত চরণ আবৃত্তি করে শুনালাম।(আদাবুল মুফরাদ:৮৭৭)৪


ইবনে উমার (রা)-এর কবিতা পাঠ সম্পর্কে হাদীসে এসেছে, তিনি একদিন আবু তালেবের কবিতা পাঠ করছেন। (বুখারী:১০০৮-৯) আবু হুরাইরা (রা.) বলেন, আমি নবীজীর কাছে আসার সময় আবৃত্তি করতাম- "হিজরতের সে রাত কত না দীর্ঘ আর কষ্টদায়ক ছিল- তবুও তা আমাকে দারুল কুফর হতে মুক্তি দিয়েছে।" (বুখারী:২৫৩১)


#কবি_সাহাবী-
১. আবু বকর (রা.)-এর কবিতা পাঠ: রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রধান সহচর ও প্রথম খলিফা আবু বকর (রা) ছিলেন নসবনামা ও কাব্য প্রতিভার সর্বশ্রেষ্ঠ বিশেষজ্ঞ। তিনি বিশুদ্ধ ও প্রাঞ্জল-ভাষী ছিলেন। নানান প্রেক্ষাপটে তিনি স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করতেন।
যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তার সহচরগণ মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনায় আসেন তখন মদীনার নতুন পরিবেশ ও আবহাওয়াগত কারণে আবু বকর ও বেলাল (রা.) জ্বরাক্রান্ত হয়ে পড়েন। আইশা (রা.) বলেন, আবু বকর (রা.) জ্বরে আক্রান্ত হলে এই কবিতার অংশ আবৃত্তি করেন-
"কুল্লুমরিয়্যীন মুছাব্বাহুন ফী আহলিহী
ওয়াল মাওতু আদনা মিন শিরাকি না'লিহী"


অর্থ: ‘‘প্রত্যেক ব্যক্তি তার পরিবারের সাথে (দিনাতিপাতে) ধন্য হয়,
অথচ মৃত্যু তার জুতার ফিতা অপেক্ষা সন্নিকটবর্তী।’’
অর্থ্যাৎ প্রত্যেক ব্যক্তি পরস্পরে বলাবলি করে, আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুন/ সকালটা কল্যাণময় হোক/প্রিয়জনদের সাথে এইভাবেই সুখী হোন, অথচ বাস্তবতা হলো আমরা মৃত্যুর অতি নিকটে জুতার ফিতার মতো।


আর বিলাল (রাঃ) জ্বর থেকে সেরে উঠলে উচ্চস্বরে এ কবিতাংশ আবৃত্তি করতে লাগলেন-


‘‘হায়! যদি পারতাম কবিতা পাঠে মক্কার প্রান্তরে একটি রাত
চারদিকে ঘেরা ইযখির- জালীল (দুই ধরণের ঘাস)
সুযোগ হবে কি আর মাজান্না ঝর্ণার পানি পানের
প্রকাশ পাবে কি আমার জন্য শামা আর ত্বফীল ? (দুটি পাহাড়ের নাম) (বুখারী)৫


২. উমার (রা.): উমার ইবনে খাত্তাব (রা) ছিলেন তৎকালীন যুগের শ্রেষ্ঠ বাগ্মী ও কুস্তিগীর।তার মাঝে ছিলো কাব্য প্রতিভাও। সেই সময়ের প্রায় সমস্ত কবিদের কবিতা তার মুখস্ত ছিলো। বালাজুরী বলেন-রাসূলের নবুওয়্যাতের সময় গোটা কুরাইশ বংশে মাত্র সতের জন লেখাপড়া জানতেন, তাদের মধ্যে উমার অন্যতম। (আসহাবে রাসূলের জীবন কথা)৬


৩. আলী (রা.): আলী (রা.) সম্পর্কে বলা হয় তিনি ছিলেন আরবী ব্যকরণ এর প্রবক্তা। তিনি ছিলেন একজন সুবক্তা ও ভালো কবি।(ইবনে রশিকের "কিতাবুল উমদা": ১/২১) বর্তমানে আলীর নামে একটি "দিওয়ান" পাওয়া যায়, যাতে ১৪০০ শ্লোক রয়েছে। (তারীখুল আদাবুল আরাব:১/৩০৯)


৪. আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা: তিনি হিজরতের পূর্বে ইসলাম গ্রহণকারী আনসারদের অন্যতম।মুতার যুদ্ধে তিনি তৃতীয় সেনাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এই যুদ্ধে তিনি শহীদ হন। তিনি ছিলেন একাধারে কবি ও লিপিকার। তাকে "শায়িরু রাসূলিল্লাহি" বা রাসূলের কবি বলা হয়। (তাবাকাত:৩/৫২৫, তাহজীবুল আসমা ওয়াললুগাত:১/২৬৫)৭


৫. আবু সুফইয়ান ইবনুল হারিস: তিনি ছিলেন একাধারে রাসূলের চাচাত ভাই ও দুধভাই, সমবয়সী। মক্কা বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত তিনি ছিলেন রাসূল ও ইসলামের ঘোর শত্রু। মক্কা বিজয়ের পর স্ত্রীসহ তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন।
তিনি ইসলাম গ্রহণের পর রাসূলের সামনে স্বরচিত কাসীদা শোনান। রাসুলের ইন্তেকালের পর তিনি তার বিয়োগ ব্যথায় একটি কাসীদা লিখেন। (সীরাতে ইবনে হিশাম:২/৪০০-৪০১)


৬. হাসসান ইবনে সাবিত (রা.): মদীনার বনী খাযরাজে জন্ম গ্রহণকারী হাস্সান ছিলেন প্রখ্যাত কবি। ইসলাম গ্রহণের পর তিনি ইসলামের গৌরবগাঁথা,মহত্ব, বড়ত্ব, আল্লাহ ও তার রাসূলের প্রশংসাসূচক অনেক কবিতা রচনা করেন। তার উপাধি ছিলো, "শায়েরে রাসূলুল্লাহ" বা রাসূলের কবি। তাকে বলা হয় মুমিন কবিদের ইমাম। তিনি ছিলেন সমকালীন সময় ও শহরের শ্রেষ্ঠ কবি। রাসূলুল্লাহ (সা.) তার জন্য মসজিদে মিম্বর স্থাপন করতেন, যাতে দাঁড়িয়ে তিনি রাসূলের জন্য গর্বের কবিতা আবৃত্তি করতেন। (মিশকাত:৪৮০৫)৮


তিনি ‘আয়িশাহ (রাঃ)-এর প্রশংসায় আবৃত্তি করেন,
‘‘তিনি সতী, ব্যক্তিত্বসম্পন্না ও জ্ঞানবতী, তাঁর প্রতি কোন সন্দেহই আরোপ করা যায় না। তিনি অভুক্ত থাকেন, তবুও অনুপস্থিত লোকেদের গোশত খান না (অর্থাৎ গীবত করেন না)। বুখারী:৪১৪৬, মুসলিম:২৪৮৮)


৭. কাব ইবনে মালিক (রা.): মদীনার খাজরাজ গোত্রের বনু সালিমা শাখার সন্তান। তিনি ছিলেন প্রখ্যাত কবি সাহাবী, প্রাক ইসলামী যুগ থেকেই কবিতা চর্চা করতেন। উসমান রা.-এর দুঃখজনক শাহাদাতের পর তিনি শোকগাথা রচনা করে আলী (রা.)কে শোনান। এর একটি হলো-
"উসমান তার হাতদুটি গুটিয়ে নিলেন, তারপর দ্বার রুদ্ধ করো দিলেন, তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, আল্লাহ উদাসীন নন।" (আসহাবে রাসূলের জীবন কথা, চতুর্থ খন্ড)
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক ড. মুহাম্মাদ মুজিবুর রহমান কা'বকে নিয়ে একটি বই লিখেছেন। "সাহাবী কবি কা'ব ও তার অমর কাব্য" যা ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে।


#মহিলা সাহাবী কবি
৮. সাফিয়াহ বিনতে আবদুল মুত্তালিব (রা.): তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ফুফু ও প্রখ্যাত সাহাবী যুবাইর ইবনুল আওয়ামের মা। কুরাইশ বংশের তিনি ছিলেন একজন কবি ও সুভাষিণী মহিলা। তার মুখ থেকে অবাধ গতিতে কবিতার শ্লোক বের হতো। সেসব শ্লোক হতো চমৎকার ভাব বিশিষ্ট, প্রাঞ্জল, সাবলীল, কোমল, সত্য-সঠিক আবেগ-অনুভূতি এবং চমৎকার বীরত্ব ও সাহসিকতায় পরিপূর্ণ। (সিয়ারু আ'লাম আন নুবালা: ১/৪৫)
আল্লামা সুয়ূতি (রহ.) বলেন, তিনি একজন বিশুদ্ধ ও প্রাঞ্জলভাষী কবি ছিলেন।
পিতা আব্দুল মুত্তালিবের মৃত্যুর পর তিনি কিছু শ্লোক রচনা করেন। যেমন-


" উঁচু ভূমির এক ব্যক্তির জন্য রাত্রীকালীন
বিলাপকারিনীর আওয়াজে আমি জেগে ওঠি
তারপর আমার দু গাল বেয়ে এমনভাবে অশ্রু গড়ায়
যেমন ঢালুস্থান থেকে মতি গড়িয়ে পড়ে।!


তার বেশ কিছু কবিতা বা শ্লোক পাওয়া যায় সীরাত ও জীবনী গ্রন্থে। দ্রষ্টব্য: সীরাতে ইবনে হিশাম প্রথম খন্ড, সিয়ারু আলাম আন নুবালা, ২/২৭১, হায়াতুস সাহাবাহ, ৩/৩৪৭-৩৪৮)৯


৯. আল খানসা (রা.): তুমাদির বিনতে আমর ইবনে হারিস (রা.) যিনি আল খানসা নামে পরিচিত, তিনি ছিলেন একজন মহিলা কবি। আল্লামা ইবনু আসীর লিখেছেন-
"আরবী কাব্যশাস্ত্রের পন্ডিতরা এ ব্যাপারে একমত যে, খানসার পূর্বে ও পরে তার চেয়ে বড় কোনো মহিলা কবির জন্ম হয় নি।" (উসদুল গাবা:৫/৪৪১)


তিনি কায়স গোত্রের সুলায়ম শাখার সন্তান। ৬২৯ সালে তিনি মুহাম্মদ (সা.) এর সাথে সাক্ষাত করেন ও ইসলাম গ্রহণ করেন। এ সাক্ষাতে তিনি রাসূলকে স্বরচিত কবিতা পাঠ করে শোনান। রাসূলুল্লাহ (সা.) কবিতা শুনে অভিভূত ও বিস্ময় হন এবং প্রশংসা করেন। (আল ইসাবা:৪/৫৫০)


আরব শ্রেষ্ঠ কবি আল নাবিগা তার সম্পর্কে বলেন “আল খানসা জিন ও মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কবি।
তার কবিতার একটি "দিওয়ান" ১৮৮৮ সালে বৈরুতের একটি প্রকাশনা সংস্থা ছাপার অক্ষরে প্রকাশ করে। (সাহাবিয়াত:১৮৮)১০


আরো কিছু সাহাবীর কাব্য প্রতিভা সম্পর্কে আলোচনা সীরাতের গ্রন্থে পাওয়া যায়। যেমন-
উবাদা ইবনে সামিত (রা), আউস ইবনে সামিত (রা.), আদী ইবনে হাতিম তাঈ (রা.), আদী ইবনে রাবি (রা.), তুফাইল ইবনে আমর আদ দাউসী (রা.)


পুনশ্চ: আগ্রহী পাঠকগণ বিভিন্ন সাহাবীর জীবনী ও কাব্য চর্চা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পড়তে পারেন বাংলাতে আসহাবে রাসূলের জীবকথা, আরবীতে ইবনে কুতাইবার " আশ শি'রু ওয়াশশু'য়ারা", তারীখুল আদাব, আলইকদুল ফরীদ ইত্যাদি গ্রন্থ।


টিকা:
1.বুখারী: ৪১০৬, তিরমিযী: ২৮৪৬,২৮৪৭, নাসাঈ:২৮৭৩, বুখারীর আদাবুল মুফরাদ:৫৫৭
2. তিরমিযী:২৮৫০, সহীহ ইবনে হিব্বান:৫৭৮১
3. বুখারীর আদাবুল মুফরাদ,কবিতা চর্চা অধ্যায়, হা:৮৯৩
4. মুসলিম:২২৫৫, আল আদাবুল মুফরাদ:৮৭৭, মুসান্নাফ ইবনু আবূ শায়বাহ্: ২৬০১০
5.বুখারী, মদীনার ফযিলত অধ্যায়, হা:১৮৮৯
6. আসহাবে রাসূলের জীবনকথা, প্রথম খন্ড, উমার রা. অধ্যায়
7. আসহাবে রাসূলের জীবনকথা, তৃতীয় খন্ড, আব্দুল্লাহ রা. অধ্যায়
8. তিরমিযী:২৮৪৬, মিশকাত:৪৮০৫
9. আসহাবে রাসূলের জীবনকথা, পঞ্চম খন্ড
10.আসহাবে রাসূলের জীবনকথা, পঞ্চম খন্ড


@উদাসকবি