গরিব ঘরের কন্যা শিউলী, ছিল অতি সুন্দরী
উঠেছে বেড়ে উচ্চাকাংখা আজন্ম মনে ভরি।
শত হতাশা, দুর্ভাগ্য আর দারিদ্র যে ঘরে
সৌভাগ্যও হয়নি প্রীত দিতে তারে ধনী বরে।


স্বামী হলো তার সরকারী অফিসে নিম্নপদে কেরানি
মনেতে তবু ভাবতো সদাই শিউলী নিজেকে রানী।
ভাবতো সদাই বিবাহ ভাগ্যে হয়েছে সে প্রতারিত
রূপের কদরে ধনী কেউ হতো তার সাথে বিবাহিত।


স্বামীর ঘরের টান-পোড়নে সদাই ছিল সে অখুশী
স্বামীর এমন অক্ষমতায় স্বামীকে করতো দুষী।
ভাবতো সদাই সকলেই যেন তার দিকে চোখ তুলে
তার অভাবী চিত্র দেখে হেসে যেতো প্রাণ খুলে।


হলো না কেন বাড়িখানা তার বহুকক্ষের প্রাসাদ
জানালা দরজায় প্রাচ্যের দামী পর্দা টাঙানো সাধ।
দেয়ালে থাকবে বিশ্ব-খ্যাত শিল্পির কারুকাজ
সোনা ও হীরের অলংকার ও রেশমীর নানা সাজ।


সুগন্ধী ও অলংকারে রূপসী দেহটা ভরে
ধনী লোকদের উত্সব দেবে তার অতিথি ঘরে।
মুগ্ধ-মোহিত নয়নে সবাই দেখে যাবে তারে চেয়ে
সকলের মন জয় করে নেবে কোকিলা কণ্ঠে গেয়ে।


ভাঙা একখানা খাবার টেবিল, দুইদিকে দুটি চেয়ার
একদিকে সে, অন্যদিকে স্বামীটি বসতো তার।
খুশী মুখে স্বামী টেনে নেয় কাছে টিনের একটা থাল -
"এর চেয়ে আর বেশি কিবা চাই - শাক-মাছ-ভাত-ডাল!"


শিউলীর মনে অরুচীতে ভরা এমন গরিবী খাদ্যে
কল্পবিলাসী মন খুঁজে ফেরে যা কিছু মেলে না সাধ্যে।
সুগন্ধীময় জাফরান দেয়া চিকন চালের ভাতে
মুরগীর রোস্ট, খাসীর ভোনা মাংসও চাই তাতে।


বিদেশী টেবিলে খাবার খাবে, বিদেশী ফল ও সালাদে
সুসজ্জিত ডাইনিং রুমে চাকর বাবুর্চির সুবাদে।
আহার অন্তে আরাম চেয়ারে প্রাসাদের বারান্দায়
দেখবে বসে কী ফুল ফুটেছে সমুখের বাগানটায়।


যখনই শিউলী যেতো কোন তার ধনী বান্ধবীর বাসায়
ফিরে এসে ঘরে ডুবে যেতো সে আকণ্ঠ হতাশায়।
তাদের সবার ঘর ভরা কত দামী পোশাক আসবাবে
তার নেই যে সামান্য গয়না যাতে সেজে সেও যাবে।


স্বামী বেচারা সবই তার বোঝে, আর করে প্রাণপনে
যাতে-ই একটু আনন্দ খুশী আসে শিউলীর মনে।
সেদিন এলো অফিস থেকে অতি সহাস্য মুখে
খুশীর খবর দিল শিউলীকে ঘরের দ্বারেই ঢুকে।


অফিস কর্তার মেয়ের বিয়েতে পেয়েছে নিমন্ত্রণ
যেখানে আসবে বড় অফিসার, ব্যবসায়ী বহুজন।
একই অফিসের সহকর্মীর ভাগ্যে মেলেনি যা
তারা দুইজন নিমন্ত্রিত - মনেও খেলেনি যা।


বিরস বদনে শিউলী জানায়, তার যাওয়া হবে না
উত্সবে যাওয়া পোশাক কোথায়? যা আছে সেসব তেনা।
স্বামী বেচারাও ভেবে দেখে ঠিক, সে কথা মিথ্যা নয়
সিল্কের শাড়ি কিনলো তা দিয়ে, যত ছিল সঞ্চয়।


তবু শিউলীর মন ওঠে না - নেই তার ভালো গয়না,
স্বামী বলে তার ধনী বান্ধবীর ধার নিলে কিছু হয় না?
ধনী বান্ধবীর সাজের ঘরে কতই যে অলংকার
সবশেষে তার মন কেড়ে নিল একটা হীরের হার।


রূপ ও সাজে সে উত্সবে শিউলীই শিরোমণি
মোহিত হলো যত অফিসার, বড় ব্যবসায়ী ধনী।
হাসি ও গল্পে নৃত্যানন্দে রাত হয়ে আসে গভীর
ক্লান্ত স্বামী নিরাপদে ফেরার ভাবনাতে অস্থির।


তারা অবশেষে রাস্তায় এসে অনেক খোঁজার পরে
কোনমতে এক ট্যাক্সি পেয়ে ফিরে এলো রাতে ঘরে।
খুলতে খুলতে পোশাক গহনা সহসা শিউলী বোঝে
হারিয়েছে তার হীরের সে হার - এখন তা কোথা খোঁজে?


স্বামী বেচারা হাঁটে আসা পথে, যদি থাকে হার পড়ে
গভীর ঠাণ্ডা রাতের কষ্টেও এলো না সে হার নজরে।
পরের কদিন যারে পায় যেথা শুধালো সকল জনে
আর কোনদিন পাবে না সে হার, অবশেষে মানে মনে।


পরের কদিন দুজনেই হাঁটে সব গহনার দোকানে
সে রকম হীরের হারের দামে কেঁপে ওঠে তারা প্রাণে।
যা কিছু ছিল গরীব সে ঘরে সবই দিল শেষে বেচে
বাকিটা নিল অতি উচু সুদে মহাজনী-ঋণ যেচে।


একটা হীরের হার কিনে নিয়ে গেল বান্ধবীর ঘরে
হারের বাকসো পেয়ে বান্ধবী রাখলো টেবিল 'পরে।
শিউলীর মনে ভয় দূর হলো - যদি বান্ধবী খোলে
সেই হার নয় তার দেওয়াটা যদি সেই কথা তোলে!


তারপর থেকে স্বামী-স্ত্রীর দিনরাত পরিশ্রমে
কৃপণ-স্বভাবে খাওয়া পরা করে কষ্টে যেটুকু জমে
মাসের শেষে সব তুলে দেয় সে মহাজনের হাতে
সব শোধ দিতে বছর পাঁচেক কাটে কষ্টের সাথে।


ততদিনে হায় শিউলীর গায় রূপ-জৌলুষ নেই
বয়সের চেয়ে বৃদ্ধ হয়েছে অচিরে সে দুজনেই।
শিউলীর এখন ভাঙা চোখ মুখ গায়ের চামড়া শুস্ক
যে কেউ দেখলে ভাববে বৃদ্ধা, মাথাও উস্কো-খুস্কো।


হঠাত একদিন বাজারে শিউলী দেখলো বান্ধবীকে
অতি কষ্টে বান্ধবী শেষে চিনলোও শিউলীকে।
শুধায় তারে, বল্ কী করে হলো তোর এই হাল?
শিউলী তখন সব খুলে বলে - বলে তোর হারই কাল।


বান্ধবী বলে, হায়রে শিউলী, করেছিস কী অকারণ
হারটা ছিল না আদৌ হীরের - সেটা ছিল ইমিটেশন!
-----------------------------
মূলঃ The Necklace (short story), Guy de Maupassant (French Writer)