আমার মর্মবিলাপ শুনবে না কেউ,
কারো অনূভব জাগবে না আমার তরে।
কোন হৃদয়াবেগ কখনো আমার
নচ্ছার শরীরে দাগ কাটবে না;
কারো মধুময় মুখ হাসবে না আমার
দুঃসহ বদন পানে চেয়ে।


কঠিন জগত্‍ --ভারী অসহ্য পথ চলা,
কারো মুখপানে চাওয়া যায়
চেহারার আকৃতিও পাওয়া যায়
যতই ভাবাবেগ নিয়ে দর্শিনা কেন
হৃদয়ে পড়বে না ঢেউ।


বাসনার কোন মূল্য নেই
বাসনা হারিয়ে ফেলছে গতি,
মাটির পৃথিবীতে মাটির মানুষ জানে না---
কোন পলকে পলায় বাসনা।
আমি কাঁদি, কেঁদে ভাসাই
অজানা অলদ্ধের আশায়;
চোখ মেলি না, হাত মেলি না
মুখ খুলি না, বুক খুলি না
হাল ছেড়ে দিয়ে বসি---
দেখি আমায় কোথায় নিয়ে ঠেকায়।
কারো বিদায় নেবার সময় হয়, কারো হয় না---
‘অপেক্ষা’ শব্দটি অভিধানে থাকে,
মানবের বহমান কালে তার অস্তিত্ব কোথায়?


মনোরঞ্জন হয় না--আবেগ বিমর্ষ হয়ে থাকে,
বিমল সদালাপ হয় না--চিত্ত বঞ্চিত হয়ে যায়।  
অনুপম রূপণ, রূপস স্বপন--কোনটার
দ্বার দিয়ে যাওয়া হয় না।
কেমন যেন অজান্তে আকর্ষি গেল,
মর্মবিলাপ শোনা নয়---
নদী সে, সময় সাগর-বুকে ঢেলে দিল
আপন রূপের অঙ্গ যেন।


আমার মর্মকথা অধিক বলা বাহুল্য,
নিস্তরঙ্গ নির্ঝরিণীর মতো শাঁ শাঁ
করে ধাবিত হবে কল্পান্ত অবধি;
কোন বেগ মানবে না
কোন বাধা মানবে না--জবরদস্তিও নয়।
কল্পলোকের কল্পনায় ভরে যাবে হৃদয়-গ্রহ,
মানসলোকের জল্পনায় ছেয়ে যাবে অহরহ
প্রাণ, আসমান-জমিন, তেপান্তরের মাঠ,
বারিধির বুক আরও অমুক অমুক।


হে মানসী
হে মানসপ্রতিমা
হে চকিতা চঞ্চলা হরিণী
তব বুক অল্পটুকুও কাঁদে না?
অতো বেশি আবেগময় ভাষা
বা অতো বেশি হৃদয়ে আশা
আমায় দিও না। কারণ আমি জানি
এ গোলাপের খাঁটি স্বরূপ নয়---
এ সঞ্চিত পলির মতোই।
অকৃত্রিম ভাললাগা কল্পিত হয় না--
অদৃশ্য রঙ্গালয় আমরা দেখি না;
মায়াবী অরণ্যে আমরা কখনো
খোশগল্পে আবেগ মিশ্রিত হৃদয়ের
গূঢ় কথা বলতে পারি না।
সুকঠিন পদচারণা আমাদের নাই
আমরা নিয়ত দিশেহারা পাখি,
খালি গা ভাসিয়ে দিই, কোন কিছুরই
পরতে পরতে আমরা গমন করতে জানি না।


সবই মর্মবিলাপ--ফেলনার কিছুই নয়
বাসনায় বেগ যদি আসে,
অথবা যদি মনোলোভা হস্তচ্যুত হয়--
আত্মঘাতী হয়েও এর ক্লেশ কাটে না।


কে সে অন্তর--কোথায় নিবাস?
তারে দেখি না কেন চোখ জুড়িয়ে?
হৃদয়াবেগ এতই প্রবল যে
তারে দমানো না যায়।


আমি পেরেশন হয়ে রই
হারিয়েছি যেন অজ্ঞাত মাধুরী কোন--
তিলে তিলে এর রেশ থেকে যাবে
বিলীন হবে না কখনো মর্মবিলাপ।
সময় অতি নিঠুর, পলকে পলকে
নিঃশেষ হয়ে চলেছে গোপনে গোপনে;
মর্মবিলাপ এর গহ্বরে পড়ে যায়--উঠতে জানে না,
বিলাপ থামলেও সময় নির্বিকার--থামতে জানে না।
এমনি মহাতরুর শিকড় কে খুঁজবে---
এমনি গূঢ় রহস্যের মর্মার্থ কে বুঝবে---
কিসের এ মর্মবিলাপ--কেন কেন?


গুমরে গুমরে কাঁদি ভিতরে ভিতরে
ভাবাবেগ চেপে চেপে রাখি--হঠাত্‍ যদি
বেফাঁস কথা বের হয়ে যায়!
তখন ওর বলবে, “ওমা বল কি, এও কি সম্ভব?”
তখন আমার অসম্ভব বেদনা হবে,
মর্মবিলাপে আকাশ ছেয়ে যাবে--কেননা
অহেতুক ভুগতে হয় বিষম যাতনা।


শোকার্ত কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছে হৃদ,
আনন্দ আমার স্বপ্ন হয়ে গেছে--
একটু প্রসন্নতা, একটু উদগম আমার
হৃদয় ছুঁবে--যেন অলীক কল্পনা।


আগে চোখের সামনে সাজানো বাসরে
কতো স্বপ্নরাজ্য দেখতাম,
হর্ষণ কল্পলোক মিটিমিটি আভাস দিত
এখন তাও দেখি না--
মরমে করুণ পিয়ানো বাজে শুধু।
আথিবিথি করে কতো ঠাঁই চেয়েছি
ইঙ্গিতে বহুদিন পার করেছি--
কোন কাজ হলো না। আমার মন্দ করোটি
আমায় ডুবাল গভীর সাগর জলে।


এ কপোল কল্পিত কামনা নয়
অবাস্তব মায়াপুরী নয়
সূর্যালোকে দিব্য আলোকিত রটনা।
কেননা মায়াবদ্ধ প্রেমের ইন্দ্রজালে আটকানো
যে কতো বড় দুর্বিপাক--সৃষ্টি-রহস্যও এর
কাছে হার মানে।
এর সুক্ষাতিসুক্ষ্ণ উপলব্ধি আমরা করি না
গতানুগতিক জোয়ারের টানে ভেসে চলেছি,
--কিসের এ বিশাল মোহতিমির?


মর্মে যাতনা থাক---তুচ্ছ করি তারে
আমরা মরলোকে আসন পেতেছি,
আমরা মূল্য জানি না দিতে হৃদয়ের
ক্ষুদ্র বাসনার। বুক কম্পিত হোক
শোকে অথবা দুখে---কেহ জানবে না
কেহ বুঝবে না কোথায় কিসের বেদনা।


আমি আমাতে পড়ে রয়েছি
সে রয়েছে তার ভুবনে।
যেন যে যার স্বপনে আপন ভুবন দেখে,
অপরের প্রতি একটু সহানুভূতিও জাগে না।
কেন এমন হয়---এ কেমন রীতি?


বিস্তৃত দিগন্ত পানে চেয়ে---
সবুজ পল্লবিত শোভায়---
প্রকৃতির নিরব নির্জনতায়---
অথবা বিজনে কুজনের সুমধুর তানেও
কী জাগে না সাধ অনুভূতির?


শোকাবেগ থামছে না
গড়িয়ে গড়িয়ে পার করে দিছে লগ্ন।
মুহূর্ত শোকাকুল
অহর্নিশ অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে
চলেছি অন্ধকূপে।


আমি তপ্ত বালুকার পরে শয্যাগত
হয়ে আদি অনাদিকালের ভাবনায় বিভোল;
আমি সূর্যকরে আঁখি মেলে রেখেছি
সুক্ষ্ণ বেদনার রহস্য বিমোচনে।
আমি মৃদু হাসির করণে কি রয়েছে
তার উদ্দেশ উদ্ধারে বিষম পাগল।


মর্মবিলাপ বিমোচন হবে না-
গূঢ় তত্ত্ব যদি না উত্থিত হয়,
মনুষ্য-মতলব যদি না অঙ্কিত হয়
প্রাণে---তবে আমার বিদেহ আত্মা
পাবে না কখনো পরম সান্ত্বনা।


বিদ্যানিধি হতে পারি---
কিন্তু মর্মবিলাপ কেন হয়---এ রহস্যের কাছে
হেরেছি চিরকাল।
একটু খোলসাভাবে--
একটু দ্বিধাহীন চিত্তে--
একটু মনোরমা ক্ষণে--
একটু কোমল পরশে--
যদি আপন আপন হৃদয়-নিংড়িত বাণী
বলা যেতো---তবে মর্মবিলাপ এর গূঢ়ার্থ
প্রকাশিত না হয় তো; তার যাতনা কিয়দংশ
কমতো বলে  মনে হয়।


চোখ আড়াল করে দেয়
হৃদয় আড়াল করতে পারে না।
সুদূরে নিবাস হোক, কল্পনাতীত দূরত্ব হোক,
হৃদয় পরাভূত করবে সকল ঝঞ্জাট।
ভাবনা গোপন কান্তার পেরিয়ে চলেছে
তার আপন সুরের নেশায়।


অমূলক কল্পনা নয়---
একদলা মৃত্‍ যেন বুকের শোণিতধারে
বাধা দিয়ে চলেছে ক্ষণে ক্ষণে।
অবাক বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে থাকি,
অনেক তিথি কেটেছে নির্জলা।
মর্মবিলাপের নিদারুণ শোকে আমি
শুধু চেয়ে চেয়ে থাকি।