।ছড়ার মিল।


ছড়াতে মিল না থাকলেই নয়। কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র একবার বলেছিলেন, "ছড়া আর কবিতাতে মিছে কেন দ্বন্দ্ব?/ কবিতাতে ভাব থাক, ওতে থাক ছন্দ।" ওতে মানে ছড়াতে। ছড়াতেও ভাব থাকে, তবে ছড়ার অন্ত্যমিল যুক্ত  ছন্দের ওই চলনটাই ছড়ার সঙ্গে কবিতার পার্থক্য রচনা করে।


ছড়ার মিল দেওয়ার ব্যাপারটা অপেক্ষাকৃত সহজ মনে হলেও, মাঝেমাঝে কাঁদিয়ে ছাড়ে। সামান্য দু-চার লাইনের মিল দিতে কালঘাম ছুটে যায়!  অনেক সময় মাস, এমনকি বছরের পর বছর ঘুরে যায় সেই মিল খুঁজে পেতে!


ছোটোবেলায় মায়ের মুখে শুনেছিলাম জীবনের প্রথম ছড়া। সন্ধেবেলা বাড়ির সামনের খোলা জায়গায়, কোলে নিয়ে চাঁদ দেখিয়ে মা শোনাতেন একটা অত্যন্ত জনপ্রিয় প্রচলিত ছড়া-- "ওই দ্যাখ্ চাঁদ/ গামছায় বাঁধ।" সেই ছড়া শুনে চাঁদ ধরার আমার সে কি উদ্যম! মায়ের কোল ছাড়িয়ে ওপরের দিকে ওঠার চেষ্টা করতে করতে দুহাত দিয়ে চাঁদ ধরার সেই প্রচেষ্টা এক সময় বড়ো বেলার জন্য তুলে রাখি। বড়ো হয়ে বুঝতে পারি, গামছা দিয়ে বাঁধা তো দূরের কথা, চাঁদ ধরা আমার মতো বামনের কর্ম নয়।


চাঁদ অধরা থাকলেও ছড়া কিন্তু ধরা দিল কলমের মুখে। মাত্রা গুনেগেঁথে ছড়া লিখিনি কখনো-- তবু লেখার পরে দেখা যায়, ছন্দ মিলে গেছে। মাত্রা ও অন্ত্যমিল মিলেমিশে গিয়ে  নিজের লেখা ছড়া মনে করিয়ে দেয় কবি প্রেমেন্দ্র মিত্রের সেই বিখ্যাত কথা, "ওতে থাক ছন্দ।"


তবুও মাঝে মাঝে ছড়ায় মিল দেওয়া দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে। কখনো ভাব বা আইডিয়া (হ্যাঁ, ছড়ারও ভাব থাকে) নিয়ে টানাটানি চলতে থাকে, কখনো বা ছন্দ খুঁজে পাওয়া যায় না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সপ্তাহ, মাস বা কয়েক বছর লেগে যায় লিখতে শুরু করা ছড়াটাকে শেষ করতে। এই লেখায় এরকম দুটো উদাহরণ দেব।


ছোটোবেলায় কেন জানি না, মা মাঝেমধ্যেই আমাকে বলতেন,  "খাবিদাবি ঢোল বাজাবি/ কনে দেখার কী?" তখন খুব ছোটো, কনে দেখা তো দূর অস্ত, 'কনে' কথাটার মানেই জানি না! কিন্তু মা আমাকে বলতেন ওই লাইন দুটো। কেন বলতেই তা মা-ই জানেন। যখন কনে দেখার বয়স না হলেও 'কনে' শব্দটার অর্থ বোধগম্য হল, তখন কিন্তু মা ওই দুটো লাইন আর বলতেন না। বহুদিন ভেবেছি, মা কেন বলতেন ওই লাইন দুটো, আর কেনই বা এক সময় ওই দুটো লাইন বলা বন্ধ করে দিলেন।


আরো একটু বড়ো হয়ে  ওই দুটো লাইন নিয়ে ছড়া লেখার ইচ্ছে হয়। কিন্তু ওই পর্যন্তই! এদিকে ইচ্ছেটাও যায় না। এই করতে করতে প্রায় চল্লিশ বছরের চেষ্টায় প্রার্থিত ছড়াটা বছর দুয়েক আগে লিখতে পারি। ছড়াটা এই রকম:


খাবিদাবি ঢোল বাজাবি
কনে দেখার কী?
বড়ো হলে দেব এনে
তোকে রাজার ঝি।
এখন তো তুই বাচ্চা ছেলে
অর্ধ দিগম্বর,
বড়ো হলে সাজাব তোকে
রাজকন্যার বর।
আপাতত তোর জন্যে
গেঞ্জি কিনেছি,
খাবি দাবি ঢোল বাজাবি
কনে দেখার কী?


মা-র তখন পঁচানব্বই বছর বয়স। ছড়াটা শুনে হাসতে হাসতে বললেন,  "কেন বলতাম ওই কথা, তার উত্তর তো পেয়েই গেছিস!"


আর একটা ছড়ার প্রথম লাইন দুটো মনে এসেছিল 1986-87 সাল নাগাদ। তখন আমরা ভদ্রেশ্বরে থাকতাম। রবিবার বা ছুটির দিনের বিকেলে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম। বেশির ভাগ  দিনই চন্দননগর যেতাম। কোনো কোনো দিন চাঁপদানি, মানকুন্ডু বা একটু দূরের চুঁচড়ো। এই রকম একদিন চন্দননগরের অলিগলিতে সাইকেল নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে একটা মুদির দোকানের সাইনবোর্ড দেখে চোখ আটকে গেল। সাইনবোর্ডে লেখা,  "সত্যসাধন লস্কর"। পরের লাইনে, "খাঁটি জিনিস, সঠিক ওজন,উচিত দাম।" দোকানের মালিকের নামেই দোকানের নাম। সাইনবোর্ডে ওরকম লেখা দেখে মুহূর্তে ছড়ার দুটো লাইন তৈরি হয়ে গেল,   "সত্যসাধন লস্করে/ লাভ করে, না 'লস' করে?" কিন্তু, ওই পর্যন্তই, আর এগোতে পারি না। দু-তিন বছরের চেষ্টাতেও ছড়াটা অসমাপ্ত থেকে যায়।


বছর পাঁচেক পরে একদিন রাতে চন্দননগরে জগদ্ধাত্রী পুজো দেখতে গিয়ে আশ্চর্যজনক ভাবে ছড়াটার বাকি লাইনগুলো পেয়ে গেলাম। হয়েছে কি, প্রতিমা দেখতে দেখতে আমরা সেই সত্যসাধন লস্করের দোকানের সামনে এসে পড়েছি। ওই মুদির দোকানের পাশে ছিল একটা মিষ্টির দোকান। ওই   দোকানে মিষ্টি কিনতে ঢুকেছি। সাঙ্ঘাতিক ভিড়! একটু ভেতরের দিকে উঁকি মেরে দেখি, একজন বেশ সুখী সুখী চেহারার বয়স্ক ভদ্রমহিলা (পরে জেনেছি, মালিকের মা। পুজোর ভিড়ের ওই ক-দিন ছেলেকে সাহায্য করতে দোকানে আসেন) উনুনে রসগোল্লার রস জ্বাল দিচ্ছেন। গলায় সোনার মোটা হার, হাতে গাদাগুচ্ছের সোনার চুড়ি। ওনার ওই রস জ্বাল দেওয়া দেখে মুহূর্তের মধ্যে মধ্যে অসমাপ্ত ছড়াটা _কমপ্লিট_ হয়ে গেল! পুরো ছড়াটা এই রকম :

সত্যসাধন লস্করে
লাভ করে, না 'লস' করে?
       ময়রাবুড়ি
       বাজিয়ে চুড়ি
রসগোল্লার রস করে।


বলা বাহুল্য, ছড়াটা শেষ করতে পেরে, সেদিন মনে যারপরনাই আনন্দ হয়েছিল!


অরি মিত্র