মৃদু কলরবে তুমি,ওহে শৈবলিনি,
কি কহিছ ভাল করে কহ না আমারে।
সাগর-বিরহে যদি, প্রাণ তব কাঁদে, নদি,
তোমার মনের কথা কহ রাধিকারে---
তুমি কি জান না, ধনি, সেও বিরহিণী?



তপনতনয়া তুমি;তেঁই কাদম্বিনী
পালে তোমা শৈলনাথ-কাঞ্চন-ভবনে;
জন্ম তব রাজকুলে,(সৌরভ জনমে ফুলে)
রাধিকারে লজ্জা তুমি কর কি কারণে?
তুমি কি জান না সেও রাজার নন্দিনী?



এস, সখি, তুমি আমি বসি এ বিরলে!
দু'জনের মনোজ্জ্বালা জুড়াই দু'জনে;
তব কূলে,কল্লোলিনি,ভ্ৰমি আমি একাকিনী,
অনাথা অতিথি আমি তোমার সদনে—
তিতিছে বসন মোর নয়নের জলে!



ফেলিয়া দিয়াছি আমি যত অলঙ্কার---
রতন, মুকুতা, হীরা, সব আভরণ!
ছিঁড়িয়াছি ফুল-মালা জুড়াতে মনের জ্বালা,
চন্দন চর্চ্চিত দেহে ভস্মের লেপন!
আর কি এ সবে সাদ আছে গো রাধার?



তবে যে সিন্দূরবিন্দু দেখিছ ললাটে,
সধবা বলিয়া আমি রেখেছি ইহারে!
কিন্তু অগ্নিশিখা সম, হে সখি, সীমস্তে মম
জ্বলিছে এ রেখা আজি—কহিমু তোমারে—
গোপিলে এ সব কথা প্রাণ যেন ফাটে!



বসো আসি,শশিমুখি,আমার আঁচলে,
কমল আসনে যথা কমলবাসিনী!
ধরিয়া তোমার গলা, কাঁদি লো আমি অবলা,
ক্ষণেক ভুলি এ জ্বালা, ওহে প্রবাহিণি!
এস গো বসি দুজনে এ বিজন স্থলে!



কি আশ্চৰ্য্য!এত করে করিনু মিনতি,
তবু কি আমার কথা শুনিলে না, ধনি?
এ সকল দেখে শুনে, রাধার কপাল-গুণে,
তুমিও কি ঘৃণিলা গো রাধায়, স্বজনি?
এই কি উচিত তব, ওহে স্রোতস্বতি?



হায় রে তোমারে কেন দোষি, ভাগ্যবতি?
ভিখারিণী রাধা এবে—তুমি রাজরাণী।
হরপ্রিয়া মন্দাকিনী,সুভগে,তব সঙ্গিনী,
অর্পেণ সাগর-করে তিনি তব পাণি!
সাগর-বাসরে তব তাঁর সহ গতি!



মৃদু হাসি নিশি আসি দেখা দেয় যবে,
মনোহর সাজে তুমি সাজ লো কামিনী।
তারাময় হার পরি,শশধরে শিরে ধরি,
কুসুমদাম কবরী,তুমি বিনোদিনী,
দ্রুতগতি পতিপাশে যাও কলরবে ।


১০


হায় রে এ ব্রজে আজি কে আছে রাখার?
কে জানে এ ব্ৰজজনে রাধার যাতন?
দিবা অবসান হলে,রবি গেলে অস্তাচলে,
যদিও ঘোর তিমিরে ডোবে ত্রিভুবন,
নলিনী যেমনি জ্বলে–এত জ্বালা কার?


১১


উচ্চ তুমি নীচ এবে আমি হে যুবতি,
কিন্তু পর-দুঃখে দুঃখী না হয় যে জন,
বিফল জনম তার,অবশ্য সে দুরাচার।
মধু কহে, মিছে ধনি করিছ রোদন,
কাহার হৃদয়ে দয়া করেন বসতি?


(ব্রজাঙ্গনা কাব্য)