সৃষ্টির সেরা জীব আমি 'আশ্রাফুল মাখলুকাত'
কিন্তু গুনের দৌড়ে পশুর সাথেও হই কুপোকাত।
চারপায়ি নিকৃস্ট পশু নাম তার 'কুকুর'
এঁটে বাসি খেয়েও প্রভুর করে হাজার শুকুর।
রাত জেগে পাহারা দেয় প্রভুর গৃহ খানি
বিনিময়ে হয়তো পায় একটু ফেন আর পানি।
চার হাত পায়ে আগলে রাখে নিজ মালিকের ধন
"প্রাণ দিয়ে হলেও করব সেবা" এই তার পণ।
আর একটি অবুঝ প্রাণী 'গরু' যার নাম
সারা জীবন প্রভুর সেবাই একমাত্র কাম।
রোদে পুড়ে বৃষ্টি ভিজে করে হাল চাষ
একটুখানি ভুল হলেই পিঠে পড়ে বাঁশ।
কখনো আলপিনের কঠিন খোঁচা খেয়ে
কাদা জলেই শুয়ে পড়ে তীব্র ব্যাথা পেয়ে।
প্রতিবাদ নাহি করে সব কিছু যায় ভুলে
পরের দিন প্রভাতে আবার জোয়াল কাঁধে চলে।
এমনি করে কাটে তাদের বছর-মাস-দিন
তবু মনে করে তারা 'হয়নি বুঝি শোধ ঋণ'।
তাই সারা জীবন সেবা করে মরিবার পরে
চামড়া, মাংস রেখে যায় নিজ প্রভুর তরে।


             গুরু-দক্ষিনা
শ্রেস্ঠ জীবের মর্যাদা খোদা দিয়েছেন আমায়
আমার কিছু প্রভু ভক্তি শুনো বলি তোমায়,
বাবা আমায় এতিম করে গেল কবর দেশে
মা সংসারের হাল ধরিল বীরঙ্গনার বেশে।
পাঁচটি মুখের অন্ন যোগান চাট্টিখানি কথা!
তিন চার বাড়ির কাজ করে মার ঠিক থাকে না মাথা।
তিনটি মাসুম ছেলে মেয়ে আর বৃদ্ধ শাশুড়ী
কেমনে বল আহার যোগায় ঝিয়ের কাজ করি?
একদিন প্রভাত বেলা জননী ডেকে কয়,
"মাসুম কিছু কথা আছে, আমার কাছে বয়,
জানি তুমি ভাল ছাত্র পুরো স্কুল মাঝে
কিন্তু বাবা এখন তোমার ওসব কি আর সাজে?
কাল থেকে যাবা তুমি সোনাতলার বিলে
কামাই করে আনবা কিছু যেন বাঁচতে পার গিলে।"
এই বলে পুস্তকাদি গৃহ হতে এনে
উনুনে গুজে দিল পাতা ছিঁড়ে টেনে।
সব শুনে গনিত গুরু বড় কষ্ট পায়
মায়ের কাছে আর্জি মাঙ্গে,"পুত্র দিয়ে দাও আমায়।
মনে বড় কষ্ট পাই কেবল অর্থাভাবে
এমন মেধাবীর পড়া বন্ধ হয়ে যাবে?
আর তো মাত্র একটা বছর স্কুল জীবন শেষ
তারপর টিউশনি করে পড়তে পারবে বেশ।"
এই বলে মাস্টার বাবু নিয়ে নিজের বাড়ি
জামা-কাপড়, পুস্তকাদি কিনে দিলেন কাড়ি।
নিজ কন্যাকে ডেকে কহেন, "এহার কেহ নাই,
অদ্য হতে মনে কর তোমার স্বীয় ভাই।
বড় কস্ট জমা ছিল তোমার বুক মাঝে
ভাই ফোটা হয়নি দেয়া কারো ললাট মাঝে।
তোমার সেই দুঃখ আজি গেল বুঝি গুচে,"
পিতার কথায় কন্যা কেবল নয়ন দুটি মুছে।
নতুন বাড়ি নতুন গৃহে নেই কিছুর অভাব
হটাৎ করে বদলে গেল আমার নিজ স্বভাব।
মাস্টার মশাই স্কুল শেষে ফিরেন সন্ধ্যা করে
মাতৃহীন ষোড়শী কন্যা থাকে একলা ঘরে।
শাওনের ভারী বর্ষন, এক দুপুর বেলা
মন চাহিল তাহার সাথে খেলতে নিকোষ খেলা।
বন্ধ ঘরে অন্দকারে ঝাপটে যখন ধরি
দু'পায়ে আছড়ে পড়ে বলল মিনতি করি,
"তুমি আমার ধর্মের ভাই ধর্মের কাজ করো
মোর দেহখানি ছেড়ে দিয়ে একটু দূরে সরো।
ভগবান একজন আছে মাথার উপর যেন
নরকেও ঠাঁই পাবে না, এই কথাটি মেনো।"
"স্বর্গ-নরক সেতো পরে, রাখো নীতি কথা
দয়া করে জুড়াও কন্যা আমার বুকের ব্যাথা।"
এই বলে জোর করে কেড়ে নিয়ে সব
উপরে দু'হাত তুলে বলি, ''মাফ কর রব''।
গুরু কন্যা পিতার কাছে করে গেল গোপন
মনের মাঝে আঁকতে থাকে নতুন কোন স্বপন।
মাস তিনেক পরে বলে, "চলো কোথাও ভাগি
ও চরনে ঠাঁই দিলে হবো ধর্ম ত্যাগি।
বুঝি আমার দেহ মাঝে তোমার রক্ত আবির্ভাব
কিছু একটা করো বন্ধু সময় বড় অভাব।"
এসব শুনে মন মাঝে ঝড় গেল বহি
হিন্দু মেয়ে বিয়ে! এ কেমন করে সহি?
মুখ দেখাব কেমন করে স্বজাতির কাছে?
না জানি 'এক ঘরে' করে সমাজের লোক পাছে।
এই ভেবে সাফ বলে দিলুম গুরু কন্যার তরে,
"জীবন গেলেও সম্ভব নয় তোমায় তোলা ঘরে।
তার চেয়ে ভাল তুমি নস্ট করো উহা
টাকা পয়সা লাগে কিছু যোগার করব তাহা।"
এসব শুনেও কন্যার মুখে কেমন যেন হাসি
সেই রাতেই দেহ ত্যাগে গলায় দিল ফাঁসি।
শিক্ষাগুরু মৃত্যুর কারণ করতে পারলেন আঁচ
ললাট রেখায় দেখা গেলো বেদনার ভাঁজ।
কন্যার সৎকার শেষে কালিমাখা হাতে
কাছে ডেকে নিয়ে আমায় বলেন নিরালাতে,
"ইতর প্রাণীরও অধম তুমি বোনের সাথে জিনা!
এমনিভাবে শোধ করিলে গুরুর দক্ষিনা?
যাও বাবা ভাল থেকো কামনা তোমার তরে
শাস্তি কিছু পাও যেন তুমি মরিবার পরে।"


              প্রতিদান
অমি তখন গাড়ি চালাই পুণ্যভূমি সিলেট
মালিক আমার দীর্ঘ জীবন কাটিয়ে বিলেত;
গৃহে ফিরে বড় ব্যবসা করে আয়োজন
ব্যবসার কাজে গাড়ী চালক বড় প্রয়োজন।
পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে গেলাম আমি তথা
মালিক আমার পাশে বসে শুনলেন সব কথা।
বলেন, চাকুরি তোমার ঠিকই হলো ভয়ের কিছু নাই
মালিক আমি নইকো কভু ভেব নিজের ভাই।
মানুষ কভু মানুষের মালিক হয় না
মানুষের মালিক সে তো ধরায় রয় না।
শততা আর নিষ্ঠাসহ করো যদি কাজ
দেখবে একদিন তোমার মাথায় শোভা জয়ের তাজ।
পাঁচ হাজার এখন পাবে বাড়বে কিছু পরে
থাকা খাওয়া সবই হবে আমার নিজ ঘরে।"
সকাল বিকাল গাড়ি চালাই দুপুর বেলা রেস্ট
মনে ভাবি ইহার চেয়েও আছে কিছু বেস্ট।
'পাঁচ' কে 'দশ' করার বড় প্রয়োজন
টায়ার, টিউব, গিয়ার, ব্রেক কত সংযোজন।
এহা বাদেও তেল, মবিল করতে হয় চুরি
বছরখানা না পেরোতেই মোটা হলো ভুরি।
গাঁ হতে বার্তা নিয়ে এলো ছোট ভাই,
"আগুনে বাড়ি পুড়ে সব হয়েছে ছাই।
আসবাব, গরু, বাছর সবই পুড়ে শেষ"
কেমন করে কেটে উঠব এমন ঢেউয়ের রেশ?
সব শুনে গুরু কহে মুখে নিয়ে হাসি,
"সেই তো মানুষ বিপদে যে বাজাতে পারে বাঁশি।
বিপদে ভেঙ্গে পড়া মানুষের কাজ নয়
শক্তি সাহস বক্ষে ধরে পথ এগুতে হয়।
আজকে তোমার যাহা আছে আমার তাও নাহি ছিলো
শ্রম সততার গুনে প্রভু আমায় সবি দিলো।
পশু পাখি যুদ্ধ করে বাঁচতে পারে যদি
মানুষ হয়ে আমরা কেন বিপদে চোখ মুদি?
ঘর পুড়েছে কি হয়েছে ভিটে তো ঠিক আছে
শুশোভিত হবে তাহা ফুল, ফল আর গাছে।"
এই বলে হাজার কুড়ি দিয়ে আমার হাতে
বলেন. "বাড়ি যাবে তুমি কাল প্রভাতে।
গৃহ তুলে তা সাজাতে যত দিন লাগে
সিলেট কভু ফিরবে নাতো তার একদিন আগে।
টাকা যদি লাগে আরো খবর দিও মোরে
লোক মারফত পৌঁছে দিব তোমার স্বীয় ঘরে।"
এইভাবে তাঁর ছায়াতলে কাটে আমার দিন
মনের মাঝে বাজতে থাকে অন্য সূরের বীণ,
হাতের কাছে লক্ষ কোটি টাকার আনাগোনা
বউটি আমার পড়বে কেবল এমিটেশন সোনা?
পরের গাড়ির চাকা ঘুরিয়েই কাটবে কি জীবন?
নিজের গাড়ি চড়ে কভু দেখবো না ভুবন?
মালিকের ছোট্ট ছেলে নিত্য গাড়ি চড়ে
বিদ্যা শিক্ষা করতে যায় দূরের স্কুল ঘরে।
একদা গাড়িসহ পুত্রটিকে নিয়ে
উঠি আমি বন্ধুর বাড়ি রাঙামাটি গিয়ে।
সেথায় গিয়ে গুরুর কাছে করি টেলিফোন,
"পাঁচ লক্ষের বিনিময়ে পাবে পুত্রের জীবন।
থানা পুলিশ না জানিয়ে আসো যদি একা
তবেই কেবল পুত্রের সাথে হবে তোমার দেখা।"
মালিক পুত্র ভয়ে ত্রস্ত কেঁদে কেঁদে বলে,
"চাচু তুমি এমন নিষ্ঠুর কেমন করে হলে?
তুমি যদি চাইতে অনেক দিতো আমার বাপ
তবে কেন করতে গেলে এমন হীন পাপ?"
টাকা নিয়ে মালিক আমার সাথে করেন দেখা
কপাল মাঝে বেদনার একটি চিহ্ন রেখা।
অর্থ থলি হাতে দিয়ে বলেন কান্না সুরে,
"ভালবাসার বিনিময় দিলে এমন করে?
ছোট একটি ভ্রাতা ছিল দেখতে তোমার মত,
কালাজ্বরে ভাইটি আমার হয়েছিল গত।
তাকেই আমি খুঁজে ছিলাম তোমার মুখ মাঝ
কেমন করে করলে তুমি এমন হীন কাজ?
ক্ষতি যা করেছ আমার কষ্ট কিছু নাই
কস্ট শুধু বুক মাঝে হারিয়েছি ভাই।"


                  ***

মানুষ আমি সৃস্টির সেরা শ্রেষ্ঠ ধরার মাঝে
কি যে শ্রেষ্ঠের নমুনা পেলে আমার কাজে?
আমার মত এমন পশু পাবে শত শত
'মানুষ' নামের অন্তরালে জানোয়ার সব যত।
শকুর, কুকুর, বলদ, বিড়াল ইতর যাহা আছে
আমরা 'মানুষ' নামের মাহত্ব্য হারাই তাদের কাছে।
চোখের অশ্রু মুছে যারা এনে দিলো হাসি
তাঁদের গলায় পড়িয়ে দিলাম যন্ত্রনার ফাঁশি।
সুখ-সম্পদ, ভালবাসা যারা করলো দান
সর্বনাশের অগ্নিতাপ দিলাম প্রতিদান।।