শোনো মাসি তুমি আর আমাদের সঙ্গে রঙ মেখো না;
আসলে কি জানো তো রঙে রঙ মিশে তবে তো জেল্লা ওঠে,
তোমার শরীরে আর সে রঙ নেই, বেফালতু ওসব মেখে নষ্ট!
বাতের ব্যামো নিয়ে এই ডিজিটাল লেনদেনের যুগে আর লাইনে দাঁড়িও না।
তার চেয়ে রিটার করো,রেস্ট নাও,আমরা তোমার সব খরচ চালিয়ে নেবো!
মাসি রেগে গিয়ে বলল,কি করব?রিটার?সেটা কি?চুপ কর ছেমড়ি-
এসব লাইনে ওসব আবার আছে নাকি,এটাকি চাকরি পেইচিস নাকি;
এখনো লাইনে দাঁড়িয়ে তোদের টেক্কা মেরে খদ্দের তুলতে পারি জানিস!
তোদের মতো আমার গতরে পোকা পড়েছে নাকি?আদিক্যাতা দেকাস নে!
আর শুধু গতর থাকলেই হয় না,পেম-টেমও জানতে হয়;না হলে নাম হয়না!  
হা হা হা প্রেম? এখন ওসব নেই মাসি,গতর টাকা বিছানা এই হলেই চলবে!
ও কি তোমাদের সময় নাকি,বাড়িতে সুন্দরী বৌ ছেড়ে-
বাবুরা এখানে এসে চরিত্তির পালিস দিয়ে জাতে উঠে অভিজাত হবে?
রাগে গজ গজ করতে করতে মাসি তার ঘরে চলে গেলো,হ্যাঁ ঘরেই গেল-
ভাঙা টালির উপর ত্রিপল জড়ানো দড়ি বাঁধা ছাউনির নয়-দশের ঘর,
মনে নেই,সে অনেক দিন আগে কোন এক মহালয়ার দিনে জুটেছিল এই ঘরখানা!
হাড়হাভাতে মাতাল বরের পনের টাকা না দিতে পারার অত্যাচার সইতে না পেরে-
কাজ খোঁজার জন্য এই শহরে পা রেখেছিল সেদিনের সেই যুবতী,অনামিকা হয়ে!
বরের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন সইতে না পেরে স্বাবলম্বী হতে চেয়েছিল,
সময়ের হাত ঘুরে সামাজিক ঘূর্ণাবর্তে ভেসে শেষে ঠাই এই নয়-দশ কুঠুরি!
টালির চাল ভেঙ্গে নেমে আসা, প্লাস্টার খসে পড়া, শ্রীহীন এই ঘরখানা।
যেদিন সে বুঝেছিল এ ঠিকানা থেকে আর বেরনোর কোন পথ নেই,
সেদিন থেকেই প্রতিদিন নিজেকে ঠিকঠাক পণ্য করে গড়ে তোলার সংগ্রাম!
কতরকম সাজগোজে রঙচঙে হয়ে গলির সারিতে দাঁড়ানোর সংগ্রাম,
আর প্রতি রাতে একটু একটু করে ঠিকঠাক দামে শরীর বিক্রির জন্য দামাদামি।
এখনকার মত ডিজিটাল খদ্দের তখন ছিল না,এখন সব বড্ড চটপট, ঝটপট;
প্রাণহীন, দয়ামায়া হীন, নৃশংস নেট দুনিয়ার কৃত্রিম ভাবভঙ্গী ভরপুর!
বড় রাস্তার কোন চেনা মোড়ে ডিজিটাল ইশারায় ঝাঁ চকচকে গাড়ি থামে,
তারপর হুস করে মিলিয়ে যায় ব্যস্ত নগরীর সাধারণ জীবনের মাঝে,
সাজানো গতর রাতদিন সাতদিন চলে বিক্রি,যত দাম তত আঁচড় শরীর জুড়ে!
তারপর সকালের লোকাল বাস বয়ে নিয়ে আসে ধ্বংসপ্রাপ্ত বিবর্ণ যৌবন,
বনেদি বাবুরা আর নেই, আতর ধুতি পাঞ্জাবির দিন কবে শেষ,
গজল, ঠুমরী, বেনারসী পান,মদিরায় ডুব দেওয়া কাটানো সময় শেষ!
শরীর না ছুঁয়ে কত বাবু ফিরে যেত এটুকু সান্নিধ্যের দাম চুকিয়ে-
সেসব আভিজাত্যের দিন আর নেই, সেদিনের সেই যুবতী আজ মাসি হয়ে গেছে!
দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাসি- সে আজ তিলে তিলে সব নিঙড়ে দিয়ে বড় একলা,
গলির সারিতে যে কজন দাঁড়ায় এখন তাদের কাছে পেঁচো মাতালের ভিড়,
হয়তো একদিন এ ঠিকানা পাকাপাকি যাবে উঠে, সবই হয়ে যাবে ভ্রাম্যমাণ!
পরিপাটি হয়ে নিজেকে সাজানো,ঘর সাজানো,আর বাবু খদ্দেরের অপেক্ষা-
এসবের দিন ফুরিয়ে যদি কোনোদিন হেরিটেজ গলি হয় এসব,অবাক কিছু নয়।
মাসি বেরুচ্ছি- কল আছে, জাঁদরেল পাটি, ভালো দাঁও হবে বোধহয়,
আমার ঘরটা দেখো, রান্না করো না,ঘরে খাওয়ার আছে খেয়ে নিও-
মাসি ঘরের থেকে বেরিয়ে সামনের চায়ের দোকানে চা খেতে গেল,
চা দোকানি চায়ের গ্লাস বাড়িয়ে দিয়ে বলল, মাসি শুনেছ?
কি? কাল আমি গেরামে গিয়েছিলাম ওই যে গো বলেছিলাম না-
তোমার বাড়ি যেখানে ছিল; তার পাশের গেরামে তো আমার বাড়ি,
বউটার খুব শরিল খারাপ তাই কিছু টাকা দিয়ে এলাম ডাক্তার দেখাবে;
আর জানো-তোমার সেই মরদটা?সে দুদিন আগে টেঁসে গেছে,হেব্বি মাল খেত!
চায়ের গ্লাসটা সবে ঠোট ছুঁয়েছিল, ধীরে ধীরে নামিয়ে রাখল মাসি,
মুহূর্তে শরীরটা যেন নীথর হয়ে গেল, চোখের দুকোন গড়িয়ে জল নেমে এলো,
সেই ছেড়ে আসা তক আর যে কেউ কোনো খোঁজ নেয়নি নি কারোর!
তবুও যে কেন জল ভরে এলো চোখে তা বোধহয় ঈশ্বর ছাড়া কেউ জানবে না।  
কি মাসি কাঁদছ যে বড়!আরে ওর জন্যই তো তোমার জীবন এখানে কাটলো;
হ্যাঁ ঠিকই বলেছিস, না কাঁদবো না,কাঁদবো কেন!ও আমার কে-  
এই বলে চোখের জল মুছতে মুছতে মাসি তার ঘরের দিকে হাঁটা শুরু করল,
এমন সময় স্থানীয় ক্লাবের ছেলেরা এসে বলল,মাসি চলো,আমাদের মাটি লাগবে-
তোমার ঘরের থেকে একটুখানি মাটি নেবো, তুমি তো জানো-
প্রতি বছর আমরা তোমার ঘরের মাটি নিয়ে যাই!
আরে তুমিই তো এ পাড়ার খানদানি বে......, ওয় চুপ, ওসব কি বলছিস?
কিছু মনে করো না মাসি, ওসব কচি চ্যাংড়া ছেলেপুলে সম্মান দিতে জানে না!  
খানিকটা মাটি না হলে যে আমাদের দুগগা ঠাকুর ঠিকঠাক হবে না!
এ বছর আমরা হেব্বি বাজেটের পূজো করছি, সেরা পুজোও হতে পারে-
একমুঠো মাটি ক্লাবের ছেলেদের হাতে দিয়ে মাসি মনে মনে ভাবল; সম্মান-
আমাদেরও সম্মান আছে মা দুগগা?আমাদের ঘরের মাটি চাই তোমার পুজোয়-
তাই কি তুমি আমাদের এমন করে পতিত করে রেখেছ চিরকাল-
তাই কি আমাদের কোনো ঘর-সংসার নেই?কারোর মেয়ে, স্ত্রী নই,মা নই?
শুধু মৃত্যু প্রহর গুনে যেতে হয় এই নয়-দশ পাতাল কুঠুরি ঘরে!
আমরাও যে তোমার মতো মেয়ে,মা!তোমারও তো স্বামী সংসার আছে-
বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে বেশতো ছুটি কাটিয়ে ঘুরে যাও এপাড়া ওপাড়া হয়ে-
আমাদের বাপের বাড়ি,নিজের বাড়ি, কোনো সংসার হয় না কেন?
সব পাড়া যে আমাদের পাড়া নয় মা,আমাদের কেন শুধু নিষিদ্ধ পাড়া?
সেখানে যে আসে সব ফুর্তি নিতে,আর রাশি রাশি ঘেন্না ছড়িয়ে দিতে।