ছোটবেলায় আমার ভুতের ভয় ছিল প্রচণ্ড। সন্ধ্যের পর একা বাইরে যাওয়া দূরের কথা, একা ঘরের ভিতরেও থাকতাম না। একটু বড় হওয়ার সাথে সাথে টিভি তে বিভিন্ন হরার শো গুলো দেখার পর আর একটা ভ্রান্ত ধারনার সৃষ্টি হল--- ভূতেরা সাধারনত দিনের বেলায় নিষ্ক্রিয় থাকে এবং সন্ধ্যে হবার পর থেকে ধীরে ধীরে সক্রিয় হতে হতে রাত বারটার পর পুরোপুরি সক্রিয় হয়। ছবি আঁকার পাশাপাশি যেহেতু বই পড়ার নেশা ছিল তাই নানারকম বই পড়া হয়েই থাকত। এমনকি পরীক্ষার আগের দিনেও ইতিহাস বইএর ভিতরে গল্পের বই লুকিয়ে পড়েছি। এই বই পড়া থেকেই একটা যুক্তিবাদী মনের সৃষ্টি আর ভূতেরা সব বইএর পাতায় আর টিভি স্ক্রীন এ বন্দি থেকে গেল।
আমার ছোটবেলার কিছুদিন যে পাড়ায় কেটেছে সেই পাড়ায় একটা পরিত্যক্ত বাড়ী ছিল। সবাই বলত ভূতের বাড়ী। কারা যেন বাড়ীটার দেওয়াল এ বড় বড় করে লিখে দিয়েছিল--" ভূতের বাড়ী"। ওই ভূতের বাড়ীর উঠোনেই আমাদের খেলার জায়গা ছিল। ওই বাড়ীর বারান্দায় অনেকবার ঝুলন সাজিয়েছি। বাড়ীর পিছনের দিকটায় যাবার সাহস কারো ছিলনা। দিনের বেলাতেও না। একবার ঝুলনের সময় ঘাসের চাপ তুলে আনার দায়িত্ব পড়েছিল আমার। দুপুর বেলায় একাই গিয়ে ওই বাড়ীর পিছনের দিক থেকে বড় বড় ঘাসের চাপ তুলে এনেছিলাম। ভূতের বাড়ীর পিছনের বাগানে একা একা গিয়ে ফিরে এসেছি বলে সঙ্গী সাথীদের মাঝে সাহসি বলে বিশেষ মান বেড়েছিল আমার।
এরকম ভূত ভূত ব্যাপার আমাদের অনেকের জীবনেই ঘটে। আমার ঘটেছে বেশ কয়েকবার। কিন্তু সবচেয়ে মজা পেয়েছিলাম একবার নিজে ভূত সেজে ভয় দেখিয়ে। সেই ঘটনাই বলা যাক।
বিয়ের পর পেলিং গেছিলাম বেড়াতে। খুব মনোরম নিরিবিলি পাহাড়ি জায়গা বলে দুদিনের জায়গায় চারদিন থাকার পরিকল্পনা করেছিলাম। সময়টা ছিল ডিসেম্বর এর মাঝা মাঝি। পর্যটক কম। আমরা সহজেই হেলি প্যাড এর কাছে একটা সুন্দর সাজান হোটেল পেয়ে গেলাম্। হোটেল না বলে কাঠের বাড়ী বলাই ভাল। আমি আর আমার স্বামী দুজন ই মাত্র অতিথি তখন অব্দি। হোটেলের ম্যানেজার, রাঁধুনি আর রুম সার্ভিস এর ছেলেটাকে ধরলে পাঁচ জন প্রাণী। ওই দিন সন্ধ্যেতেই জনা দশেকের এক মারাঠি পরিবারের দল এসে উঠল ওই হোটেল এ। রাতের খাবার টেবিল এ বসে আলাপ পরিচয় হোল। খাবার শেষে বেশ আড্ডা জমল। বয়স্ক রাঁধুনিও আমাদের আড্ডায় যোগ দিল। মেদনিপুরের লোক। পেলিং এ আছেন বেশ কয়েক বছর। কি কথায় কথায় যেন ভূতের প্রসঙ্গ উঠে এল।
রাঁধুনিটি বললেন--" এসব পাহাড়ি গ্রামে গঞ্জে ভূতের দেখা পাওয়া কঠিন কিছু নয়। আমিই দেখেছি বেশ কয়েকবার। এই হোটেলেই।"
মারাঠিদের মধ্যে কয়েকজন মহিলা সদস্য দেখলাম ভূত আর ভগবান বিশয়ে বেশ স্পর্শকাতর। 'এই হোটেলই' কথাটা শুনে বেশ দুমড়ে গেলেন। এদিক সেদিক কথা বলে আমারা শুতে চলে গেলাম। পরেরদিন যে যার মত ক্যামেরা হাতে বেরিয়ে পড়লাম। ফিরে এসে দুপুরের খাবার টেবিল এ আবার দেখা মারাঠিদের সাথে। ওদের মধ্যে থেকে আক ভদ্রলোক (যার রুম আমাদের সামনা সামনি একি তলায়) উঠে এসে আমাদের টেবিল এ বসলেন।
আমার স্বামীকে উদ্যেশ্য করে বললেন--" একটা কথা জিগ্যেস করি যদি কিছু মনে না করেন?"
--"হ্যাঁ। নিশ্চয়ই। বলুন।"
--"গতকাল রাতে কি কোন ঘুঙুরের শব্দ পেয়েছেন? দরজার সামনে?"
--"ঘুঙুর? নাতো। কেন?"
--"না মানে রাতে দুবার। কে যেন ঘুঙুর পায়ে হাঁটাচলা করছিল।"
'ঘুঙুর পায়ে' কথাটা শুনতেই আমার স্বামীর মুখের অভিব্যাক্তির পরিবর্তন হয়ে গেল।
সঙ্গে সঙ্গে বলল--" না মানে আমারা টায়ার্ড ছিলাম তাই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আর তাছাড়া আমার মিসেস ঘুমের ওষুধ নিয়ে ঘুমায়। আমরা কিছু শুনিনি তো।"
ঘুমের ওষুধ নিই শুনে দাঁতে দাঁত ঘষতে ঘষতে রুমে ফিরলাম।
--"তুমি মিথ্যে কথা বললে কেন? আমি কবে ঘুমের ওষুধ নিলাম?"
আমার স্বামী হাসিতে ফেটে পড়লো। বলল-" আরে বুঝলেনা তুমি? ওরা ভয় পেয়েছে। ঘুঙুরের শব্দে।"
--" হ্যাঁ কিন্তু...।"
--"শোন কাল তুমি যে ড্রেসটা পরে রাতে ছাদে গেলে, মনে আছে? ওটা ঘুঙুর লাগানো।"
হ্যাঁ তাই তো। রাতে প্রায় দু ঘণ্টা আমারা কম্বল চাপা দিয়ে ছাদে বসেছিলাম। হোটেল এ আসার পর শুনেছিলাম ছাদ থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়। কাল রাতে পূর্ণিমা ছিল। তাই অনেক আশা নিয়ে ক্যামেরা হাতে বসেছিলাম। কিছু দেখতে পাইনি। আর যে সালোয়ার কুর্তাটা পরেছিলাম সেটায় অজস্র ঘুঙুর লাগানো। আমার একটা স্বভাব ছিল এথনিক ড্রেস গুলোকে আরও বেশি এথনিক বানাবার জন্য দরজী কে দিয়ে জামার হাতে, ঝুলে, ওড়নায় ঘুঙুর পুঁতি বসিয়ে নেওয়া। ছাদে যাওয়া আসা নিয়ে মোট দুবার ওদের দরজার সামনের সিঁড়ি দিয়ে নাচতে নাচতে উঠেছি নেমেছি।
কথাটা রাতের খাবার টেবিল এ ম্যানেজার এর কান অব্দি গেল। শুনে খুব হাসি পেয়েছিল। কান্না যদিও চাপতে পারি আমি হাসি কোনোদিনই না। বেগতিক দেখে তাড়াতাড়ি রুমে ফিরে এলাম।
একটু রাত বাড়তেই ও বলল---"তোমার সেই ঘুঙুর লাগান ড্রেসটা পরত আরেকবার।"
--"কেন?"
--"আরে পরইনা। মেমরেবল পেলিং ট্রিপ হবে।"
আমি ঘুঙুর ওয়ালা ড্রেসটা পরে মারাঠিদের দরজার সামনে গিয়ে তা ধিন ধিন করে নেচে এলাম একবার, দুবার,......তিনবার। সঙ্গে সঙ্গে মারাঠি মহিলার গলার আওয়াজ পেলাম...
"জয় হুনুমান জ্ঞান গুন সাগর/ জয় কপিশ তিহু লোক উজাগর......।"
আরও বার তিনেক তা ধিন ধিন করার পর শুনি ভদ্রলোক ইন্টারকমে ম্যানেজার বাবুকে ডাকছেন। আমি তাড়াতাড়ি রুমে ঢুকে কম্বল চাপা দিয়ে শুয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ পর দরজায় ম্যানেজার এর টোকা।
--"কে?"
--"আমি ম্যানেজার আনন্দ। একবার দরজাটা খুলবেন প্লিজ।"
ও উঠে গিয়ে দরজা খুলল। আমি তখন 'ঘুমের ওষুধ' নিয়ে ঘুমাচ্ছি।
--"দাদা ওনারা কিসব ঘুঙুরের শব্দ শুনেছেন করিডোরে। আপনারা জানেন কিছু?"
আমার স্বামী প্রায় চোখ না খুলে একটা বড় হাই তোলার ভান করে বলল--" নাতো।"
--"ও সরি। একটু সাবধানে থাকবেন। আমি দেখছি ব্যাপারটা।"
--"ওকে। তা ঘুঙুরের শব্দ হোলে দেখুন কনও পাহাড়ি মেয়ে ভুত হবে।"
--"নানা। ওসব কিছুনা। আপনি দরজাটা লাগিয়েদিন।"
পরেরদিন সকালে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা দিল। আমরাও সেই দিনটা থেকে পরের দিন বেরিয়ে যাবো ভাবলাম। প্রাতরাশের টেবিল এ বসে মারাঠি বাবু বললেন--" কাল ম্যানেজার বাবু চলে যাবার পর দু তিন বার অন্য রকম শব্দ পেয়েছিলাম।"
--"কি রকম?"
--"বাজ পড়ার মতো কড়াত কড়াত। কিন্তু আকাশে মেঘ ত তেমন ছিলনা।"
'কড়াত কড়াত' শব্দ টা শুনে আমার কফির কাপ ছলকে গেল। মনে পড়লো, কাল রাতে এসব ঘটার পর আমার আখরোট খাবার বায়না হয়েছিল। আখরোট গুলো হোটেলের নীচের রাস্তার এক ফেরি ওয়ালার কাছে কিনেছিলাম। শক্ত আখরোট ভাঙার জন্য আর শক্ত যন্ত্র না পেয়ে আমার স্বামী দরজার ফাঁকে আখরোট গুঁজে পাল্লা দিয়ে চেপে আখরোট ভেঙেছিল। আর সেই থেকেই কড়াত কড়াত শব্দে বাজ পড়ে।
এরপর আর একটা রাত ছিলাম পেলিং এর ওই হোটেলে। শেষ রাতে আর ভূত সাজা হয়নি আমার। তবে আসার সময় ম্যানেজার বাবু আর মারাঠি বাবুকে চকোলেট এর প্যাকেট গিফট দিয়ে এসেছিলাম। ভিতরে একটা করে চিরকুট। ওতে ক্ষমা চেয়ে লিখেছিলাম-- " আপনাদের দুটো ঘুমের রাত নষ্ট করার জন্য ক্ষমা করবেন। ঘুঙুরের শব্দের উৎস আমরাই। ক্ষমা করে থাকলে রিসেপশান এ দেওয়া নম্বরে ফোন করবেন।" শিলিগুড়ি পৌঁছাবার আগেই মারাঠি বাবু আর ম্যানেজার বাবু একসাথে ফোন করলেন।
মারাঠি বাবু বললেন---"আচ্ছা লোক তো আপনারা। আর কটা দিন থাকলে বেশ জমত আপনাদের সাথে।"