কার পরাজয়ে কবি ড. শাহানারা মশিউরের 'জিজ্ঞাসা'?


[এ আসরে কবি ড. শাহানারা মশিউর একজন বিদগ্ধ কবি। আমার বিষয়গত সীমাবদ্ধতা সত্তেও, নিম্নে তার একটি বিশেষ মানবতাবাদি কবিতার উপর মতামতভিত্তিক আলোকপাতে প্রয়াসি হলাম। আশা করি পাঠক তা ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।]


আলোচ্য কবিতাঃ জিজ্ঞাসা
কবিঃ ড. শাহানারা মশিউর
সময়ঃ ০৬/১০/১৭


এনেছি আমার প্রশ্নমালা, পুষ্পমালা নয়
কি কারনে বরণ করলে চরম পরাজয় ?


তব সুরেলা কন্ঠ কেন বন্ধ আছে?
প্রাণের বীণাটি কেন পরের কাছে ?
কেন জ্যোৎস্না নেই পূর্ণিমা রাতে
গল্প জমেনি কেন তারার সাথে ?


সমুদ্র-বাহন কেন ডোবাতে ভাসলো
বসন্ত-কোকিল কেন বর্ষাতে আসলো ?
কেন সিংহ আছে পিঁপড়ার ঘরে
তিলের গাছে কেন তাল ধরে ?


চারের বদলে কেন তিনে হলো হালি
তবু কেন দিয়েছিলে জোর করতালি ?
কার ধমকে তুমি থমকে দাড়ালে
চিরচেনা পথে নিজেকে হারালে ???


           প্রথমেই থমকে দাঁড়াতে হয়। এ ভেবে - এই পরাজয় কার? তারপর নিপুণ শব্দবিন্যাসে নিরব সঞ্চালনে এক ভারসাম্যহীন সময়ের দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। 'কেন সিংহ আছে পিঁপড়ার ঘরে' কথাটি এ ইঙ্গিতকে আরো বাঙময় করে তোলে। সিংহ শক্তি, সাহস, শৌর্যবীর্যের প্রতীক। অপরদিকে পিঁপড়ার নানাবিধ গুণ বিদ্যমান থাকা সত্তেও সিংহের বিপরীতে তাকে তুচ্ছ ভাবাই স্বাভাবিক। অন্তত শৌর্যের প্রচলিত প্রতীক হিসেবে পিঁপড়াকে গণ্য করা হয়না। এদিকে সিংহ শাসন দন্ডের প্রতীকও। 'লায়ন', 'সিংহ', 'টাইগার', 'বাঘ' ইত্যাদি উপাধি শক্তিশালী সুশাসকদের গৌরবময় শাসনের পরিচায়ক হয়ে উঠেছে যুগে যুগে  - 'শেরে মেহশূর', 'রিচার্ড দি লায়নহার্টেড' ইত্যাদি প্রণিধান যোগ্য।  


এ সময়সন্ধিক্ষণের নিরিখে উপরোল্লেখিত পংক্তিটি কবিতার এপিফানি (ইলহাম) বা 'পাঞ্চিং লাইন' হিসেবে ধরে নিতে পারি। দুনিয়া জুড়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রভুত উন্নতি এবং অতীত সভ্যতা সমূহের উত্থান-পতনের লিখিত ইতিহাস আমাদের সামনে বিদ্যমান থাকে সত্তেও দেশে দেশে ক্ষমতা হস্তান্তরের (transition of power) লিখিত পদ্ধতি আর কার্যকরী পদ্ধতির মধ্যে যে আকাশ-পাতাল বৈপরীত্য পরিদৃষ্ট হয়, তা মুক্ত বিবেককে আহত করবেই। সমস্ত অনাচারের কেন্দ্রবিন্দুতে হঠকারী চরিত্র যতো! চারিদিকে অযোগ্যতার সয়লাব। 'কেন সিংহ আছে পিঁপড়ার ঘরে?' কিংবা যেমন তারই সমমানসিকতা সম্পন্ন এক উর্দূ কবির আফসোসটুকু দ্রষ্টব্য 'শের কি সর পে বিল্লি খেল রাহি হে'। কোথাও সঠিক অবস্থানে নেই সঠিক মানুষ। আর হলেও, সবাই নিজ নিজ দায়িত্ব ভুলে গিয়ে কোথায় যেন এক অচেনা শক্তির কাছে আপোষে পরাজিত। এখানেই কবির 'জিজ্ঞাসা' - কেন?' খুব সম্ভবত এই হলো কবিতার অন্তর্নিহিত মূলবক্তব্য। যদি ভুল না করি।


উপরোল্লেখিত বিশেষ উপমাটি সহ পুরো কবিতার বর্ণনা ভঙ্গি আন্দোলনশূন্য নিরব দিঘীর জলের সঙ্গে তুল্য। অর্থাৎ তেজী শব্দের আড়ম্বর পাশ কাটিয়ে, কেবল নৈসর্গিক উপমার আশ্রয়ে গড়ে উঠেছে কমনীয় দেহবল্লরী এবং ধ্বণি। এটা লিখিয়ের স্বার্থকতা হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার দাবি রাখতেই পারে। কিন্ত কোন হোঁচট না খেয়েও, কবি চাইলে, বর্ণনা প্রবাহে একটা উপস্থাপনিক বাঁক (variation) কাটতে পারতেন। যেটাকে now and then বলা হয়। তা মানা হয়নি। তাছাড়া যেখানে পাঠককে বলে দিতে হয়না কবিতাটির পরতে পরতে রয়েছে প্রশ্নবাণ, তবু অধিক সরলীকরণের নিমিত্ত শিরোনাম বিবেচিত হয়েছে কি 'জিজ্ঞাসা'? যদি তাই হয়, আর কবি যদি মনে করে থাকেন কবিতায় কোন কাব্যি থাকবেনা, এ সৃষ্টি হবে সম্পূর্ণ মেদমুক্ত 'সরল', প্রথা ভাঙে ভাঙুক, সে ক্ষেত্রে তিনিই (কবি নিজেই) সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী 'কর্তা'। একথা ধরে নেয়া অযৌক্তি হবেনা আলোচ্য কবিতার বিদগ্ধ লিখিয়ে এব্যাপারে সহমত পোষণ করেন যে,  
                        
                          'ভাঙারও নিজস্ব এক ছন্দ আছে
                          রীতি প্রথা আছে
                          এবরোখেবরো ভাবে ভাঙলে
                          ভাঙার বিজ্ঞান থু থু দেবে গায়ে''।


সর্বোপরি 'জিজ্ঞাসা' - কেনো এই সামষ্টিক অধঃপতন বা অবক্ষয়? বুদ্ধি, মেধা ও বিবেকের স্বীকৃত দাবি যেখানে মানবতার বিজয় কেতন উড়বে। কবি বিশ্বশান্তির ধ্বজাধারী সাজানো-পাতানো সঙ্ঘ, সংস্থা, জোট, মহাজোটের কাছে প্রশ্ন রেখেছেন সরাসরি। তবে এদের কাউকে পুষ্প দিয়ে বরণ করবেন না। অধিকন্তু (না বলা কথা) এমন পরাজিত মানসিকতা সম্পন্ন লোকদেরে অলংকারাশ্রয়ী কাব্যভাষায় ধিক্কার জানাবারও যোগ্য মনে করেন নি তিনি, মনে হয়েছে। প্রিয় কবির প্রশ্নবাণ কায়েমী স্বার্থবাদের লোলচর্ম ভেদ করতে সক্ষম হবে কি না, জানিনা। তবে এটুকু জানি সত্যানুসন্ধানের পথে সংবেদনশীল হৃদয়ে ক্ষরণের বিরাম নেই। কবির 'সরল' উচ্চারণকে সাধুবাদ জানাই। তার চিন্তক মনের নান্দনিক অভিযাত্রা প্রতিজ্ঞা ও প্রেষণে হয়ে উঠুক জ্যোতির্ময়।