বাউলের মন


একদিন ভালোবাসবে বলে কথা দিয়ে ছিলো
পাঠশালার ছলিম মাঝির মেয়ে
কি ফুটফুটে চাঁদের মতো মুখ
বিশ্রী একটি নাম চাঁনভানু
তবু চোখ ফেরানো যেতো না।
ওর বাবার নাম ছলিম মাঝি না হয়ে
অন্যকিছু হতে পারতো
ওর নাম নিদেনপক্ষে চাঁদনী। 
আমি যেদিন চাঁদ হবো!
অথচ ও চাঁদনী হবার আগেই
ছলিম মাঝির বয়সী ...


যাকগে, আমি যখন দশম শ্রেণি
আমি যখন কিশোর
নবম শ্রেণির স্নেহলতা
আমার প্রেমে বিভোর।
ধর্ম কর্ম জাত মেলে না
ট্রান্সস্লেশন ভুল
অংক কষা কষে গেছে
মাথা হুলুস্থুল।
স্নেহলতা বলেছিলো,
চলো আমরা পালাই,
ভালোবাসায় জাত ধর্মের
নেই যে তেমন বালাই।
হঠাৎ শুনি স্নেহলতার 
হয়ে গেছে বিয়ে
স্বামী তাঁহার ঢাকায় থাকে
মস্ত বড় ইয়ে।
আমার এবার সব বিষয়ে ফেল
টিচার পিঠে ভাঙলো ক'টা লাঠি আর স্কেল।


পাশের বাড়ির চম্পাকলি কালো
সেও আমায় বাসে ভীষণ ভালো
মুখ ফুটিয়ে বলে না সে কথা
আস্তে করে হাত বুলালো যেখানটাতে ব্যথা।
পিঠ ও মাথা কপোল চিবুক
অঙ্গ অনুক্ষণ,
ওর কালো হাত পরশ মাখায়
লাগলো শিহরণ।
চম্পাকলির গুণের অন্ত নাই
চম্পাকলি সব বিষয়ে ভালো
কি হবে তা শরীরটা যার কালো।
বাবা বললেন ভেবে দেখলুম নাহ্!
এ কখনো হয়?
কালো মেয়ে!
এছাড়া কি আছে বা ওর
বংশ পরিচয়?
চম্পাকলি সব বিষয়ে প্রথম হয়ে পাশ
আমার রেজাল্ট সাড়ে সর্বনাশ। 
চম্পাকলি বৃত্তি পেয়ে বিদেশ চলে গেছে
বাবা বললো, দেখো দেখি
এমন মেয়ে ক'টা গ্রামে আছে?
তখন যদি... থাক সে কথা আজ,
আমি তখন ভবঘুরে,
পড়াটড়া নেই যে কোনো কাজ।
বাবার তখন বুকের অসুখ ভীষণ বেড়ে গেছে
ডায়াবেটিস বিশ;
বললো বাবা, আমায় এখন একটু শান্তি দিস।
শরীরটা যা যখন তখন যেতে পারি মরে
ফুটফুটে এক বউ নিয়ে আয় ঘরে
নাতি টাতি দেখার সাধ কি নাই?
না হলে বল ইচ্ছে করে আগেই মরে যাই।
বুকটা চেপে বাবা করলেন একটু অভিনয়,
সিনেমাটিক দৃশ্যে হলো আমার পরাজয়।
বৌয়ের বাবার জমি জিরেত ভালো
লোকে বলে মস্ত জমিদার 
রূপে তাঁহার হলুদ বাটার মেশাল চাঁদের আলো
ভেবে চিন্তে হলাম কৃতদার।


মেয়েটি পাশ ফিরে শোয়
জানালার গ্রিল ধরে তারা গোণে
বিষন্ন দৃষ্টিতে আকাশের দিকে চায়।
মেয়েটি জ্যোতিষী নাকি?
জ্যোতির্বিদ হলে কোনো বাঁধা নেই
আমি এক এক করে জেনে নেবো তারাদের নাম।
মেয়েটি পাগল নাকি?
নিজের চুল ছিঁড়ে মাটিতে লুটায়
ওর ঘনকালো আজানুলম্বিত কেশ;
ওর গোলাকার পা ছেয়ে যায় চুলে
ধবধবে সাদা হলুদ পা, যাতে নির্বিঘ্নে
দেখতে পাই; পাগল বটে।
বাহ! তুমি কেনো পাশ ফিরে শোও?
মেয়েটি নিরুত্তর। 
খাঁচায় সাঁটানো ময়না পাখিটা ডাকে,
মেয়েটি নিরুত্তর। 
আকাশ ভাঙা বিজলি এসেছে
জানালার কাঁচ ভেঙে,
মেয়েটি নিরুত্তর। 
বিড়াল ডাকছে, মোরগ ডাকছে
কুকুর করছে ফেউ,
মেয়েটি নিরুত্তর। 
আমি যখন ডাকলাম তাকে আলতো করে পিয়ে
তুমি আমার জন্মান্তর, অর্ধাঙ্গিনী একটুও নও পর,
এপাশ ফিরে ওপাশ ফিরে 
মেয়েটি ছিলো তখনও নিরুত্তর।


তোমার এবার বিএ কেলাস? বেশ!
লেখাপড়ায় লাভ কি আছে? 
বেকারত্বের জন্ম দিচ্ছে দেশ।
আমি ক্লাসে অংকে ছিলাম সেরা
বাবা বললো, ইংলিশে তুই আস্ত গাধা ভেড়া
বাবার কথাই সত্যি হয়ে গেলো
গাধার মতোই ঘোলাজলে পড়ে বিয়ে হলো।
এবার মেয়ে মুখ ফিরিয়ে করলো উচ্চারণ
ইচ্ছে নয়তো আমায় বিয়ে করলে কি কারণ?
মনে হলো মেয়েটি তো কথা বলতে জানে!
সেই যে শুরু এখন আমার দায় যে বাঁচা প্রাণে।
ঝগড়াঝাঁটি হচ্ছে হররোজ
মেয়ের বাবা ভাইরা এসে যাচ্ছে নিয়ে খোঁজ।
বললো আমায় শান্তভাবে শোনেন দুলামিয়া
চাই না আমি জামাইবাড়ি আসি পুলিশ নিয়া।
বাবা এসে করজোড়ে করলো অনুরোধ
বললো মেয়ে, নেবো এবার চরম প্রতিশোধ,
চোখ দু'টো কি অন্ধ আপনার, কান দু'টো কি কালা?
মূক বদনে যাচ্ছি সয়ে কতোশতো জ্বালা? 
বাবা! সে তো চুপটি করে থাকে
ছেলেকে সে উস্কে দিয়ে না ঘুমে নাক ডাকে।
বাবা এবার হয়ে গেলেন চুপ
দেখছে সবাই আমার বৌয়ের হলুদ বাটা রূপ।
অবশেষে বন্দোবস্ত হলো
কিছুদিনের জন্যে বউটি বাপের বাড়ি গেলো।
সেই যে গেলো আর এলো না ফিরে
করলো এবার মস্ত অভিমান
কতো কথা রটলো ওকে ঘিরে
অবশেষে ব্যর্থ প্রাণের করলো অবসান।


এক এক করে মা ও বাবা দু'জন হলো গত
হিংটিংছট প্রশ্ন মাথায় আসলো শতশত
'কি করি আজ ভেবে না পাই
পথ হারিয়ে কোন বনে যাই'
ভাবনা অপঘাত
মনে হলো আকাশ থেকে হচ্ছে বজ্রপাত।


অবশেষে বেরিয়ে গেলাম পথে
কোথা থেকে একতারাটা এলো আমার হাতে।
অংক কষা মাথার ভেতর নানান প্রশ্ন আসে
টুংটাঙাটাং শব্দে এবার বিষাদের সুর ভাসে।
পথ আমাকে আপন করে নিলো
সুর হারানো পথের দিশা সব যুঝিয়ে দিলো।


গাঁয়ের আলপথ, গ্রাম থেকে গ্রামে 
মেঠোপথে।
কেউ বলে সংসার বিবাগী আমি
কেউ বলে বাউলের মন
কেউ বলে ওর নাই আপনার জন।
আমি ভাবি একদিন 
এ জীবন ছিলো সঙ্গিহীন 
আজ দেখি আছে সব
ভাবনাবিহীন।


এমনি করে কেটে গেলো অনেকটা বছর
পথ আমাকে আপন করলো পথই করলো পর
পথের তরেই বসত ভিটে পথেই আমার বাড়ি
পথ হারালে দেয় যে দিশা হারানো পথ তারই।
হঠাৎ দেখি পেছনে কে ধরলো আমার হাত
বলে বাউল! তোমার আমার নেই তো কোনো জাত
নেইকো ধর্ম, নেইকো বর্ণ, নেই কোনো কারবার
তোমায় আমি ভালোবাসতে পারি একটিবার?
আমি তোমার চাঁনভানু আর আমিই স্নেহলতা
আমি তোমার চ¤পাকলি না ভোলানো ব্যথা
আমায় তুমি সঙ্গী করে সাথে রাখো যদি
ঐ যে দেখো ছোট্র একটা নদী
ওটাও হবো পার
নেবে বাউল? তোমার সাথে আমায় একটি বার?
আমি তোমায় অনেক ভালোবাসি
তোমার জন্যে দিতে পারি জান
তোমার আমার ভালোবাসা শাশ্বত অম্লান।
তোমার হাতে একতারা আর আমার হাতে জুড়ি
তুমি আমি একই ফুলের ফুটন্ত মঞ্জুরি
তুমি হলে বাউল পুরুষ, আমি বাউলিনী
এসো তবে জগৎটাকে প্রেমের দামে কিনি।