এই-ই আমাদের গ্রাম!
ছোটবেলায় রাজুর পেন্সিলে টানা গ্রামখানিকে
স্বপ্নের মত মনে হতো।


তখনো ও'পাড়ায় যাওয়া হয়নি
পথে কুকুরের ভয় আছে বলে।
মা বলতো রাস্তার পাশে বড় বড় পুকুর, তুমি এখনো সাঁতার জানো না। বাবা বলতো ওখানের ছেলেরা খুব ডানপিটে, ওদিকে যেও না। ঠাকুমা বলতো ছেলেধরা আছে দাদু, যেওনা!


যাইনি। তবে, রাজু রোজ আসতো। ওর পেন্সিলের অগা নাকি অনেক গল্প জানে ! সব রঙের গল্প! বলেছিলো, আমাকে একদিন খুব করে শোনাবে। কিন্তু শোনাইনি কখনো।


আমার কাছে তখনো ও'পাড়া ছিলো গল্পের মতো।
ফটিক দা' ও'পাড়ারই লোক। আমাদের বাড়ি ধানের কাজ করতো
লাঠিয়াল হিসেবেও দু-চার গ্রামে তার বেশ নামডাক ছিলো।
অনেকগুলো জোয়ানতাজা ছেলেপুলে।
কিন্তু, বাপের মতো বুকে পাটা' নেই একটারও।


বিন্দুমাসি! সেও ও'পাড়ার।
আমাকে রোজ দুধ দিতো,
কখনো কখনো গোপনে বেথুল,জাম,
সবরি,খেজুর ইত্যাদি ইত্যাদি….
যখন যেটা মেলানো যায়।


মাঘের কোনো এক সকালে প্রথম ভাঁটায়-
জীবনের প্রথম নদীভ্রমন।
ধানের ব্যাপারীনায়ে চড়ে বাজুয়ার হাট।
সেকি আনন্দ!
নতুন টাকার নতুন স্বাধে নতুন জামা।
চোখে খুশির জল বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না।
কান্নায় পরিনত হল ফেরার টানে
ভরা জোয়ারের বিচক্ষণ তুফানের আবোল-তাবোল মাতোম।
সে অনেক দিনের কথা, ভয়ে আমার
এখনো বুকটা ঠান্ডা হয়ে আসে।


হতে পারে সেই স্মৃতি হওয়া স্মৃতির টানেই
ফিরে আসি বার বার
এই কাদাপথ, এই পুকুর, এই নদীপাড়ে...
রাজুর পেন্সিলের গল্পটা আমার কাছে অসমাপ্তই থেকে গেলো।
আজকাল ও'র আঁকা সেই ছবিটার সাথেও গ্রামখানি আর মেলে না।


ফটিকদা'কেও এখন চেনা যায় না..
আশ্বিনের বুড়ো পুঁইশাকের শিরেল ডাটার মতো
চামড়ার উপরে জেগে উঠেছে রগগুলো,
চৈত্রের চিমটে আমের মতো পুষিচোখ যেন পালাতে চায়-
এযাবৎ কালের সমস্ত গর্ব লুকাতে।


সামনের ধানক্ষেতে সবুজ চাদরের বদলে বিল ভর্তি নোনা শামুক।


নদী আছে.....
জোয়ারভাটার মিছিল নেই।
চরপুত্র পলিকণাদের ছন্দদৌড় নেই।
বাঁকেবাঁকে শাড়ীর দোলে নাচে না স্রোতস্বিনী।


দূর থেকে সরদারবাড়ির সীমানাজ্ঞাপক আর নারকেল বা তালগাছ নয়!
এখন ছেলে বুড়ো সবাই চেনে-
ওটা মোবাইল টাওয়ার।


বিন্দুমাসির কথাটা খুব মনে পড়ে! বেঁচে থাকলে বেচারি কতো লজ্জাতেই না পড়তো !  
আজ আমায় দেবার মতো একটাও ফল কি তার অবশিষ্ট থাকতো!
এই আমাদের গ্রাম....
রাজুর পেন্সিলের গল্পটা আজো অসমাপ্তই থেকে গেলো...
আবার হয়তো কেউ শুরু করবে নতুন করে..
কোনো একদিন।
মিটুল কুমার বোস[ 06/03/17]