গ্রীষ্মের পড়ন্ত বিকেল বেলা গাঁয়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছিলাম
হঠাৎ এক অর্ধবয়স্ক লোক এসে পাশে বসেছিল।
গায়ের পোশাকে ভদ্রলোক ব'লে মনে হচ্ছিলো না
ময়লা মাখা পাঞ্জাবি, সিগারেটের আগুনে বিভিন্ন জায়গায় ফুঁটো, শীতকালের মতো তীব্র গরমেও ফাটা ঠোঁট
মাথায় বাবরি দোলানো চুল, জরাজীর্ণ দেহ
পুরনো একজোড়া স্যান্ডেল পায়ে, পেছনের অংশ ক্ষয়ে গিয়েছিল, চোখ দু'টো ছিলো অনেকটা গর্তে
দাঁড়ি-গোঁফের কারনে মুখ স্পষ্ট দ্যাখা যাচ্ছিলো না
কাঁধে ঝুলানো একটি ব্যাগ, বুক পকেটে তিন টাকার বলপেন।
প্রথমে ভেবেছিলাম কোন কনজ্যুমার কোম্পানির সেলসম্যান অর্ডার নিতে এসেছে
কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো "আচ্ছা এটা হীরাপুর না"?
আমি মাথাটা নাড়িয়ে ব'লে ছিলাম " হুম এটা হীরাপুর"।
আগে তো কখনো দ্যাখিনি তোমাকে?
কোথায় থেকে এসেছো আর যাবে কোথায়?
একটু ভেবে জবাব দিলো "শূন্য থেকে এসেছি, শূন্যে আবার ফিরে যাবো"।
এ কথার কোন আগামাথা বুঝতে পারলাম না
আনমনে চুমুক দিচ্ছিলাম চায়ের কাপে।
আবারো কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে হঠাৎ বললো "অমুকের মেয়ে নাজমিন কি বাড়ি আছে?
একটু দ্যাখা করবো, পনেরো কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে এসেছি, হাতে বেশিক্ষণ সময় নেই,
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো ব'লে পৃথিবীতে, একটু পরেই জ্বলে উঠবে সাঁঝেরবাতি"।
জিজ্ঞেস করেছিলাম " আপনি নাজমিনের কি হোন"?
হাজারো কষ্ট বুকে চেপে, হিমালয় সম একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আমতা আমতা করে জবাব দিলো "আমি, মানে... ওর মেয়ের বাবা"।
আমি তার চোখে প্রেমের দরিয়া দেখেছিলাম
যা গ্রীষ্মের খরতাপে শুকিয়ে খা-খা করছে,
খরা পুড়ে যাওয়া বিস্তৃত বনভূমি দেখেছিলাম যা আজ-ও একপশলা বৃষ্টির তরে অবিরত রোদন করছে।
আমি তাঁকে ব'লে ছিলাম " ক্যানো এলে এতোটা দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে"?
সে-তো আর গ্রামে থাকেনা
বিয়েসাদী করে স্বামী সন্তান নিয়ে শহরে থাকে
শুনেছি সে না-কি এখন অনেকটা সুখেই আছে।
এই কথাগুলো শোনার পর তার চোখে অশ্রু প্রবাহ দেখেছিলাম
আর দাঁড়ায়নি, বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিড়বিড় করতে করতে অদৃশ্যে হারিয়ে গেলো।
পরদিন সকালে যখন বেলকনিতে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে পত্রিকার পাতায় চোখ বোলাচ্ছিলাম
হঠাৎ নজরে পড়ে "ট্রেনে ঝাপ দিয়ে স্বনামধন্য কবি-র আত্মহত্যা"
পাশে ঝাকড়া চুলের ছবিটি দেওয়া।
ক্ষণিকের জন্য আমি বিমূঢ় হ'য়ে যাই
এ-তো গতকালের আউলা বাউলা ছেলেটা
তার নাম-তো আমি অনেকের মুখে শুনেছি
এই ছেলেটা-ই এ প্রজন্মের স্বনামধন্য কবি "মিটু সর্দার"
এ-তো কাছ থেকে দ্যাখেও তাঁকে আমি চিনতে পারিনি
সে-তো গতকাল আমাকে ব'লে ছিলো "তাঁর হাতে বেশিক্ষণ সময় নেই, অনেক তাড়া আছে তাঁর"।
আমি ক্যানো তাড়ার কারণ জিজ্ঞেস করে আটকালাম না, ক্ষানিকটা পাশে বসিয়ে গল্প করলাম না।