মানবজাতির ইতিহাসে ভাষা ও শব্দের প্রভাব অতুলনীয়। শব্দ দিয়ে সৃষ্টি হয় সংস্কৃতি, প্রতিষ্ঠিত হয় সভ্যতা, আর ভাষার শ্রেষ্ঠতম শৈল্পিক প্রকাশ হচ্ছে কবিতা। কবি সেই স্রষ্টা, যিনি শব্দে আঁকেন সময়ের চিত্রপট, সমাজের সুর, আত্মার অনুরণন। কিন্তু ইসলাম ও কুরআনের দৃষ্টিতে এই কবি ও কবিতার অবস্থান কী?

আল কুরআন একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান, কিন্তু এর ভাষা ও রচনাশৈলীতেও রয়েছে সাহিত্যিক শিখরছোঁয়া সৌন্দর্য। আরবি ভাষাবিদরা একমত যে, কুরআনের অলৌকিকতা কেবল তার বিধান বা ইতিহাসে নয়—বরং তার ভাষাশৈলী, ছন্দ ও চিত্রকল্পেও। ফলে কুরআনের ভাষা নিজেই এক প্রভাবশালী কাব্যিক নিদর্শন।

কুরআনে কবিদের প্রসঙ্গ
সুরা আশ-শু'আরা (২৬:২২৪-২২৭)-তে কবিদের বিষয়ে আল্লাহ বলেন:
"আর কবিরা তো সেইসব বিভ্রান্তদের অনুসরণে থাকে। তুমি কি দেখ না, তারা তো প্রতিটি উপত্যকায় ঘুরে বেড়ায়, এবং যা তারা বলে, তা তারা করে না।"

প্রথমদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, ইসলাম কবিদের সমালোচনা করছে। কিন্তু এই আয়াতগুলোর সাথে সাথেই এসেছে একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যতিক্রম:

"তবে তারা ব্যতিক্রম, যারা ঈমান এনেছে ও সৎকাজ করে..." (২৬:২২৭)
অর্থাৎ কুরআনের সমালোচনার লক্ষ্য সেইসব কবি, যারা মিথ্যা, অসত্য ও বিভ্রান্তির পথে কবিতা রচনা করে। পক্ষান্তরে, সত্যবাদী, আল্লাহভীরু, নৈতিকতাবান কবি কুরআনের দৃষ্টিতে সম্মানিত।

নবীজি ﷺ ও সাহাবিদের কবিতাপ্রীতি
রাসুলুল্লাহ ﷺ স্বয়ং কবি ছিলেন না, কিন্তু তিনি সাহাবাদের কবিতায় উৎসাহ দিতেন। যেমন:
হাসসান ইবনে সাবিত (রাঃ)-কে তিনি বলতেন:

"তুমি কুফরীদের বিরুদ্ধে কবিতা বলো, জিবরাইল (আ.) তোমাকে শক্তি দেবে।(সহীহ মুসলিম)

হাসসান (রাঃ) ছিলেন “রাসুলের কবি” নামে পরিচিত। তিনি নিজের কবিতায় ইসলামের সত্য ও সৌন্দর্য, নবীজির চরিত্র এবং কুফর ও শিরকের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ করতেন।

কবিতার শক্তি ও দায়িত্ব
কবিতা হল হৃদয়ের দর্পণ। একজন কবি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুভূতির বার্তা ছড়িয়ে দিতে পারেন। তাই কুরআনের দৃষ্টিভঙ্গি হলো—
কবিতা যেন সত্যের বাহন হয়, মিথ্যার নয়। হেদায়তের আলো জ্বালায়, গোমরাহির নয়।

ইসলামি ঐতিহ্যে কবি ও সাহিত্য
ইসলামি ইতিহাসে বহু বড় বড় কবি জন্মেছেন, যারা কুরআনের ভাষা ও ভাব থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। যেমন:
• ইমাম শাফি (রহঃ)-এর কবিতা রয়েছে নীতিকথায় ভরপুর।
• ইবনে রুশদ, আল-মুতানাব্বি, আল-ইমাম বুসায়রি প্রমুখ ইসলামী বিশ্বে সম্মানিত কবি।
• আল বুরদার “কাসীদা বুরদা” আজও মুসলিম বিশ্বে প্রশংসিত।

আধুনিক পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়োগ
আজকের কবি যদি কুরআনের দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেন, তবে তার কবিতা হবে—
• ন্যায় ও ইনসাফের মুখপাত্র
• নির্যাতিতের কণ্ঠ
• আত্মার অনুরণন
• মানবতাবাদের শিখর
• দাওয়াহর এক শক্তিশালী মাধ্যম

কবিতা একটি ছুরি, যা দিয়ে ফুলও কাটা যায়, আবার মানুষও আহত হয়। ইসলাম কবিকে বাঁধেনি, বরং দিকনির্দেশনা দিয়েছে—
সত্যের পক্ষে লিখো, ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াও, কবিতাকে করো আলোর বাহন।
এই আলোকিত দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করলেই “আল কুরআনের আলোকে কবি ও কবিতা” হবে এক অপূর্ব সৌন্দর্য ও দায়িত্বের সম্মিলন।

প্রত্যেক কবি, যার কলম কুরআনের নূরের ছায়ায় স্নাত, সে কবিতা রচনা করে না শুধু, সে ইতিহাস গড়ে, সমাজ পাল্টায়, হৃদয় জাগায়।