চাল দিয়ে ভাত বিরিয়ানি জর্দা পোলাও ক্ষির পায়েশ চিড়া মুড়ি খই পিঠা সবই হয়। তবে সবাই কি সব ভালোভাবে তৈরি করতে পারে? এমনও অনেকে আছে ভাত ভালো পাকালেও বিরিয়ানি পাকাতে পারে না। পিঠা বানাতে কেউ পারদর্শী কিন্তু মুড়ি ভাজতে পারে না। আর তাই যে যেটা করতে দক্ষ তার সেটাই করা উত্তম নয়কি?
মনের ভাব প্রকাশ করতে চাই শব্দের আশ্রয়। কবিতা ছড়া পদ্য গল্প নাটক উপন্যাস প্রবন্ধ লিখতে হলে শব্দ দিয়েই লিখতে হয়। তাই বলে সব ভাব পদ্যে প্রকাশ করতে হবে কিংবা সব ভাব গদ্যে প্রকাশ করতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই। যে যে মাধ্যমে পারদর্শী তার সে মাধ্যমেই করা ভালো নয় কি?
উত্তরাধুনিকতার নামে অনেক বিসঙ্গতি বাক্যকে ঘাড় মটকে লাইন ভেঙে গদ্য কবিতা বলে চালিয়ে দেয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।  বলতে শোনা যায় যে, সত্যেন্দ্র, সুকুমার, নজরুল, রবীন্দ্রনাথের, পরে কবিতা থেকে ছন্দ বিদায় নিয়েছে। তাই কবিতায় ছন্দের ব্যবহারে বাধ্যবাধকতা নেই। যদিও অনেক কালোত্তীর্ণ গদ্য কবিতায় বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছে এবং এসকল গদ্য কবিতার অন্তরঙ্গ ছন্দের ঝংকারে মন্দ্রিত হয়েছে।  আবার অনেকে পঙক্তির শেষে মিল থাকাকে ছন্দ মনে করেন। বুধ-এর সাথে দুধ, মাছি-এর সাথে আছি দিলেই মনে করেন কবিতা হয়ে গেছে। এর মূল কারণ কবিতার প্রকৃতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা না থাকা।
পণ্ডিত বামনাচার্য বলেন, “কাব্যং গ্রাহ্যমলংকারাৎ।” যার অর্থ, অলংকৃত বাক্যই হলো কবিতা। অপরদিকে পণ্ডিত বিশ্বনাথ বলেন, “বাক্যং রসাত্মকং কাব্যম।” যার অর্থ, রসযুক্ত বাক্যই কাব্য। আবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবিতা মূল নির্দেশ করতে বলেছেন,
“অন্তর হতে আহরি বচন
আনন্দলোক করি বিরচন,
গীতির রস ধারা করি সিঞ্চন
সংসার -ধুলিজলে।”
তাহলে প্রশ্ন আসে, অলংকার এবং রস কী? এ দুটি বিষয় জানলে এবং বাক্যে জড়াতে পারলে আমরা পেয়ে যাবো কবিতার অবয়ব।
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বলেছেন,
“কবিতা নিরাভরণা নয়। নারী যেমন আকার -সাকারে, ইঙ্গিতে, সাজসজ্জায়, রং-চঙ্গে, বিলাস-প্রসাধনে নিজেকে আকর্ষণীয় করে তোলে কবিতাও তেমনি শব্দে, মায়ায় , মর্মে ছন্দে উপমায় চিত্রে ও অনুভূতির মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করে।”
কবিতার শরীরে এই সাজসজ্জা জড়াতে যেসকল উপাদান ব্যবহৃত হয় সেসকল উপাদানই হচ্ছে অলংকার। মানুষের ব্যবহার্য অলংকারের যেমন শেষ নেই তেমনি কবিতার অলংকারেরও শেষ নেই। তবে উভয় ক্ষেত্রে প্রকৃত সৌন্দর্য নির্ভর করে এর পরিমিত ব্যবহারের উপর। একটি বুনোফুল খোঁপায় গুজে একজন নারী যেমন তার রূপ সৌন্দর্যকে বর্ধিতভাবে প্রকাশ করতে পারে তেমনি একটি অলংকার দিয়েও একটি বাক্য হয়ে উঠতে পারে একটি কবিতা। যদি ছোট্ট একটি উদাহরণ দিই তাহলে বিষয়টি আরো পরিষ্কার হবে। যেমন - যদি বলি, শিশুটি সুন্দর। তাহলে এটি একটি বাক্য। এই বাক্যটি কবিতা নয়, এটি এজটি তথ্য। যদি বলি, শিশুটি ফুলের মতো সুন্দর। এটি যেমন একটি সার্থক বাক্য, সংজ্ঞা অনুযায়ী এটি একটি কবিতাও বটে। কেননা “ফুলের মতো” উপমাটি যুক্ত হওয়ার কারণে এটি অলংকৃত বাক্য। আর অলংকৃত বাক্য মানেই কবিতা।
আমরা যদি স্বাধীনতার কবি নির্মলেন্দু গুণের একটি কবিতার এই অংশটি দেখি-
"একটি কবিতা লেখা হবে তার জন্য অপেক্ষার উত্তেজনা নিয়ে
লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে
ভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে কখন আসবে কবি?
............................................
একটি কবিতা পড়া হবে, তার জন্য কী ব্যাকুল
প্রতীক্ষা মানুষের : কখন আসবে কবি? কখন আসবে কবি?
শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে,
রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে
অতঃপর কবি এসে – জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।
তখন পলকে দারুন ঝলকে তরীতে উঠিল জল,
হৃদয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার
সকল দুয়ার খোলা। কে রোধে তাহার বজ্রকন্ঠ বাণী?
গণসূয্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি
“এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”।"
(স্বাধীনতা শব্দটি কিভাবে আমাদের হলো -নির্মলেন্দু গুণ)
তাহলে দেখতে পাই গদ্যে হলেও কী অপূর্ব শব্দদ্যোতনা আর ছন্দের ঝংকার তোলে এই কবিতাটি।
আমরা এমনটি করতে ব্যর্থ বলেই নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর একটি উক্তিকে সামনে এনে বলি, তিনি ছন্দের দাসত্ব করতে নিষেধ করেছেন। আসলে কি তিনি তার উক্তি দ্বারা কবিতায় ছন্দ ব্যবহার বর্জন করতে বলেছেন? আমার মনে হয় উত্তরটি হবে 'না'। তিনি বলতে চেয়েছেন ছন্দ রক্ষা করতে গিয়ে বিসঙ্গতি শব্দ ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে। ছন্দ রক্ষার  খাতিরে যদি এমন একটি শব্দ ব্যবহার করা হয় যা একটি উৎকৃষ্ট কবিতার সমস্ত সৌন্দর্য চিলের মতো ছোঁ মেরে নিয়ে যায় তাহলে প্রচলিত ছন্দের কাঠামোতে বন্দী না হয়ে ছন্দের দাসে পরিণত হওয়া থেকে বিরত থাকতে বলেছেন।
ধরুন কেউ লিখলো-
"মাঘের দুর্দান্ত শীত কুয়াশা শরীরে
মেখেছে নরম রোদ শত আয়োজনে
প্রকৃতি পোহাচ্ছে ওম প্রলুব্ধ আদরে
সুখের পেয়ালা ভরে মধূ সঙ্কীর্তনে
মেঠোপথে হেটে যেতে সরিষার ফুল
ডেকে ডেকে বলে গেল এসোনা গো কাছে
অঙ্গভরে মেখে নাও এ শোভা অতুল
সপ্তবর্ণ আঙ্গিনায়, মক্ষিকার মাঝে
জীবনটা বেজে ওঠে নব নব রূপে
শীত উপভোগ করি নুতন আলোকে
জগতের সবকিছু মায়াবতী সুখে
জপিছে তোমার নাম এত সমাদরে
ছেড়ে যেতে এ ভূবন ব্যথা লাগে বুকে
হৃদয়টা কেঁপে ওঠে গহন অন্দরে । "
কত সুন্দর একটি চতুর্দশপদী!
অথচ একটু অভিনিবেশ দৃষ্টি বুলালে দেখা যায়- ৭ম পদে "কাছে"র সাথে অষ্টম পদে "মাঝে"র অন্তমিল এবং মাত্রার মিল করতে গিয়ে "মক্ষিকার" শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। মক্ষিকা অর্থ মাছি। পুরো কবিতার ভাবের সাথে এই "মক্ষিকার" সম্পর্ক কী? কাছে>মাঝে অন্তমিলটিও যথার্থ নয়। কবি যদি এখানে অমিত্রাক্ষরে লিখতেন এবং শব্দ চয়নে সতর্ক হতেন তাহলে এই বিভ্রাট হতো না। এই একটি শব্দ এবং একটি অন্তমিল পুরো কবিতার সৌন্দর্যকে ম্লান করে দিয়েছে।
৯ম পদে "জীবনটা বেজে ওঠে নব নব রূপে"। নব রূপে জীবন বেজে ওঠা থেকে সেজে ওঠা বেশি নান্দনিক নয় কি?
এটাই হচ্ছে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর, "ছন্দের দাসত্ব" না করার উপদেশ।
এবার আসি রসের কথায়। পাঠক হৃদয়ে কবির আবেগ উত্থিত ভাবের সঞ্চারকে বলা হয় রস। অর্থাৎ কবির ভাবনা পাঠক চৈতন্যকে টোকা দিলে পাঠক হাসেন, কাঁদেন, আবার আনন্দে ভাসেন। কখনো চিত্ত বিগলিত হয়ে মুষড়ে পড়েন। কখনো সাহসী হয়ে ওঠে শূন্যে মুষ্টি ছোড়েন। কবিতা দ্বারা পাঠক হৃদয়কে এভাবে আন্দোলিত করার নাম রস। কবতার রস কারো কারো মতে ৯ প্রকার, কারো মতে ১০ প্রকার। রসের আলোচনায় বিস্তারিত না গিয়ে শেষ করবো কয়েকজন বিখ্যাত কবির দৃষ্টিতে কবিতা কী তা উল্লেখের মাধ্যমে।
যেহেতু কবিতাকে শিল্পজ্ঞান করা হয় এবং যেহেতু শিল্পের কোনো প্রামাণ্য সংজ্ঞা নেই। তাই কবিতারও
প্রামাণ্য কোনো সংজ্ঞা নেই। তবে কবিতার নান্দনিকতাকে
বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে দেখেছেন। পাশ্চাত্যে একসময় মনে
করা হতো রূপক সৃষ্টির সক্ষমতাই কবিতা।  ডব্লিউ বি ইয়েটস বলেছেন-প্রতীকই কবিতা। জীবনানন্দ দাস বলেছেন- উপমা সৃষ্টির সক্ষমতাই কবিতা। ড. হুমায়ূন আজাদ বলেছেন- চিত্রকল্পই কবিতা। শামসুর
রাহমান বলেছেন-প্রতীক-চিত্রকল্প সৃষ্টির সক্ষমতাই কবিতা। কিংবদন্ততী কবি গীতিকার রফিকউজ্জামান বলেছেন- ছন্দময়, ভাবমধুর ও রসাত্মক
কাব্যই কবিতা। আবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন-কবিতায় ব্যবহৃত শব্দের সাধারণ অর্থের অতিরিক্ত অর্থ প্রকাশ করার সক্ষমতাই কবিতা।
মক্তু বিশ্বকোষ উইকিপিডিয়াতে বলা হয়েছে -“কবিতা বা
পদ্য শব্দের ছন্দোময় বিন্যাস যা একজন কবির আবেগোত্থিত অনভুূতি , উপলব্ধি ও চিন্তাকে সংক্ষেপে এবং উপমা-উৎপ্রেক্ষা-চিত্রকল্পের সাহায্যে উদ্ভাসিত করে এবং
শব্দের ছন্দায়িত ব্যবহারে সুমধুর শ্রুতিযোগ্যতা যুক্ত করে ।”
অনেকের কথাকে একত্র করে যদি বলি - শব্দ ছন্দ রূপক
প্রতীক উপমা অন্তমিলের যাদকুরী স্পন্দনের মাধ্যমে অলংকৃত বাক্যের সাহায্যে চিত্রকল্প ও রস সৃষ্টির মাধ্যমে
আক্ষরিক অর্থের অতিরিক্ত অর্থ প্রকাশের নামই কবিতা।
এ কথা সত্য যে সাহিত্যের শ্রেষ্ঠতম নির্যাসই হচ্ছে কবিতা- The best extract of literature. কবিতা হচ্ছে
শ্রেষ্ঠতম শব্দের শ্রেষ্ঠম বিন্যাস। এই বিন্যাসের জন্য প্রয়োজন ছন্দ এবং অলংকার। এস টি কোলরিজ পদ্য আর গদ্যের সুস্পষ্ট বিভাজন রেখা এঁকে দিয়েছেন এই বলে যে -Prose is-words in the best
order.
Poetry is- Best words in the best order.
কোলরিজ এর এই বিভাজনকে সমর্থন করে মাইকেল মধুসূদন দত্ত যথার্থই বলেছেন, কবিতা হতে হলে “শব্দের সাথে শব্দের বিবাহ দিতে হয়”। সে বিবাহ যত যুতসই তত টিকসই ও সার্থক। অন্তত এটুকু মেনে চললে কবিতা গদ্যে হোক আর পদ্যে হোক কালোত্তীর্ণ হতে বাধ্য।
অতএব, কবিতা বোদ্ধাগণের কবিতার প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য অস্বীকারপূর্বক গদ্য এবং পদ্যের শোভন সীমান্তরেখা অতিক্রম করে সব গদ্যকে কবিতার মান্যতা দেয়া উচিত নয় বলেই আমি মনে করি। কবিতার এই প্রকৃতি বিচারপূর্বক কবিতায় গৎবাঁধা গদ্যের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে কবিদেরই সচেষ্ট হওয়া জরুরি। নয়তো কবিতা সুন্দরী থেকে অচিরেই পাঠক মুখ ফিরিয়ে নেবে। আর শুনতে হবে-"ব্যর্থ প্রেমিকের থেকে ব্যর্থ কবির সংখ্যা অধিক" অপবাদ।


মুহাম্মদ মনিরুজ্জামান
৩০ জানুয়ারি ২০২২