বনলতা সেন পুরুষ নয়, নারী


বাংলা সাহিত্যের বহুল আলোচিত একটি কবিতা জীবনানন্দের 'বনলতা সেন'। কবি এস. ইসলাম যে সকল যুক্তি দিয়ে এটিকে সমকামীতার কবিতা বলেছেন তা যুক্তি-যুক্ত নয়। নিন্মলিখিত আলোচনায় আশাকরি তা পরিষ্কার হবে। জীবনানন্দ প্রথম স্তবকে লিখেছেন -


   " হাজার বছর ধরে পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে/ সিংহল সমুদ্র থেকে আরও দূর অন্ধকারে মলয় সাগরে/ অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্ভিসার অসোকের ধূসর জগতে/ সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর বিদর্ভ নগরে"


   এখানে কবির ব্যক্তি জীবনের দুঃখ, বেদনা, হতাশা, ক্লান্তির চিত্রই প্রকটিত হয়েছে। পরবর্তী পংক্তিতে তা পরিষ্কার -


    "আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন।"


   এই হতাশাগ্রস্থ ক্লান্ত কবিকে একদিন -


     "দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটরের বনলতা সেন।"


     শান্তির নীড় বনলতা সেনকে হারিয়েই হতাশা আর ক্লান্তি কাধে নিয়ে উপস্হিত হয়েছেন জীবনের প্রান্তে। কবি লিখেছেন-
    "অতিদূর সমুদ্রের' পর/ হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা"


     দিশাহীন কবি অবশেষে দেখা পেয়েছেন দুদণ্ড শান্তির নীড় বনলতা সেনের, সমুদ্রে দিকভ্রষ্ট নাবিক যেমন ফিরে পায় সবুজ দ্বীপ -


     "সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে/ দারুচিনি দ্বীপের ভিতর"


    তেমনই কবি দেখা পেয়েছেন বনলতা সেনের-


    "তেমনই দেখেছি তারে অন্ধকারে"


    এখানে কবি অন্ধকার বলতে প্রেমহীন জীবনের শেষ প্রন্তকেই বুঝিয়েছেন। তাই তো নিরন্তর কবির অপেক্ষায় চেয়ে থাকা বনলতা সেন প্রশ্ন করেছেন -


     "এতদিন কোথায় ছিলেন?"


  এই নারীর হৃদয়ে কামনা নয় বিরহ বেদনাই প্রকাশ পেয়েছে। এই নারী দৈহিক সুখের নয় আত্মীক শান্তির নীড়। তাই কবি লিখতে পেরেছেন-


     "পাখীর নীড়ের মত চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।"


   কেউ কেউ এই পঙক্তিকে উপমা অলংকার ভেবে ভুল করেন, আসলে এটি একটি চিত্রকল্প। এখানে বনলতার চোখ পাখীর নীড়ের মত নয়, তার চোখ পাখীর নীড়ের মত শান্তির আশ্রয়। এ আশ্রয় নারীর চোখেই পাওয়া সম্ভব।


    কবি দ্বিতীয় স্তবকে লিখেছেন-


    "চুল তার কবেকার বিদিশার নিশা/ মুখ তার শ্রাবস্তির কারুকার্য;"


     ইতিহাস নেড়ে ঘেটে দেখলেই বোঝা যাবে প্রাচীন বিদিসা নগরী আজও অন্ধকার রহস্যময়। এই রহস্যময়তা নারীর চুলের আঁধারেই থাকতে পারে, পুরুষের নয়। মুখে তার প্রাচীন তামাটে শ্রাবস্তি নগরীর কারুকার্য যা সৌন্দর্যময় নারীর প্রতীক।


     তৃতীয় স্তবকে কবি লিখেছেন -


     "সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন/ সন্ধ্যা আসে;"


     এভাবেই কৈশর যৌবন পেরিয়ে বার্ধক্য নেমে আসে, ঘনিয়ে আসে আঁধারের সন্ধিক্ষণ। আর তখন -


     "পৃথিবীর সব রঙ মুছে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন"


   অর্থাত্ স্মৃতির পটে ভেসে ওঠে ফেলে আসা জীবনের 'পাণ্ডুলিপি'-


    "তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল।/ সব পাখি ঘরে আসে- সব নদী, ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন"


     এভাবেই ফুরিয়ে আসে জীবন। তখন আর পাশে বসে খুনসুটির কিংবা বুকে মুখ  গুঁজে দেবার সময় থাকে না-


    "থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।"


    কাজেই এখানে কামোন্মুখ দেহ সৌষ্ঠবের বিবরণ না থাকাই কাঙ্খিত।


     কবির 'বনলতা সেন' কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে ডিসেম্বর মাসে, তখন কবির বয়স ৩৬ বছর। কাজেই কবির নেই কৈশরের যৌবনোচ্ছ্বাস, নেই অতৃপ্ত কামনা। আছে প্রেম হীন ব্যর্থ জীবনের হতাশা, ক্লান্তি, গ্লানি। কাজেই কবি যে শান্তির আশ্রয় চেয়েছেন তা নারীর কাছেই পাওয়া সম্ভব।


    জীবনানন্দের কাব্যে বিভিন্ন নারী চরিত্রের সন্ধান পাওয়া যায় যেমন শ্যামলী, সুরঞ্জনা, সুচেতনা, সরোজনী, সেফালিকা বোস, সুজাতা ও অমিতা বোস। এতেই বোঝা যায় কবি সমকামী ছিলেন না।


    এছাড়া কবির ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে রচিত 'কারুবাসনা' উপন্যাসে বনলতা সেন নামক নারী চরিত্রটি পাওয়া যায়।


    ডা. ভূমেন্দ্র গুহ কবির 'লিটেরেরী নোটস' গবেষণা করে প্রমান করেছেন যে কবি বিবাহের পূর্বে শোভনা নামক এক নারীর প্রেমে আচ্ছন্ন ছিলেন। বিবাহিত জীবন সুখের না হওয়ায় সেই নারীর প্রতি টান অনুভব করেছিলেন বা শান্তির আশ্রয় চেয়েছিলেন বলেই বোধ হয়।


    
   তথ্য সূত্র : উইকিপিডিয়া।