Maria Rilke (1875-1926) প্যারিস ॥ ফেব্রুয়ারি ১৭, ১৯০৩
আপনি জিজ্ঞাসা করেছেন আপনার কবিতাগুলি ভালো কি না। আপনি আমাকে জিজ্ঞাসা করতে পারেন। ইতঃপূর্বে আপনি আরও অনেককে জিজ্ঞাসা করেছেন। পত্রপত্রিকায় আপনি কবিতা প্রেরণ করে থাকেন। আপনার কবিতার সঙ্গে তুলনা করে থাকেন অন্যদের কবিতার এবং আপনি পীড়িত বোধ করেন, যখন কোনো সম্পাদক আপনার কবিতা প্রত্যাখ্যান করেন। এখন, আপনি যখন আমাকে কিছু উপদেশ দিতে অনুমতি দিয়েছেন, আমি বলি : এ সমস্ত কিছুই পরিত্যাগ করুন। আপনি বহির্জগতে দৃষ্টিপাত করছেন; এবং সমস্ত জিনিসের মধ্যে ঠিক ওই জিনিসটিই আপনি এখন কিছুতেই করবেন না। কেউ আপনাকে উপদেশ দিতে পারে না; কেউ আপনাকে সাহায্য করতে পারে না; কেউ না। একটিমাত্র উপায় আপনার আছে।
নিজের ভিতরে প্রবেশ করুন। আবিষ্কার করুন : কোন্ সে প্রেরণা, যা আপনাকে লিখতে প্রণোদিত করে। হৃদয়ের গভীরতম প্রদেশে দেখুন : তার শিকড় প্রোথিত হয়েছে কি না। সর্বাগ্রে রাত্রির নির্জনতম মুহূর্তে নিজেকেই জিজ্ঞাসা করুন : আমি কি লিখবই? গভীর উত্তরটির জন্য খনন করুন নিজেরই অস্তিত্ব। যদি তা অস্তিবাচক, যদি গম্ভীর প্রশ্নটির এই প্রগাঢ় অথচ অনায়াস উত্তর মেলে-আমি লিখবই; তাহলে সেই প্রণোদনায় নিজের জীবন নির্মাণ করুন। আপনার জীবনের তাৎপর্যহীন তুচ্ছতম মুহূর্তটিও সেই প্রেরণার প্রতীক হয়ে থাকবে, তার সাক্ষ্য বহন করে চলবে।
প্রকৃতির সন্নিকটে আসুন তারপর। বলতে প্রয়াসী হোন, যেন আপনিই প্রথমতম ব্যক্তিদের একজন : যা দেখলেন, যা পেলেন, যা ভালোবাসলেন, যা হারালেন। প্রেমের কবিতা লিখবেন না। সেইসব আঙ্গিক, যা অতি পরিচিত ও সাধারণ, প্রথমে পরিহার করুন। তা অত্যন্ত দুষ্কর! যেখানে সম্পন্ন ঐতিহ্য রয়েছে, যা অংশত উজ্জ্বল, সেখানে আর একটি মৌলিক সৃষ্টি বিশেষ কঠিন। তার জন্য আবশ্যিক সম্পূর্ণ পরিণতি ও পরমা শক্তি। সুতরাং সাধারণ বিষয়গুলো থেকে তাদের দিকে ফিরুন, আপনার দৈনন্দিন জীবন যাদের জোগান দেয়। আপনারই বেদনা ও বাসনাকে রূপ দিন; বহতা চিন্তাধারা এবং কোনো সৌন্দর্যে বিশ্বাস। হৃদয়ানুভূত প্রশান্তি এবং সবিনয় আন্তরিকতায় এদের প্রকাশ করুন। প্রকাশের কাজে তাদের প্রয়োগ করুন, যারা আপনাকে ঘিরে রয়েছে: আপনার স্বপ্নের ছবিগুলি কিংবা আপনার স্মৃতির বিষয়গুলি। যদি প্রাত্যহিক জীবন দরিদ্র বলে বোধ হয়, তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনবেন না। নিজেকেই অভিযুক্ত করুন;নিজেকেই বলুন : আমি যথেষ্ট পরিমাণে কবি নই যে, এই জীবনের সমৃদ্ধিকে রূপ দিই। স্রষ্টার কাছে দারিদ্র্য কিছু নয় যেহেতু, কোনো জায়গাই তাঁর কাছে তুচ্ছ বা তাৎপর্যহীন নয়। এবং এমনকি, আপনি যদি কোনো কয়েদখানায় থাকতেন, যার দেয়ালগুলো বাইরের কোনো ধ্বনি আপনার ইন্দ্রিয়ের কাছে পৌঁছে দিত না, তাহলে কি প্রতিনিয়তই আপনি আপনার শৈশব পেতেন না; সেই অতুল রাজকীয় ঐশ্বর্য, সেই স্মৃতির স্বর্ণভাণ্ডার?
নিজের চেতনাকে সেইদিকে ফেরান। সেই সুদূর অতীতের নিহিত অনুভূতিগুলি তুলে ধরতে চেষ্টা করুন; আপনার ব্যক্তিত্ব অধিকতর শক্তিশালী হবে; আপনার নিভৃতি হবে বিসারিত; সে হবে এক গোধূলি-নিবাস, যার পাশ দিয়ে দূরে চলে যাবে আর সকলের কোলাহল। এবং এই যে যাত্রা অন্তর্লীন, এই যে নিজের গভীরে ডুবে-যাওয়া, তা থেকে যদি আপনার কবিতার জন্ম হয়, তাহলে সেই কবিতা ভালো না মন্দ-এই প্রশ্ন আর কাউকে করতে হবে না। এবং এই কবিতাগুলোর প্রতি আপনি পত্রপত্রিকাকেও আকৃষ্ট করতে চেষ্টা করবেন না; এগুলিতে অটুট থাকবে আপনারই একান্ত প্রিয় অধিকার; এগুলো হবে আপনারই জীবনের অংশবিশেষ এবং কণ্ঠস্বর। একটি শিল্পকর্ম উৎকর্ষ লাভ করে, যদি তার জন্ম হয় অনিবার্যত; উৎসের এই অনিবার্যতার মধ্যেই নিহিত থাকে এর প্রকৃত মূল্য; অন্য কোথাও নয়।
অতএব, আমি আপনাকে শুধু এই উপদেশই দিতে পারি : নিজের ভেতরে প্রবেশ করুন; আবিষ্কার করুন সেই গভীরতা, যেখান থেকে উৎসারিত হচ্ছে আপনার জীবনধারা; আপনি লিখবেন কি না-এই প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবেন এই উৎসেই। গ্রহণ করুন সেই উত্তরটি, যেমনই তা নিনাদিত হোক, প্রতিটি শব্দের বিশ্লেষণে নিবিড় ব্যাপৃত না হয়েই। হয়তো দেখা যাবে : শিল্পই আপনার জীবনব্রত। তাহলে সেই ভাগ্যকে স্বীকার করুন; এবং তা বহন করুন; তার গুরুভার এবং তার ঐশ্বর্য। কখনোই বাইরের কোনো পুরস্কারের প্রত্যাশা না করে। যেহেতু, স্রষ্টা হবেন স্বয়ং এক ভুবন; নিজের ভেতরেই খুঁজে পাবেন সবকিছু; এবং পাবেন প্রকৃতির কাছে, যার সঙ্গে তিনি সংরক্ত। ...আমি আপনাকে আর কী বলব? আমার তো মনে হয় : সবকিছুরই একটা যথাযথ তাৎপর্য আছে। শেষে আমি আপনাকে এই উপদেশটুকু দিতে চাই : প্রশান্তি এবং গভীরতার ভেতর দিয়ে আপনি হয়ে উঠুন; বাইরে তাকানো-এর চেয়ে আর কোনো উপায়ে আপনি আপনার অগ্রসৃতির ধারাকে প্রচণ্ড ব্যাহত করতে পারেন না; আর পারেন বাইরে থেকে আপনার সেইসব প্রশ্নের উত্তর চেয়ে, যা নাকি আপনার অন্তরতর অনুভূতিই দিতে পারে আপনার নির্জনতম মুহূর্তে....
ভিয়ারেগ্গিও, ইতালি ॥ এপ্রিল ৫, ১৯০৩
...নিজেকে শ্লেষ-শাসিত হতে দেবেন না, বিশেসত বন্ধ্যা মুহূর্তগুলিতে। জীবনকে করতলগত করার অন্যতম একটি উপায় হিসাবেই একে ব্যবহার করবেন এবং তা উর্বর মুহূর্তেই। বিশুদ্ধ প্রয়োগে শ্লেষ পবিত্র হয়ে ওঠে; আর তার জন্য কাউকে লজ্জিত হতে হয় না। যখন আপনি এর সঙ্গে আপনার আত্যন্তিক পরিচিতি বুঝতে পারবেন এবং এর সঙ্গে আপনার ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতা যখন আপনাকে ভীত করে তুলবে; তখন, মহৎ এবং গভীর বিষয়গুলোর দিকে ফিরুন; যাদের কাছে এ অকিঞ্চিৎকর এবং অসহায় হয়ে পড়ে। সবকিছুর গভীরতাই হোক আপনার অন্বিষ্ট, যেখানে শ্লেষ কখনও অবতরণ করে না। এইভাবে যখন আপনি তাকে মহত্বের প্রান্তে নিয়ে এলেন, যুগপৎ পরীক্ষা করে দেখুন : এই উপলব্ধির উৎসার আপনার অস্বিত্ব থেকে অনিবার্য কি না। যেহেতু, গভীর কোনো কিছুর প্রভাবে এ আপনার কাছ থেকে দূরে সরে যাবে; (যদি অপরিহার্য না হয় তা) অথবা আরও অনেক শক্তি নিয়ে একটি মারাত্মক অস্ত্র হয়ে উঠবে (যদি তা অন্তরঙ্গভাবে আপনার মধ্যে থাকে) এবং, তা হয়ে উঠবে আপনার অন্যতম কৌশল, যা দিয়ে আপনি সৃষ্টি করবেন আপনার শিল্প।
এবং দ্বিতীয় যে জিনিসটি আমি আপনাকে বলতে চাই, তা হল এই : সামান্য কয়েকটা বই-ই আমার কাছে অপরিহার্য এবং তাদের মধ্যে দুটি প্রকৃতপক্ষে সর্বদাই আমার সঙ্গে থাকে, আমি যেখানেই থাকি না কেন। এমনকি এখানেও তারা আমার সঙ্গে রয়েছে : বাইবেল এবং প্রখ্যাত ডেনিস লেখক জেমস পিটার জ্যাকোবসনের গ্রন্থাবলি। আমি ঠিক জানি না আপনি এঁর বইগুলোর কথা জানেন কি না! ভালো অনুবাদ প্রকাশ করেছেন Reclam’s Universal Librery। জে.পি. জ্যাকোবসনের ছোটো গ্রন্থটি, যার নাম Six Tales সংগ্রহ করুন এবং তাঁর উপন্যাসটি Niels Lyhne। প্রথম গ্রন্থটির প্রথম গল্পটি দিয়ে শুরু করুন; গল্পটির নাম Mogens। সুখ, সমৃদ্ধি এবং অনুচ্চার্য মহত্ত্ব-ভরা একটি জগৎ আপনার সম্মুখে উদ্ভাসিত হয়ে যাবে। কিছুদিনের জন্য এই বইগুলোর জগতে বাস করুন; শিক্ষণীয় যা পান, তা গ্রহণ করুন কিন্তু সর্বোপরি তাদের ভালোবাসুন। আপনার এই ভালোবাসা হাজারো গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ফিরে আসবে; এবং আপনার জীবন যাই হোক না কেন, আমি এই বিষয়ে দৃঢ়নিশ্চিত যে আপনার বেড়ে-ওঠার অভিজ্ঞতা, হতাশা ও আনন্দের গুরুত্বপূর্ণ বন্ধনগুলোর মধ্যে এটি হবে অন্যতম। সৃষ্টির প্রক্রিয়া সম্পর্কে যদি আমি কিছু শিখে থাকি, তার গভীরতা এবং চিরকালীনতা সম্পর্কে, তাহলে আমি দু-জনের নাম উল্লেখ করতে পারি : মহান লেখক জ্যাকোবসন এবং অগাস্ট রঁদা, জীবিত শিল্পীদের মধ্যে যাঁর তুল্য কেউ নেই আর।
তরজমা : রমেন্দ্রনারায়ণ নাগ