উদাহরণঃ
অক্ষরবৃত্তে মুক্তক ছন্দের কয়েকটি উদাহরণ দিইঃ
মুক্তকছন্দের প্রবর্তক রবীন্দ্রনাথ এর বলাকা কাব্যগ্রন্থের একটি অক্ষরবৃত্তে সমিল মুক্তক ছন্দের কবিতার উদাহরণ দিচ্ছি–


"হে বিরাট নদী,
অদৃশ্য নিঃশব্দ তব জল
অবিচ্ছিন্ন অবিরল
চলে নিরবধি।
স্পন্দনে শিহরে শূন্য তব রুদ্র কায়াহীন বেগে;
বস্তুহীন প্রবাহের প্রচন্ড আঘাত লেগে
পুঞ্জ পুঞ্জ বস্তুফেনা উঠে জেগে;
আলোকের তীব্রচ্ছটা বিচ্ছুরিয়া উঠে বর্ণস্রোতে
ধাবমান অন্ধকার হতে;
ঘূর্ণাচক্রে ঘুরে ঘুরে মরে
স্তরে স্তরে
সূর্য-চন্দ্র-তারা যত
বুদবুদের মতো।"


অথবাঃ
"যখন তাদের দেখি/ হঠাৎ আগুন লাগে/ চাষীদের মেয়েদের/
বিব্রত আঁচলে;/ সমস্ত শহর জুড়ে/ শুরু হয় খুন, লুঠ,/ সম্মিলিত অবাধ ধর্ষণ,
ভেঙে পড়ে শিল্পকলা,/ গদ্যপদ্য দাউদাউ পোড়ে/ পৃষ্ঠা সমস্ত গ্রন্থের;
ডাল থেকে/ গোঙিয়ে লুটিয়ে পড়ে/ ডানা ভাঙা নিঃসঙ্গ দোয়েল
আর্তনাদ করে বাঁশি/ যখন ওঠেন মঞ্চে/ রাজনীতিবিদগণ।
----কবিতাঃরাজনীতিবিদগন-(হুমায়ুন আজাদ)


মাত্রাবিন্যাস:
৮+৮+৮
৬+৮+৮+১০
১০+১০+৮
৪+৮+১০
৮+৮+৮


  এসব উদাহরণ থেকে এটা স্পষ্ট যে, পর্বের মাত্রাসংখ্যা অসমান হলেও জোড় মাত্রার পর্বের সাথে জোড়মাত্রার পর্ব অথবা বিজোড় মাত্রার পর্বের সাথে বিজোড় মাত্রার পর্ব গঠিত হয়েছে।  তাই বলা যায় এ কবিতাগুলো অক্ষরবৃত্তে মুক্তক ছন্দের কবিতা!


অন্ত্যমিল থাকলে তা অক্ষরবৃত্তে সমিল মুক্তক ছন্দ, অন্ত্যমিল না থাকলে তা অক্ষরবৃত্তে অমিল মুক্তক ছন্দ!!


★[০২]'নঞ'ছন্দ মুক্তক(সমিল বা অমিল)ঃ
---------------------------------------------------
উত্তরাধুনিক কবিগণ প্রধান ৩ ছন্দের নিয়ম থেকে বের হয়ে এসে কিছুটা অক্ষরবৃত্ত ও কিছুটা গদ্যের সংমিশ্রণে একটি ছন্দের আবিষ্কার করেন, যাকে কেউ কেউ 'নঞ'ছন্দ' বলে থাকেন! ছন্দহীন বা নঞ'ছন্দ মুক্তকে নির্দিষ্ট কোন পর্ববিভাজন, নির্দিষ্ট কোন ছন্দ মানা হয় না!
অর্থাৎ যে মুক্তক কবিতায় পর্বগুলোর মাত্রা একেক চরণে একেক রকম তা শুধুই মুক্তক বা 'নঞ' ছন্দের কবিতা। 'নঞ' অর্থে না বোঝায়, অর্থাৎ স্বাভাবিক দৃষ্টিতে মনে হবে ছন্দ নেই, কিন্তু গভীরভাবে তাকালে এর সুন্দর সুন্দর উপমা, শব্দালংকার ও প্রবহমানতার কারণে সুন্দর এক মার্জিত ছন্দের দ্যোতনা অনুভব করা যায়! অন্ত্যমিল থাকলে সমিল 'নঞ' মুক্তক, আর অন্ত্যমিল না থাকলে তা অমিল 'নঞ' মুক্তক কবিতা যেটা কোন ছন্দের কাঠামোতে পড়ে না অর্থাৎ গদ্যকবিতা!


'নঞ'ছন্দ মুক্তক আবার দু'প্রকারঃ ক)সমিল 'নঞ'ছন্দ মুক্তক ও খ)অমিল 'নঞ'ছন্দ মুক্তক


ক)অন্ত্যমিল থাকলে তা সমিল 'নঞ'ছন্দ মুক্তক।


খ)অন্ত্যমিল না থাকলে তা অমিল 'নঞ'ছন্দ মুক্তক, আর অমিল 'নঞ' মুক্তক ছন্দ-ই হলো অতি আধুনিক গদ্যকবিতার ছন্দ!


কয়েকটি উদাহরণ দিলে বুঝতে সুবিধা হবে!


ক)সমিল 'নঞ'ছন্দ মুক্তক:
যে 'নঞ' ছন্দে অন্ত্যমিল থাকে তা-ই সমিল নঞ'ছন্দ মুক্তক । সমিল নঞ'ছন্দ মুক্তকে বিভিন্ন স্বাধীন অন্ত্যমিল বা মিত্রাক্ষরবিন্যাস করা হয়।


উদাহরণঃ
"তুমি আমার ভাগ্যবিধাতা,/১০ করি যে তোমায়/৬ সর্বদায় স্মরণ;/৭
ভাগ্য আমার সু-প্রসন্ন করো,/১১ করো শুভ সত্যের পথে বরণ!/১২
যত ভয়-দ্বিধা আমার/৯ বিদূর করো প্রভু,/৭
ভুলতে তোমাকে চাই না ধরায়/১২ মরণকালে কভু!/৭"
(''তুমি আমার ভাগ্যবিধাতা''-মজনুআহাদী)


উপরের কবিতাংশে সমমাত্রার পর্ববিভাজন নেই কিন্তু অন্ত্যমিল আছে তাই তা "সমিল 'নঞ'ছন্দ মুক্তক" কবিতা!


খ)অমিল 'নঞ'ছন্দ মুক্তকঃ
----------------------
***
"এখন যৌবন যার/৮ মিছিলে যাবার তার/৮ শ্রেষ্ঠ সময় /৫
এখন যৌবন যার/৮ যুদ্ধে যাবার তার/৭ শ্রেষ্ঠ সময় /৫
মিছিলের সব হাত/৮  কণ্ঠ পা এক নয়।/৭


সেখানে সংসারী থাকে,/৮ সংসার বিরাগী থাকে,/৮
কেউ আসে রাজপথে/৮ সাজাতে সংসার।/৬
কেউ আসে জ্বালিয়ে/৭ বা জ্বালাতে সংসার/৭
শাশ্বত শান্তির যারা/৮ তারাও যুদ্ধে আসে।"/৭
          ('‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’)-হেলাল হাফিজ


উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান নিয়ে লেখা এ বিখ্যাত কবিতাটি মূলত গদ্যছন্দে লেখা হলেও এর পর্ববিন্যাসে অক্ষরবৃত্তেরই ছাপ পাওয়া যায়। কিছু কিছু শব্দ বাদ দিলে একে অক্ষরবৃত্তে মুক্তক ছন্দে লেখা বলেই মনে হয়! তাই এটি অমিল 'নঞ' ছন্দ মুক্তকের কবিতা!


অথবাঃ
"তোমার পন্থপানে আমি/৯ ছুটে চলেছি পথ/৭ অনন্তকাল ধরে;/৭
তবুও তোমার আমি/৮ পেলাম না হায় দেখা/৭
বড়ই কষ্টে কাটছে আমার/১০ দিবস ও রজনী!/৭
জ্বলে এই হৃদয়মাঝে/৯ তোমার প্রেমের অনল!"/৯
             (''তোমার পথে''-মজনুআহাদী)


উক্ত লাইনগুলোতে অন্ত্যমিল ও সমমাত্রার পর্ববিভাজন নেই, তাই তা অমিল 'নঞ'ছন্দ মুক্তকের কবিতা বা গদ্য কবিতা!


★নঞ'ছন্দ মুক্তকের আরো দু'টি উদাহরণ:-
-------------------
১)"নঞ'ছন্দ সমিল মুক্তক:-
-----------------------
"তুমি যে আমার ভাগ্যবিধাতা, করছি তোমায় সর্বদায় স্মরণ;
ভাগ্য আমার সু-প্রসন্ন করো, করো শুভ সত্যের পথে বরণ!


যত ভয়-দ্বিধা আমার বিদূর করো প্রভু,
ভুলতে তোমাকে চাই না ধরায় মরণকালে কভু!"
(''ভাগ্যবিধাতা'-মজনুআহাদী