দুখু মিয়া থেকে কবি নজরুল-এক বিস্ময়কর প্রতিভার নাম
মাজহারুল মোর্শেদ
বিংশ শতাব্দীর এক এক বিস্ময়কর প্রতিভার নাম কাজী নজরুল ইসলাম। পরাধীন দেশের মানুষকে তিনি দিয়েছেন স্বাধীনতা অর্জনের শক্তি-সাহস, মানবতাবোধের উদারতা, সাম্য চিন্তার অনুপ্রেরণা। কাজী নজরুলের আবির্ভাব যেন ধুমকেতুর মতো, সাইক্লোন ছাড়িয়ে দ্যুলোক-ভ’লোক কাঁপিয়ে তোলে। বহুদিনের পুরানো জরা-জীর্ণ পঙ্কিলতা সরিয়ে, অন্ধকার ঠেলে ক্রমশঃ আলোর বিচ্ছুরণ, আশা- আকাঙ্খ্যা, উন্নত চিন্তা-চেতনা, ভাব-ভঙ্গীতে উদ্দীপ্ত এক নির্ভীক তারুণ্যের উজ্জলতা ফিরে আসে। তাঁর কবিতায়, গানে অনবরত ধ্বনিত হয় স্বাধীনতার কথা, মানবতার কথা, সাম্যেও বাণী, বাঁধন ছেঁড়ার গান। এ জন্য কত সংগ্রাম করতে হয়েছে, রাস্তায় নামতে হয়েছে, জেল জুলুম অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে।
কাজী নজরুল ইসলামের পারিবারিক নাম ছিল দুখু মিয়া। এই দুখু মিয়ার জন্ম কলকাতার মতো শিক্ষার আলোকে উজ্জ¦ল এবং ধন সম্পদে পরিপূর্ণ নগরীতে নয়, এমন কি বর্ধমানের মতো মফস্বল শহরেও নয়। পশ্চিমবঙ্গে বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার একটি অজ গ্রাম চুরুলিয়া সেখানে ১৮৯৯ সালের ২৪ শে’ মে (১১ জৈষ্ঠ ১৩০৬) কাজী পরিবারে কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম হয়। যে পরিবেশ এবং পরিবারে তাঁর জন্ম সেখানে রুপোর চামুচ মুখে নিয়ে কেউ জন্ম গ্রহণ করে না। সত্যিকার অর্থে তাঁর মাতা-পিতার পরিবার ছিলো অত্যন্ত দরিদ্র।
দরিদ্র মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করা নজরুলের প্রাথমিক শিক্ষা ছিল ধর্মভিত্তিক। তাঁর ভবঘুরে বাল্যকাল আর স্কুল শিক্ষা নিয়ে নানা গল্প প্রচলিত আছে। যেমন অল্প বয়সে স্থানীয় মসজিদে মুয়াজ্জিনের কাজ ও ইমামতী করা। কৈশোরে ভ্রাম্যমাণ নাটক (লেঠো গান) দলের সঙ্গে কাজ করা, অর্থের অভাবে পড়াশোনা করতে না পারা, আসানশোলের একটি রুটির দোকানে কাজ করা, রেলওয়ের গার্ডের বাসায় চাকরি করা, এমন ধারণা মোটামুটি ভাবে প্রতিষ্ঠিত।
কাজী নজরুলের পিতা কাজী ফকির আহমেদ একজন দলিল লেখক ছিলেন। শেষ জীবনে এসে অত্যন্ত বেহিসেবি ও অমিতব্যয়িতার কারণে তিনি কিছুটা দরিদ্র হয়ে পড়েছিলেন, এটা সত্য। তবে নজরুলের পূর্বপুরুষগণ মোটেই দরিদ্র ছিলেন না। মোগল আমলে তাঁরা নবাবদের চাকুরে ছিলেন এবং স্থানীয়ভাবে বিচারকাজের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। চুরুলিয়ায় তাঁদের প্রচুর না হলেও যথেষ্ট কৃষিজমি ছিল।
আরবি-ফারসিসহ চারটি ভাষা জানা এই সুপুরুষ ফকির আহমেদের দ্বিতীয় স্ত্রী ছিলেন নজরুলের মা জাহেদা খাতুন। তিনি খুব উচ্চবংশজাত নারী ছিলেন। এ ঘরে তাঁর চার সন্তানের জন্ম হয়। কাজী সাহেব জান, কাজী নজরুল ইসলাম, কাজী আলী হোসেন ও বোন উম্মে কুলসুম। কাজী সাহেব জান বেশি লেখাপড়া করতে পারেননি। রানীগঞ্জের কয়লাখনিতে চাকরি নেন।
কাজী নজরুলের পিতা কাজী ফকির আহমদ অত্যন্ত বেহিসেবি জীবন-যাপন করার কারণে শেষ জীবনে এসে তাঁকে বড় নিঃশ্ব অবস্থায় মৃত্যু বরণ করতে হয়েছিল। ফলে অনেক দুঃখ-কষ্টে কেটেছে নজরুলের বাল্যজীবন। দরিদ্রতা যেন জগদ্দল পাথরের মতো তাঁর ঘাঁড়ে চেপে বসেছিল। যে বয়সে একটি ছেলে অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে পড়াশুনা করার কথা সেই বয়সে দারিদ্রতার কশাঘাতে তাঁকে রুটির দোকানে কাজ করতে হয়। দুটো পয়সা রোজগারের জন্য লেটোর দলে গান করতে হয়, রেলওয়ের গার্ডের বাসায় চাকরি করতে হয়। দরিদ্রতা তাঁর জীবনে এমন ভাবে চেঁপে বসেছিল যে, কোনটি বড়কাজ আর কোনটি ছোটকাজ এ নিয়ে চিন্তা করার অবকাশ ছিল না। বালক কাজী নজরুল বাল্য বয়সেই জীবিকার তাগিদে আসানশোলের বকশ মিয়ার রুটির দোকানে চাকরি নেন। রুটি বানানোর কাজ করার সময় তিনি লিখেছিলেন-
‘‘মাখতে মাখতে গমের আটা
ভিজে গেল আমার গাটা” (সংগৃহিত)
নজরুলের প্রথম জীবনীকার আব্দুল কাদির- ‘সওগত’ জৈষ্ঠ ১৩৫৪ সংখ্যায় “নজরুলের জীবন ও সাহিত্য” প্রবন্ধে লিখেছেন- কবি নজরুল বাল্যকালে পিতৃহীন হন। ১৩১৪ সালের সাতই চৈত্র তাঁর পিতা দেহ ত্যাগ করেন। ফলে দরিদ্রের সংসাওে বিষম বিপর্যয় দেখা দেয় ও কবির পড়াশুনার অতিশয় ব্যাঘাত ঘটে। ১৩১৬ সালে দশ বছর বয়সে নজরুল গ্রামের মক্তব থেকে নিম্ন প্রথমিক পরীক্ষায় পাস করেন। অতঃপর এক বৎসর কাল সেই মক্তবেই শিক্ষকতা করেন। সে সময় আশেপাশের পল্লীতে মোল্লাগিরি করে দু’পয়সা রোজগারে চেষ্টা করেও দেখেছিলেন এবং মাঝে মাঝে মাজার শরীফের খাদেমগিরি ও মসজিদের ইমামতীও করতেন”
কিশোর নজরুলের বুদ্ধিমত্তা ও চিন্তা চেতনায় মুগ্ধ হয়ে ময়মনসিংহ জেলার রফিজুল্লাহ নামে একজন পুলিশের দারোগা তাঁকে নিয়ে যেয়ে নিজ জেলার দরিরামপুর হাইস্কুলে ভর্তি করে দেন। কিন্তু সেখানেও তাঁর মন বেশিদিন টিকে নাই। তাই তিনি সেখান থেকে চলে যান। এরপর কাশিম বাজারের মহারাজ মনিন্দ্র চন্দ্র নন্দীর অর্থায়নে পরিচালিত মাথরুন হাইস্কুলে ভর্তি হন। জমিদার কর্তৃক পরিচালিত স্কুলে সুযোগ-সুবিধা একটু বেশি পাওয়ার প্রত্যাশা নিয়েই নজরুল এ স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। “মাথরুন হাইস্কুল ছেড়ে আসার পর নজরুল রানীগঞ্জ থানার শিয়ারশোল রাজস্কুলে ৭ম শ্রেণীতে ভর্তি হন। বার্ষিক পরীক্ষার পর ডাবল প্রমোশন নিয়ে একেবারে ৯ম শ্রেণীতে উঠেন’। তাই শৈলজানন্দের সাথে একই ক্লাসে পড়ার সুযোগ হয়। নজরুল এ স্কুলে বরাবরই “ফাষ্ট বয়” ছিলেন। এ স্কুলে তাকে কোন বেতন দিতে হতো না। মুসলিম হোস্টেলে তার থাকা খাওয়ার খরচ ও প্রতি মাসে সাত টাকা করে জমিদার বাড়ি থেকে আসত। (“কেউ ভোলে না কেউ ভোলে’’ -শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়)
শিয়ারশোল রাজস্কুলে নজরুল একটানা অষ্টম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা করেন। ১৯১৭ সালের শেষদিকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার আর মাত্র কয়েক মাস বাকি এমতাবস্থায় নজরুল পড়াশুনা বাদ দিয়ে ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্ট সৈনিকে যোগ দেন। উক্ত রেজিমেন্টে থাকাকালে একজন পাঞ্জাবী মৌলভির কাছ থেকে তিনি ফারসি ভাষা বেশ ভালো ভাবে রপ্ত করে নেন। সেখানে সংগীত মনা কয়েকজন সৈনিকের কাছ থেকে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজানো শিখেন এবং সংগীত চর্চা চালিয়ে যান। ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর কয়েকজন সৈনিক শুরু হতেই অর্থাৎ ১৯১৮ সালের এপ্রিল- মে মাস হতেই “বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার” নিয়োমিত গ্রহক হয়েছিলেন, নজরুল তাদের একজন।
১৯১৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে “বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায়” ছাপানোর জন্য কাজী নজরুল ‘ক্ষমা’ নামে একটি কবিতার পাÐুলিপি পাঠিয়েছিলেন। ছোট গল্প ‘হেনা’ ও ‘ব্যথার দান’ ‘ক্ষমা’ কবিতাটির নাম বদলে “মুক্তি” নাম দেয়া হয়েছিল। ১৩২৬ সালে শ্রাবণ সংখ্যক ( ১৯১৯ সালের জুলাই আগস্ট মাস) “বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায়” কাজী নজরুলের ‘মুক্তি’ শীর্ষক কবিতাটি ছাপা হয়। কবিতার নাম পরিবর্তনে নজরুলের কোন আপত্তি ছিল না। যতটা জানা যায় এটি ছিল নজরুলের পত্রিকায় প্রকাশের জন্য ১ম কবিতা। কবিতাটির অংশ বিশেষ-
নিম্নে উল্লেখ করা হ’ল-
রানিগঞ্জের অর্জুনপটির বাঁকে,-
যেখান দিয়ে নিতুই সাঁঝে ঝাঁকে ঝাঁকে
রাজার বাঁধে জল নিতে যায় শহুরে বউ কলস কাঁখে
সেই সে বাঁকের শেষে
তিন দিক হতে তিনটে রাস্তা এসে
ত্রিবেণির ত্রিধারার মতো গেছে একেই মিশে।
(হাবিলদার, বঙ্গবাহিনী, করাচি)
নজরুলের মুক্তি কবিতাটি ”বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য” পত্রিকায় ছাপানো হলে তিনি খুশি হয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে সম্পাদক বরাবর একখানা পত্র লিখেছিলেন। পত্রটির অংশ বিশেষ নিম্নরূপ-
“যদি কোন লেখা পছন্দ না হয়, তবে ছিঁড়ে না ফেলে এই গরীবকে জানালেই আমি ওর নিরাপদ প্রত্যাগমনের পাথেয় পাঠিয়ে দেব। কারণ, সৈনিকের বড্ড কষ্টের জীবন। আর তার চেয়েও হাজার গুণ পরিশ্রম ক’রে একটু-আধটু লিখি। আর কারুর কাছেও একেবারে ডড়ৎঃযষবংং হলেও আমার নিজের কাছে ওর দাম ভয়ানক। আর এটা বোধ হয় সব লেখকের স্বাভাবিক। আপনার পছন্দ হল কি না, জানবার জন্য আমার নাম ঠিকানা লেখা একখানা ঝঃধসঢ়বফ খামও দেওয়া গেল এর সঙ্গে। পড়ে মতামত জানাবেন”।
করাচি সেনানিবাসে বসে রচিত নজরুলের রচনাবলি কলকাতার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ‘বাউন্ডুলের আত্মকাহিনী’ (সওগাত, মে ১৯১৯) নামক প্রথম গদ্য রচনা, প্রথম প্রকাশিত কবিতা ‘মুক্তি’ (বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, জুলাই ১৯১৯) এবং ছোটগল্প ‘হেনা’, ‘ব্যথার দান’, ‘মেহের নেগার’, ‘ঘুমের ঘোরে’; ‘আশায়’, ‘কবিতা সমাধি’ প্রভৃতি।
১৯২০ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে ৪৯ নম্বর বেঙ্গলি রেজিমেন্ট পুরোপুরি ভেঙ্গে গেলে কাজী নজরুল সৈনিক জীবন শেষ করে স্থায়ীভাবে কলকাতায় ফিরে আসেন। কলকাতায় এসে প্রথমে রামকান্ত বোস স্ট্রিটে শৈলজানন্দ মুখোপ্যাধ্যায়ের বোডিং হাউসে উঠেছিল। তিন চারদিন সেখানে থাকার পর বোডিং হাউসের চাকর জানতে পারে যে সে মুসলমান তাই সে নজরুলের এঁটো বাসন ধুতে অস¦ীকার করে। তখন শৈলজানন্দ নজরুলকে ২০ বাদুড়বাগান রোডে (এখন-১ রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় স্ট্রিট) তাঁর মাতামহের একটি খালি বাড়িতে নিয়ে যেতে চান। কিন্ত নজরুল সেখানে না যেয়ে ৩২ নম্বর স্ট্রীটে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে আসার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। ফলে শৈলজানন্দ মুখোপ্যাধ্যায়ের তাঁকে সেখানে পৌছে দিয়ে যান। বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে এসে নজরুল একেবারে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। (কাজী নজরুল ইসলাম ‘স্মৃতিকথা’ - মুজফফর আহমদ)
নজরুল যে এক রকম রাতা-রাতি কবি হিসেবে প্রসিদ্ধ লাভ করেছিল, এটা বলা মোটেই সহজ হবে না। কারণ সৈনিক জীবন থেকে ফিরে আসার আগে তিনি কবি হিসেবে কেমন খ্যাতি লাভ করতে পারেন নি। তবে করাচি থেকে ফেরার পরপরই তাঁর কবিতার বান ডেকেছিল। কি সৌভাগ্য নতুন মাসিক পত্রিকা “মোসলেম ভারতের”। যে কাগজখানা বের হওয়ার মুখেই তা কাজী নজরুল ইসলামের মতো একজন উদীয়মান কবিকে প্রায় বাঁধা লেখক হিসেবে পেয়ে গেল। আর নজরুলের সৌভাগ্য বলতে হবে এ কারণে যে, তাঁর কবিতার স্রোত বইয়ে দেওয়ার জন্য নতুন হলেও একখানা প্রথম শ্রেণীর মাসিক পত্রিকা তাঁর হাতের মুঠোয় আপনা-আপনি এসে গেল। তবে একথা বলতে দ্বিধা নেই যে, “মোসলেম ভারত” প্রথম শ্রেণীর কাগজ হিসেবে আত্মপ্রকাশে নজরুলের
কবিতা দুটি প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথেই তাঁর খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তৎকালের বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিকগণ তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করেন। “মোসলেম ভারত” পত্রিকায় নজরুলের যে কয়েকটি লেখা ছাপানো হয়েছিল তার শিরোনাম নিচে দেওয়া হলো:- বাধন হারা (ক্রমশ প্রকাশ্য পত্রোপন্যাস), খেয়া পারের তরণী, কোরবানী (কবিতা), বাদল প্রাতের শরাব (কবিতা), বোধন (কবিতা), সাত-ইল-আরব (কবিতা), মোর্হরম (কবিতা), গান (তিনটি)- হাফিজের গজল, ফাতেহা ই-ইয়াজ দম, আবির্ভাব (কবিতা),বিরহ বিধুঁয়া (কবিতা), মরমী (গান), স্নেহভীতু (গান)।
‘বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির’ অফিসে কাজী মোতাহার হোসেন, মোজাম্মেল হক, কাজী আব্দুল ওয়াদুদ, মোহাম্মাদ শহিদুল্লাহ, আফজালুল হক প্রমুখ ব্যক্তির সাথে নজরুলের খুব অন্তরঙ্গতা বৃদ্ধি পায়। তৎকালিন কলকাতার জনপ্রিয় আড্ডা ‘গজেনদার আড্ডা’ এখানে তিনি অতুল প্রসাদ সেন, অবনিন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, শিশির ভাদুরী, শরৎচন্দ্র চট্টপাধ্যায়, নির্মালেন্দু লাহিড়ি, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, ওস্তাদ করমতুল্লা খাঁ, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, শিশিরকুমার ভাদুড়ী, হেমেন্দ্রকুমার রায়, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ বাংলার সমকালীন শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত ও নাট্যজগতের দিকপালদের সঙ্গে পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ হবার সুযোগ পান।
এ.কে ফজলুল হকের (শেরে-বাংলা) সম্পাদনায় অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ১৯২০ সালের ১২ জুলাই সান্ধ্য দৈনিক নবযুগ প্রকাশিত হলে তার মাধ্যমেই নজরুলের সাংবাদিক জীবনের সূত্রপাত ঘটে। নজরুলের লেখা ‘মুহাজিরীন হত্যার জন্য দায়ী কে?’ প্রবন্ধের জন্য ওই বছরেরই আগস্ট-সেপ্টেম্বরের দিকে পত্রিকার জামানত বাজেয়াাপ্ত হয় এবং নজরুলের ওপর পুলিশের দৃষ্টি পড়ে। নবযুগ পত্রিকার সাংবাদিকরূপে নজরুল যেমন একদিকে স্বদেশ ও আন্তর্জাতিক জগতের রাজনৈতিক-সামাজিক অবস্থা নিয়ে লিখছিলেন, তেমনি মুজফ্ফর আহমদের সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক সভা-সমিতিতে উপস্থিত থেকে সমকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কেও ওয়াকিবহাল হচ্ছিলেন। পাশাপাশি বিভিন্ন ঘরোয়া আসর ও অনুষ্ঠানে যোগদান এবং সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে তরুণ কবির সংস্কৃতিচর্চাও অগ্রসর হচ্ছিল। নজরুল তখনও নিজে গান লিখে সুর করতে শুরু করেননি, তবে তাঁর কয়েকটি কবিতায় সুর দিয়ে তার স্বরলিপিসহ পত্রপত্রিকায় প্রকাশ করেছিলেন ব্রহ্মসমাজের সঙ্গীতজ্ঞ মোহিনী সেনগুপ্তা।
‘হয়ত তোমার পাব দেখা’,
‘ওরে এ কোন্ স্নেহ-সুরধুনী’।
‘বাজাও প্রভু বাজাও ঘন’
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী বাংলা সাহিত্যের ঝড়তোলা কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৯২১ সালের অক্টোবর মাসে শান্তি নিকেতনে বিশ^কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে দেখা করতে যান। ডঃ মুহাম্মদ শহিদুল্ল্যাহ তাঁর সাথে ছিলেন-(রবীন্দ্র জীবনী’- প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়)। তখন থেকেই কাজী নজরুল রবীন্দ্রনাথের স্নেহভাজন হিসেবে পরিচিতি পায়। তখন থেকে ১৯৪১ পর্যন্ত দু দশক বাংলার দু প্রধান কবির মধ্যে যোগাযোগ ও ঘনিষ্ঠতা অক্ষুন্ন ছিল। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নজরুলের জন্য একটি কাব্যবানী ‘নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়াষ’ু বরাবরে পাঠিয়েদেন-
‘আয় চলে আয়রে ধুমকেতু
আঁধারে বাধ অগ্নিসেতু
দুর্দ্দিনের এই দুর্গলিরে
উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।’
কুমিল্লা কবি নজরুলের জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল। ঠিক এ সময়ে বাংলা সাহিত্যজগতকে তিনি অনেক মণি-মুক্তা দিয়ে পরিপূর্ণ করেছিলেন। কবিতা ও গান যেন যেন পরশ পাথরের মতো হয়ে ওঠে, এতটুকু নাড়াচাড়া করলে, একটু স্পর্শ করলেই বের হয়ে আসে নতুন নতুন কবিতা ও গান। কারণে-অকারণে নজরুল পাঁচ বারের মতো কুমিল্লায় আসেন। এখানেই তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন মা, খুঁজে পেয়েছিলেন হাজারও বন্ধু, খুঁজে পেয়েছিলেন হৃদয়ের গহীনে লুকিয়ে রাখার মতো দুর্লভ বস্তু, পেয়েছিলেন জীবন সঙ্গিনী নারী।
যেমনটি আবুল ফজল বলেন-“সেকালেই নজরুলের সঙ্গে কুমিল্লার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। আর তা যে আবেগে, উচ্ছ¡াসে, যৌবনের প্রথম উন্মাদনায় কতখানি ঐশ্বর্যশালী ছিল তার পরিচয় নজরুলের সে যুগের কাব্যে তা বিবৃত। নজরুল প্রেমের কবি, প্রেমিক কবি। রিখেছেনও অজ¯্র প্রেমের কবিতা ও গান। এসব রচনার উৎস মোটেও বায়বীয় নয়, রক্ত মাংসের মানবীই। আর এ মানবীরাই কুমিল্লার মেয়ে”।
কবি নজরুলের জীবনে কুমিল্লার কোমলমতি মানবীরাই এসেছিলেন শুভও কল্যাণের প্রতিকরূপে, প্রিয়ারূপে, বঁধুরূপে। নার্গিস ও প্রমিলা বাংলা সাহিত্য গগনে উজ্জল নক্ষত্রের মত উদ্ভাসিত আলেঅর প্রতিক। যে আলোর পথে হেঁটে নজরুল পেয়েছিলেন পরশ পাথরের সন্ধান। যার ছোঁয়ায় তিনি সোনা ফলাতে পেরেছিলেন বাংলা সাহিত্য ও সঙ্গীতের অনুর্বর জমিতে। কবিতা ও গানে যোগ করতে পেরেছিলেন নতুন মাত্রা। এ কথা অনস্বীকার্য যে, কুমিল্লা নজরুলের জীবনে যতটা আপন হয়েছিল, যতটা প্রভাব ফেলেছিল, তাঁর জীবনব্যাপি অন্য কোথাও এমনটি হয়নি।
কবি নজরুল কুমিল্লার সামাজিক, রাজনৈতিক, সাহিত্য ও সংস্কৃতি প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রবেশ করে সকলের গ্রহণযোগ্যতা অর্জনের মাধ্যমে ভালোবাসা পেয়েছেন। কবি হিসেবে পরিচিত হয়েছেন সবার কাছে। রাজনৈতিক এবং সাহিত্য ও সংস্কৃতি এ যুগপৎ ধারায় কুমিল্লা জীবনে নানা চাঞ্চল্য, রোমান্স, সংগ্রাম, বিক্ষোপ ও দ্রোহের সৃষ্টি করেছিলেন। তবে এ কথা সত্য যে, নজরুল কুমিল্লায় যে মহীয়সী দু’জন নারীর সান্নিধ্য পেয়েছিলেন তাদের অনুপ্রেরণাই বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হয়েছে। নজরুলের সমগ্র অস্তিত্ব জুড়ে এক রকম নোঙ বাঁধা ছিল কুমিল্লার মাটিতে। (কুমিল্লায় নজরুল স্মৃতি, প্রেম ও পরিণয়-তিতাশ চৌধুরী,)
নজরুল নিজেই নার্গিসকে বলেছেন- “তুমি এই আগুনের পরশমানিক না দিলে আমি ‘অগ্নিবীণা’ বাজাতে পারতাম না। আমি ধুমকেতুর বিস্ময় নিয়ে উদিত হতে পারতাম না”।
সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা সব মিলেই মানুষের জীবন। মানব জীবনে যেমন সুখর নদী আছে তেমনি বিষাদেরও সমুদ্র আছে। কবি নজরুল নিজেই বলেছেন- “রবীন্দ্রনাথ আমায় প্রায়ই বলতেন,”দ্যাখ উন্মাদ, তোর জীবনে শেলীর মত, কীটসের মত খুব বড় একটা ট্র্যাজেডী আছে, তুই প্রস্তুত হ’।” জীবনে সেই ট্র্যাজেডী দেখবার জন্য আমি কতদিন অকারনে অন্যের জীবনকে অশ্রæর বরষায় আচ্ছন্ন করে দিয়েছি। কিন্তু, আমারই জীবন রয়ে গেল বিশুষ্ক মরুভূমির মত দগ্ধ।” তবুও গহীন অন্ধকারে মাঝে মধ্যে সুখের প্রদীপ জ্বলে ওঠে। ভোরের আলো আর দক্ষিণা বাতাসে প্রাণ ভরে যায়।
কাজী নজরুল ইসলামের কবিতাতেই সঠিক এবং পরিপূর্ণভাবে বিধৃত হয়েছে বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের কথা। স্বদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতি, নৈসর্গিক সৌন্দর্য, স্বাধীনতা-স্বার্বভৌমত্ব ইত্যাদির জন্য যেমন একজন জাতীয় কবির মনে মমতা থাকে, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে দেশের মানুষের জন্যও তেমন ভালবাসা থাকে তার মনে। মাটি ও মানুষের সুখে যেমন হাসেন কবি, দুঃখেও তেমনি ব্যথিত হন তিনি।
১৯২৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর অপরাহ্ন দুটো, কলকাতা এলবার্ট হল। লোকে লোকারণ্য, তিলধারণের ঠাঁই নাই।
‘নজরুল সংবর্ধণা সমিতির’ সভাপতি সাহিত্যিক এস, ওয়াজেদ আলী। সম্পাদক ‘কল্লোল’ পত্রিকা সম্পাদক দীনেশ রঞ্জন দাশ ও ‘সওগাত’ পত্রিকার সম্পাদক এম. নাসিরুদ্দিন) আহবানে সভা।
সভায় সভাপতিত্ব করছেন আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়। সভায় হাজার লোকের মাঝে উপস্থিত ছিলেন জলধর সেন, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, অপূর্বকুমার চন্দ, করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র প্রমুখ প্রবীণ ও নবীন সাহিত্যিক ও সাহিত্য রসিক ব্যাক্তিগণ।
এই সভার সভাপতি হিসাবে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় কবি কাজী নজরুল ইসলাম কে “বাঙলার কবি, বাঙালীর কবি” ঘোষণা দেন। উপস্থিত হাজার জনতা উৎফুল্ল চিত্তে করতালির মাধ্যমে ঐ ঘোষণার পতি সমর্থন জানায়।
সেই সংবর্ধনা কমিটির অন্যতম সদস্য, সাংবাদিক ও সাহিত্যিক আবুল কালাম শামসুদ্দিন ১৯২৬ সালে মাসিক সওসগাত পত্রিকায় লিখেছিলনে- “নজরুল ইসলাম ‘বাংলার জাতীয় কবি’। জাতীর বেদনা ব্যথাই তাহার কাব্যের ভিতর দিয়া প্রকাশ পাইতেছে। হিন্দু ও মুসলমান লইয়া বাঙালী জাতি। সুতরাং এ জাতীর বেদনার কথা প্রকাশ করিতে হইলে রচনায় ইসলামী ও হিন্দুয়ানী উভয় জাতীর প্রকাশ ভঙ্গিরই ছাপ থাকিতে হইবে।’’
নজরুল সংবর্ধনা আয়োজক কমিটির মূখ্য নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু সেই সংবর্ধনায় দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেছিলেন- “আমরা যখন যুদ্ধে যাব তখন সেখানে নজরুলের গান গাওয়া হবে। আমরা যখন কারাগারে যাব তখনও তার গান গাইব”।
সভার পক্ষ থেকে কবি কাজী নজরুল ইসলামকে একটি অভিনন্দন পত্র ও সোনার দোয়াত-কলম একটি রূপার কাস্কেটে ভরে উপহার হিসেবে দেয়া হয়। অভিনন্দন পত্রের শেষে লেখা হয় ‘গুণমুগ্ধ বাঙালীর পক্ষে’ নজরুল-সংবর্ধণা সমিতির সভ্যবৃন্দ। হাজার বছরের বাঙালি জাতি ও বাঙলা ভাষার ইতিহাসে এই প্রথম কোনো কবিকে “বাঙালি জাতির কবি, বাঙলা ভাষার কবি” হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। (সূত্র-নজরুল চরিতমানস, পৃষ্ঠা-৮৮-৮৯)
১৯২৯ সালের সেই সংবর্ধনার জবাবে কাজী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন- “কেউ বলেন, আমার বাণী যবন, কেউ বলেন কাফের, আমি বলি ও দু’টোর কোনটিই নয়, আমি মাত্র হিন্দু মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ডশেক করাবার চেষ্টা করেছি। গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি। সে হাতে হাত মিলানো যদি হাতাহাতির চেয়েও অশোভন হয়ে থাকে, তাহলে ওরা আপনিই আলাদা হয়ে যাবে। আমার গাঁট-ছড়ার বাঁধন কাটতে তাদের কোন বেগ পেতে হবে না।”
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পরই তৎকালিন সরকার কবি কাজী নজরুলকে সপরিবারে সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। জাতীয় কবির মর্যাদা দিয়ে তাঁকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বাংলাদেশে তাঁর বসবাসের ব্যবস্থা করেন এবং ধানমন্ডিতে কবির জন্য একটি বাড়ি প্রদান করেন।
২৯ আগস্ট, ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দ কবি নজরুল ইন্তিকাল করলে জাতীয় কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়। এখানেই তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত রয়েছেন।
তথ্যসূত্র-
ইনটারনেট মেডিয়া থেকে সংগৃহিত তথ্য
কাজী নজরুল ইসলাম ‘স্মৃতিকথা’- মুজফফর আহমদ)
“কেউ ভোলে না কেউ ভোলে’’ -শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
নজরুল প্রতিভা - মোবাশ্বের আলী
নজরুল প্রসঙ্গে- রফিকুল ইসলাম