কাজী নজরুল ইসলাম এঁর “বিদ্রোহী” কবিতা সম্পর্কে পর্যালোচনা।
------------মাজহারুল মোর্শেদ
নজরুল ছিলেন সাম্যবাদী কবি, প্রেমের কবি, দ্রোহের কবি। জাতি, বর্ণ, ধর্ম, গোষ্ঠীর এসব কিছুর উর্ধে তিনি তাঁর সাহিত্য কে স্থান দিয়েছিলেন মানব প্রেম আর জাতীয়তাবাদী চিন্তা-চেতনায়। মাত্র একুশ বছর বয়সে বিদ্রোহী হয়ে ধমকেতুর মতো বাংলার কাব্য আকাশে উদয় হলেন। একদিকে গোটা ভারত বর্ষে শুরু হয়েছিল গান্ধীজীর নেতৃত্বে বৃটিশ বিরোধী অসহযোগ আন্দোলন, বেঙ্গল প্যাক্ট, রুশ বিপ্লব, প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইউরোপীয় বিপর্যয় সব মিলিয়ে গোটা পৃথিবীতে চলছিল এক নিদারুণ মানবিক অস্থিরতার লড়াই। ঠিক সেই মুহুর্তে মাত্র এক রাত্রেই তিনি লিখে ফেলেন কালজয়ী কবিতা “বিদ্রোহী”। সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। কবি তাঁর হৃদয়ের বাঁধভাঙা আবেগ-উচ্ছ¡াসে অন্ধকারঘণ পরিবেশে প্রদীপের টিমটিমে আবেশ ছড়ানো আলোয় সারারাত জেগে পেন্সিল দিয়ে লিখে ফেলেন-
বল বীর-
বল -উন্নত মম শির!
শির নেহারি’ আমারি নত শির ওই শিখর হিমাদ্রির!
বল বীর-
বল -মহা বিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি’
চন্দ্র সূর্য গ্রহতারা ছাড়ি’
ভ’লোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া,
খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া
উঠিয়াছি চির -বিস্ময় আমি বিশ্ব বিধাত্রীর!
কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদ বলেন- “কাজী নজরুল ইসলাম ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি এক রাত্রিতে লিখেছিলেন। সকালে ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুয়ে এসে আমি বসেছি এমন সময়ে নজরুল এসে বলল, সে একটি কবিতা লিখেছে। পুরো কবিতাটি সে তখন আমায় পড়ে শোনাল। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার আমিই প্রথম শ্রোতা। দোয়াতে বারে বারে কলম ডোবাতে গিয়ে তার মাথার সঙ্গে তার হাত তাল রাখতে পারবে না, এই ভেবেই সম্ভবত সে কবিতাটি প্রথমে পেন্সিলে লিখেছিল। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে বিজলী পত্রিকায়। এরপর প্রকাশিত হয় “মোসলেম ভারত” পত্রিকায় (কার্তিক ১৩২৮)।
‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি  প্রকাশিত হওয়া মাত্রই এটি ব্যাপক জাগরণ সৃষ্টি করে। দৃপ্ত বিদ্রোহী মানসিকতা এবং অসাধারণ শব্দবিন্যাস ও ছন্দের জন্য আজও বাঙালি মানসে কবিতাটি “চির উন্নত শির” বিরাজমান। কবি লিখেছেন-
আমি দূর্বার,
আমি ভেঙে করি সব চুরমার!
আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল,
আমি দ’লে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল!
আমি মানি না কো কোন আইন,
‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি নানান দৃষ্টিভঙ্গিতে আলোচিত, সমালোচিত, প্রশংসিত, নিন্দিত হয়েছে। কিন্তু সব সমালোচনা নির্মোহ সাহিত্যিক দৃষ্টিভঙ্গিতে হয়নি, ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকেও হয়েছে।
সাহিত্য সমালোচকের দৃষ্টিতে আলোচনা করতে গিয়ে কবি আবদুল কাদির লিখেছেন- ‘মাত্র দু’বছর আগে যিনি লেখকমহলে দেখা দিয়েছেন, সেই বাইশ বছর বয়স্ক তরুণ কবির হাতে ‘বিদ্রোহী’র মতো প্রাণবন্ত কবিতা বের হওয়া এক বিস্ময়কর ব্যাপার।
প্রখ্যাত কবি ও সাহিত্য সমালোচক সৈয়দ আলী আহসান নজরুলের মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেছেন-“নজরুল ইসলামের পক্ষে রবীন্দ্রনাথ প্রবর্তিত শৃঙ্খলিত কাব্যধারাকে নিশ্চিন্তে ভেঙে ফেলা সম্ভব হয়েছিল। এর প্রথম প্রমাণ আমরা পেলাম ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যগ্রন্থে।
বিদ্রোহী এ পর্যন্ত অনুদিত হয়েছে তেত্রিশটি ভাষায়। স্বাধীনতা, বিদ্রোহ ও আত্মোপলব্ধির পারস্পরিক সম্পর্ক অত্যন্ত দৃঢ়। পূর্ণ স্বাধীনতা পেতে হলে সবার আগে আমাদের বিদ্রোহ করতে হবে। সব নিয়মকানুন ও শৃঙ্খলের বিরুদ্ধে।
আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা’,
করি শত্রæর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা,
আমি উন্মাদ, ঝঞ্ঝা!
পরাধীনতার আফিমে বুঁদ হয়ে থাকা বৃটিশরাজ্যের অনুগ্রহ প্রত্যাশী বাঙ্গালি জাতিকে নজরুল এ কবিতার মাধ্যমে ভীষণভাবে নাড়াদিয়ে, টেনে হিচড়ে বের করে দাঁড় করিয়েছেন সংগ্রামী কাতারে। বিশেষকরে মুক্তিকামী বাঙালি তরুণ সমাজের কাছে এ কবিতার বাণীছিল রক্তের উন্মাদনা সৃষ্টিকারী এক বজ্রকঠিন বার্তা। বিদ্রোহী কবিতা কাজী নজরুলের একটি স্মরণীয় ঐতিহাসিক শিল্পকর্ম। সকল প্রতিবন্ধকতার উর্ধে থেকে তিনি লিখেছেন-
আমি হোম-শিখা, আমি সাগ্নিক জমদগ্নি,
আমি যজ্ঞ, আমি পুরোহিত, আমি অগ্নি।
আমি সৃষ্টি, আমি ধ্বংস, আমি লোকালয়, আমি শ্মশান,
আমি অবসান, নিশাবসান।
আমি ইন্দ্রাণী-সুত হাতে চাঁদ ভালে সূর্য,
এম একহাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণ-তুর্য;
বিদ্রোহী কবিতার ছত্রে ছত্রে পৌরানিক রূপকের ব্যবহার এতোটাই যথার্থ যে মুগ্ধ না হয় উপায় নেই। রূপকের প্রয়োগ দেখে যে কেউ আঁচ করতে পারবেন, গ্রীক আর ইন্ডিয়ান মিথের ওপর কবির কতোটা দখল ছিল। এই কবিতায় যেসব ঐতিহ্য ও পুরাণের ব্যবহার করা হয়েছে তা ধাপে ধাপে ব্যাখ্যা করা হলো-
ভূলোাক মানে পৃথিবী, দ্যুলোাক মানে স্বর্গ, আর গোলক মানে বিষ্ণুলোক অথবা স্বর্গে বিষ্ণু বা কৃষ্ণের বাসস্থান। কৃষ্ণ রাধার বৃন্দাবন এখানেই অবস্থিত।
ঋগেবেদে রুদ্র বজ্রের দেবতা, গ্রীক মিথের ‘থর’ এর মতো ক্ষেপে গেলে বজ্র ছুড়ে মারেন, ইনি ব্রহ্মার পুত্রাতার ক্রোধে নেমে আসে ধ্বংস আর মহামারী। মহাদেব মহাপ্রলয়ের সময় তান্ডব নৃত্য নেচেছিলেন।
গজাসুর ও কালাসুরকে বধ করেও তিনি তান্ডব নৃত্য নেচেছিলেন। এই তান্ডব নৃত্যকলার উদ্ভাবক হিসেবে তাকে নটরাজ ডাকা হয়। পৃথু ছিলেন অত্রি বংশের অত্যাচারী রাজা বেন এর পুত্র। রাজা বেন এর মৃত্যুর পর তার ডান বাহু থেকে পৃথুর জন্ম। প্রজা কল্যানার্থে পৃথু পৃথিবীকে বশ করেন। তার রাজত্বকে বলা হয় পৃথু।
চেঙ্গিস খান ছিলেন মঙ্গোলিয়ান সম্রাট এবং দুর্র্ধষ সমরনায়ক। যুবক চেঙ্গিসের স্ত্রীকে অপহরন করে নিয়ে যায় আরেক গোত্র প্রধান। চেঙ্গিস খান তার নিজ গোত্রকে পুনর্গঠিত করে অপহরনকারী গোত্রকে নৃশংস ভাবে পরাস্ত করে স্ত্রীকে উদ্ধার করেন। এরপর অন্যান্য মঙ্গোল গোত্রদের একীভূত করে অর্ধেক বিশ্ব জয় করেন।
ইসলাম ধর্ম মতে কেয়ামত বা মহাপ্রলয় শুরুর আগে হযরত ইসরাফিল (আ.) নামক ফেরেস্তা শৃঙ্গায় ফু দেবেন, এবং সেই শৃঙ্গার বিকট ধ্বনিতে পৃথিবীর সবকিছুই ধ্বংস হয়ে যাবে। কবি নজরুল লিখেছেন-
আমি সন্ন্যাসী, সুর-সৈনিক,
আমি যুবরাজ, মম রাজবেশ ¤øান গৈরিক।
আমি বেদুইন, আমি চেঙ্গিস,
আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কূর্ণিশ।
আমি বজ্র, আমি ঈষাণ-বিষানে ওঙ্কার,
আমি ইস্রাফিলের শৃঙ্গার মহা-হুঙ্কার।
‘বিদ্রোহীর জয় তিলক আমার ললাটে অক্ষয় হয়ে গেল আমার তরুণ বন্ধুদের ভালোবাসায়। আমি বিদ্রোহ করেছি, বিদ্রোহের গান গেয়েছি অত্যাচারের বিরুদ্ধে, যা মিথ্যে, কলুষিত, পুরাতন, পচা- সেই মিথ্যে সনাতনের বিরুদ্ধে।
আমি ক্ষ্যাপা দুর্বাসা, বিশ্বামিত্র-শিষ্য,
আমি দাবানল-দাহ, দাহন করিব বিশ্ব।
আমি প্রাণ খোলা হাসি উল্লাস, আমি সৃষ্টি-বৈরী মহাত্রাস,
আমি মহা প্রলয়ের দ্বাদশ রবির রাহু গ্রাস!
নজরুলের সর্বাপেক্ষা অমূল্য সৃষ্টি ‘বিদ্রোহী’ কবিতায়ও এসেছে নারীর উদাহরণ-নারীর উপমা। নারীর বৈশিষ্ট্যে সিক্ত হয়েছেন কবি। তাঁর বিদ্রোহ :
‘আমি বন্ধনহারা কুমারীর বেণী, তন্বী-নয়নে বহ্নি,
আমি ষোড়শীর হৃদি-সরসিজ প্রেম উদ্দাম, আমি ধন্যি!
আমি উন্মন মন উদাসীর,
আমি বিধবার বুকে ক্রন্দন-শ্বাস, হা-হুতাশ আমি হুতাশির।
প্রমথ চৌধুরী- নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা  প্রকাশের পর নজরুলকে “বিদ্রোহী কবি” উপাধি দেন। কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন একজন প্রকৃত বিদ্রোহী কবি।
বিদ্রোহী কবিতায় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দ্বারা পদদলিত এদেশ দীর্ঘকাল শাসন, শোষণ, অন্যায়, অবিচার আর বৈষম্যের পঙ্কিলতায় আচ্ছন্ন থেকেছে। সমাজ সচেতন কবি এ সমাজ ও রাষ্ট্রের অবিচার এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে বিপ্লবী মনের প্রতিবাদ জানিয়েছেন----
আমি উন্মাদ, আমি উন্মাদ!!
আমি চিনেছি আমারে, আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!
আমি পরশুরামের কঠোর কুঠার
নিঃক্ষত্রিয় করিব বিশ্ব, আনিব শান্তি  শান্ত  উদার!
আমি হল বলরাম-স্কন্ধে
আমি উপাড়ি’ ফেলিব অধীন বিশ্ব অবহেলে নব সৃষ্টির মহানন্দে।
যতোদিন জনবিরোধী শাসন-শোষণ, নিযাতন-নিপিড়ন বিদ্যমান থাকবে ততোদিন এসবের বিরুদ্ধে মানুষের সোচ্ছার হওয়ার স্বার্থে বিদ্রোহী কবিতার প্রয়োজনীয়তাও থাকবে। বাঙ্গালির সংগ্রাম ও বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে দ্রোহের কবি নজরুল ও তাঁর বিদ্রোহী কবিতা চিরউন্নত শির নিয়ে বেঁচে থাকবে------
মহা-বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত
আমি সেইদিন হব শান্ত
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না
অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণ ভ‚মে রণিবে না।