কাজী নজরুল ইসলাম ও তাঁর শিক্ষা জীবনের নানা কথা
---মাজহারুল মোর্শেদ
বিংশ শতাব্দীর কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাব যেন ধুমকেতুর মতো, সাইক্লোন ছাড়িয়ে দ্যুলোক-ভূ’লোক কাঁপিয়ে তোলে। বহুদিনের পুরানো জরা-জীর্ণ পঙ্কিলতা সরিয়ে অন্ধকার ঠেলে ক্রমশঃ আলোর বিচ্ছুরণ, আশা- আকাঙ্খ্যা, উন্নত চিন্তা-চেতনা, ভাব-ভঙ্গীতে উদ্দীপ্ত এক নির্ভীক তারুণ্যের উজ্জলতা ফিরে আসে। তাঁর কবিতায়, গানে অনবরত ধ্বনিত হয় স্বাধীনতার কথা, মানবতার কথা, সাম্যেও বাণী, বাঁধন ছেঁড়ার গান।
কাজী নজরুল ইসলামের ছোট বেলার আদরের ডাক নাম ছিলো দুখু মিয়া। এই দুখু মিয়ার জন্ম কোন আলোকোজ্জল প্রাচুর্যপূর্ণ নগরীতে হয়নি কিংবা বর্ধমানের মতো কোন মফস্বল শহরেও নয়। তারঁ জন্ম হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার একটি অজগ্রাম চুরুলিয়ায় ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৪ শে’ মে (১১ জৈষ্ঠ ১৩০৬) ।
তাঁর বাবা ফকির আহমদ ছিলেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম এবং মাযারের খাদেম। কাজি পরিবারের সদস্যগণ তৎকালীন মুলিম সমাজের অত্যন্ত মান ভাজন ব্যক্তি ছিলেন। কারণ তাঁদের পূর্ব পুরুষগণ বাদশাহী আমলে বিচারকের কাজ করতেন বলে এটা ছিল তাঁদের কাছে গৌররেব বিষয়। চুরুলিয়া গ্রামের কাজীরা ও বাদশাহী আমলের প্রাপ্ত সম্পত্তির মালিকও ছিলেন।
কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম হয়েছিল দরিদ্র পরিবারে, এমন ধারণা আমাদের সমাজে মোটামুটিভাবে প্রতিষ্ঠিত। তবে তাঁর পূর্বপুরুষ মোটেই দরিদ্র ছিলেন না। মোগল আমলে তাঁরা নবাবদের চাকুরে ছিলেন এবং স্থানীয়ভাবে বিচারকাজের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। চুরুলিয়ায় তাঁদের প্রচুর না হলেও যথেষ্ট জমিজমা ছিল।
আরবি-ফারসিসহ চারটি ভাষা জানা সুপুরুষ কাজী ফকির আহমেদের দ্বিতীয় স্ত্রী জাহেদা খাতুনও ছিলেন উচ্চবংশজাত নারী। নজরুল ছিলেন তাঁর বাবার দ্বিতীয় পক্ষের সন্তান। নজরুল মাতা জাহেদা খাতুনের চার সন্তান। কাজী সাহেব জান, কাজী নজরুল ইসলাম, কাজী আলী হোসেন ও বোন উম্মে কুলসুম। কাজী সাহেব জান রানীগঞ্জের কয়লাখনিতে চাকরি করতেন।
বার্ধক্য বয়সে কাজী ফকির আহমদ বড় অর্থ কষ্টে জীবন যাপন করেন, অনেকটা নিঃস্ব অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। এর প্রধান কারণ ছিলো তাঁর গুরুত্বহীন বেহিসেবী জীবন-যাপন প্রণালী। পরিস্থিতিতে অনেক দুঃখ-কষ্টে কেটেছে কবির বাল্যজীবন। যে বয়সে একটি ছেলে-অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে পড়াশুনা করার কথা সেই বয়সে দারিদ্রতার কষাঘাতে তাঁকে রুটির দোকানে কাজ করতে হয়েছিল। দুটো পয়সা রোজগারের জন্য লেটোর দলে গান করতে হয়েছিল, রেলওয়ের গার্ডের খানসামা পদে চাকরি নিতে হয়েছিল। দরিদ্রতা তাঁর জীবনে এমন ভাবে চেঁপে বসেছিল যে, কোনটি বড়কাজ আর কোনটি ছোটকাজ এ নিয়ে চিন্তা করার অবকাশ ছিল না। হুগলী জেলার আসানসোলে এম, বখশের রুটির দোকানে মাসিক এক টাকা বেতনে চাকুরি নিতে বাধ্য হয়েছিলেন কাজী নজরুল। রুটি বানানোর কাজ করার সময় তিনি লিখেছিলেন-
‘‘মাখতে মাখতে গমের আটা
ভিজে গেল আমার গাটা” (সংগৃহিত)।
দরিদ্র মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করা নজরুল অর্থের অভাবে পড়াশোনা করতে পারেননি। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা ছিল ধর্মভিত্তিক। ধর্মীয় মাদ্রাসায় তাঁর শিক্ষাজীবনের হাতেখড়ি হয়। এখানে আরবী ভাষা শিক্ষার পাশাপাশি তিনি ফার্সি ভাষাও অনেকটা রপ্ত করে ফেলেন।
নজরুলের প্রথম জীবনীকার আব্দুল কাদির- ‘সওগত’ জৈষ্ঠ ১৩৫৪ সংখ্যায় “নজরুলের জীবন ও সাহিত্য” প্রবন্ধে লিখেছেন- কবি নজরুল বাল্যকালে পিতৃহীন হন। ১৩১৪ সালের সাতই চৈত্র তাঁর পিতা দেহ ত্যাগ করেন। ফলে দরিদ্রের সংসাওে বিষম বিপর্যয় দেখা দেয় ও কবির পড়াশুনার অতিশয় ব্যাঘাত ঘটে। ১৩১৬ সালে দশ বছর বয়সে নজরুল গ্রামের মক্তব থেকে নিম্ন প্রথমিক পরীক্ষায় পাস করেন। অতঃপর এক বৎসর কাল সেই মক্তবেই শিক্ষকতা করেন। সে সময় আশেপাশের পল্লীতে মোল্লাগিরি করে দু’পয়সা রোজগারে চেষ্টা করেও দেখেছিলেন এবং মাঝে মাঝে মাজার শরীফের খাদেমগিরি ও মসজিদের ইমামতীও করতেন”
দশ-এগারো বৎসরের নাবালক নজরুল মসজিদে নামাজের জামাতে ইমামতী করতেন কিভাবে সে প্রশ্ন তুলেছেন ড.আহমদ শরীফ তাঁর একটি লেখায়।
নজরুল বাড়ির মসজিদে ইমামতী না মুয়াজ্জিনগিরী করেছিলেন সে প্রশ্নের উত্তর পশ্চিমবঙ্গ ‘মুসলিম অনুসন্ধান সমিতি’র সাধারণ সম্পাদক এম, আব্দুর রহমান এঁর “কিশোর নজরুল” (প্রভিন্সিয়াল লাইব্রেরি, কলিকাতা, জৈষ্ঠ ১৩৭০) গ্রন্থে পাওয়া যায়। তিনি লিখেন- “মসজিদে গিয়ে পিতার সঙ্গে নামাজ আদায় করতেন, ‘সিজদাহ’ করতেন পরম প্রভুর উদ্দেশ্যে ‘পাকা নামাজির মত’।
এভাবেই কাজী নজরুল ছোটবেলা হতেই নামাজ রোজার প্রতি ভক্তিপরায়ন হয়ে উঠেছিলেন। মাজারের খাদেম এবং মসজিদেও ইমাম নিযুক্ত হবার পর তারঁ এ ধর্মভার আরও বেড়ে গিয়েছিল। কাজী নজরুল যখন মসজিদে ইমামতীর ভার পেলেন তখন তাঁর বয়স কম-বেশি এগারো বছরের মত। মুসলিম জাহানের ইতিহাসে এ বয়সে কোন কিশোর মসজিদেও ইমামতী করেছেন, এরূপ ঘটনা কদাচিৎ দেখা যায়। ইমামতি করতে হলে যে যোগ্যতার প্রযোজন হয় নজরুলের তা পুরোপুরি ছিল না। তথাপি দুঃসাহসী হয়ে এগিয়ে এলেন তিনি। তাঁর দুর-সম্পর্কীয় চাচা মুন্সি ফজলে করিম উৎসাহ দিলেন তাঁকে। ইমামতি করার প্রয়োজনীয় বিধি-বিধান তালিম দিলেন ভ্রাতুষ্পুত্রকে। নজরুলের আবার নতুন করে আরবী-ফারসী- উর্দু পড়া শুরু হল।”
লেটো গানের দলে নজরুল-
‘নিমশা’ গ্রামে লেটো গানের দলের পরিচালক, স্বনামধন্য অপরাজেয় গোদা কবি ও ওস্তাদ কাজী বজলে করীম ছিলেন কাজী নজরুল ইসলামের চাচা। কাজী নজরুলের বয়স যখন বারো-তেরো বছর জানা যায়, তার হাত ধরেই লেটোগানের জগতে আসেন তিনি। বজলে করীমের সহযোগিতা ও প্রশিক্ষণে দুখু মিয়া নাচ-গান-অভিনয়ে এবং বাদ্যযন্ত্রের দক্ষ হয়ে ওঠেন।
দু’টো পয়সা রোজগারের তাড়ণা থেকেই কাজী রজরুল, কৈশোরে ভ্রাম্যমাণ নাটক (লেটো গান) দলের সঙ্গে কাজ করেন। সেই সুবাদে সাহিত্য, কবিতা ও নাটকের সঙ্গে তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন। রাঢ় বাংলার (পশ্চিম বাংলার বর্ধমান-বীরভূম অঞ্চল) কবিতা, গান আর নৃত্যের মিশ্র আঙ্গিক লোকনাট্যের দলে বালক নজরুল ছিলেন একাধারে পালাগান রচয়িতা ও অভিনেতা। তাৎক্ষণিকভাবে কবিতা ও গান রচনার কৌশল নজরুল লেটো বা কবিগানের দলেই রপ্ত করেন। এ সময় লেটোদলের জন্য কিশোর কবি নজরুলের সৃষ্টি। নজরুলের লেখা পালার গানগুলি হল-
চাষার সঙ, শকুনিবধ, রাজা যুধিষ্ঠিরের সঙ, দাতা কর্ণ, আকবর বাদশাহ, কবি কালিদাস, বিদ্যাভূতুম, রাজপুত্রের সঙ, বুড়ো সালিকের ঘাড়ে রোঁ, মেঘনাদ বধ প্রভৃতি।
মোট কথা নজরুলের কবি ও শিল্পী জীবনের সূচনা হয় এই লেটোদল থেকেই। মক্তবে ছাত্র-শিক্ষক, মাজারের খাদেম এবং মসজিদের ইমাম বা মুয়াজ্জিনের পর কাজী নজরুলকে লেটো গানের দলে যোগ দিতে দেখা যায়।
এ প্রসঙ্গে নজরুলের আত্মীয় কাজ আনোয়ারুল ইসলাম “নজরুলের বাল্যজীবন” শীর্ষক প্রবন্ধে (কবিতা কার্তিক -পৌষ ১৩৫১) লিখেছেন-“বাড়ির অবস্থা ভালোছিলনা তাই নজরুল ‘লেটো’র দলে গান এবং নাটক রচনা করে দিয়ে অর্থ উপার্জন করতেন। তাঁর বয়স বারো-তেরো বছর মাত্র এ সময়ে রচনা তাঁর এত ভাল হতে লাগল যে ক্রমে তিনি ‘নিমসা’ ও ‘চুরুলিয়া’ এবং ‘বাখাখূড়া’ এ তিনটি ‘লেটোনাচে’র দলে নাটক রচনা করে গেলেন।”
বাসুদেবের কবিগানের দলে কিশোর নজরুলের চিত্র পাওয়া যায় শৈলজানন্দ মুখোপ্যাধ্যায়ের “আমার বন্ধু নজরুল” (হরফ প্রকাশনী, কলকাতা ১৩৭৫) গ্রন্থে-
কিশোর নজরুলের বুদ্ধিমত্তা ও চিন্তা চেতনায় মুগ্ধ হয়ে রফিজুল্লাহ দারোগা তাঁকে নিয়ে যেয়ে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের দরিরামপুর স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি করিয়ে দেন। নজরুলের স্কুল জীবন থেকে জানা যায়, প্রথমে তিনি কাজীর সিমলার নিবাসী কাজী রফিজুল্লাহ সাহেবের বাড়ি থেকে স্কুলে যাতায়াত করতেন। এরপর ত্রিশাল নামা পাড়ার বিচতিয়া ব্যাপারীর বাড়িতে লজিং থেকে পড়াশোনা চালিয়ে যান। কিন্তু সেখানে তার মন বেশিদিন টিকলো না, ফিরে এলেন বর্ধমান জেলার, মঙ্গলকোট থানার “মাথরুম হাইস্কুলে (প্রকৃত নাম নবীনচন্দ্র ইনস্টিটিউশান) এবং ভর্তি হয়ে পড়া শোনায় মন দিলেন। স্কুলটি কাশিম বাজারের মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর অর্থ সাহয্যে পরিচালিত হত। জায়গাটি মহারাজার পৈত্রিক গ্রাম। সহায় সম্বলহীন নজরুল একটু সুযোগ সুবিধা পাওয়ার আশায় এ স্কুলে ভর্তি হয়েছিল। কিন্তু সেটিও হয়নি।
মুজফফর আহমদ এর ভাষায়- “নজরুলের কোন বন্ধু কিংবা নিকটতম আত্মীয় কেউ রাজ স্কুলে পড়ত। তাকে উপলক্ষ করেই নজরুল রানীগঞ্জ থানার শিয়ারশোল রাজস্কুলে পড়ার সুযোগ খুঁজতে আসে। শেষপর্যন্ত যে সুযোগ-সুবিধাগিুলি সে খুঁজেছিল তার যে কোন একটি না পেলেও হয়তো তার পড়া হত না। কিন্তু প্রথমে সে এসব সুযোগ-সুবিধা না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়ে। এই হতাশপীড়িত অবস্থায় নজরুলের বন্ধুটি স্কুল চলে গেলে তার নামে একখানা দীর্ঘ পত্র লিখে সে চলে যায়। স্কুল হতে ফিরে এসে নজরুলের সেই বন্ধুটি পত্র খানা পায় এবং তা হেড মাস্টারের নিকট পাঠিয়ে দেয়। এ পত্রের ভাষা ও মান নজরুল যে ক্লাসে ভর্তি হতে এসেছিল সেই ছাত্রদের চাইতে অনেক উপরে। সেই থেকে নজরুল সকল সুযোগ-সুবিধাসহ শিয়ারশোল রাজস্কুলে পড়ার সুযোগ পেয়ে গেল। এই স্কুলে নজরুল সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হয়”। (কাজী নজরুল ইসলাম “স্মৃতি কথা” কমরেড মুজাফফর আহম্মদ)।
“বার্ষিক পরীক্ষার পর ডাবল প্রমোশন নিয়ে একেবারে নবম শ্রেণীতে উঠে। তাই শৈলজানন্দের সাথে একই ক্লাসে পড়ার সুযোগ হয়। নজরুল এ স্কুলে বরাবরই “ফাষ্ট বয়” ছিল। এ স্কুলে তাকে কোন বেতন দিতে হতো না। মুসলিম হোস্টেলে তার থাকা খাওয়ার খরচ ও প্রতি মাসে সাত টাকা করে জমিদার বাড়ি থেকে আসত”।
(‘কেউ ভোলে না কেউ ভোলে’-শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়)
রানীগঞ্জে নজরুলের শৈলন্দ্রকুমার ঘোস নামে আরও একজন বন্ধু জুটেছিলেন। নজরুল মুসলমান, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় হিন্দু ব্রাক্ষণ এবং শৈরেন্দ্রকুমার খ্রিস্টান।তিন বন্ধু এক সঙ্গে বেড়াতেন। নজরুল ইসলাম যে রেলওয়ে গার্ডের বাড়িতে চাকরি করেছিল
তার স্ত্রী শ্রীমতি হিরণপ্রভা ঘোষ ছিলেন শৈলেন্দ্রকুমার ঘোষের দিদি। গার্ড সাহেবের সঙ্গে বিচ্ছেদ হওয়ার পর অবশ্য হিরণপ্রভা মেডিকেল স্কুল পাস করে ডাক্তার হয়েছিলেন। কলকাতায় নজরুল মাঝে মাঝে তার বাড়িতে যেত।
শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় বলেছেন-“তার বাড়ির টেবিল হারমোনিয়ামটি নজরুলের আকষণের বস্তু ছিল”।
শিয়ারশোল রাজস্কুলের শিক্ষক শ্রীনিবারণচন্দ্র ঘটক সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী পশ্চিম বঙ্গীয় দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। নজরুল তাঁর শিক্ষক শ্রীনিবারণচন্দ্র ঘটকের দ্বারা তার মতবাদেও দিকে আকর্ষীত হয়েছিলেন।
শিয়ারশোল রাজ স্কুলের ফার্সীও শিক্ষক মৌলবি আব্দুল গফুরের বিদায় সভায় নজরুল রচিত অভিনন্দন বাণী পাঠ করা হয়। এ অভিনন্দন বাণীর শিরোনাম ছিল ‘মর্মোচ্ছ¡াস’। কবিতাটির রচনা কৌশল বিশেষভাবে স্বর্তব্য ও সমাদৃত। কবিতায় নজরুল অত্যন্ত সুকৌশলে নিজের নাম ব্যবহার করেছিলেন। অভিনন্দন বাণীর প্রত্যেক স্তবকের প্রথম পংক্তির প্রথম বর্ণ সাজিয়ে পড়লে কাজী নজরুল এসলাম নামটি পাওয়া যেত। এ ধরণের কবিতাকে ইংরেজিতে ‘এ্যাক্রোস্টিক’ বলে। এ রীতির কয়েকটি কবিতা মাইকেল মধুসুদন দত্ত রচনা করেন।
রানীগঞ্জ হোস্টেল থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ চিঠি উদ্ধার হয় । ১৯১৭ সালের ২৩ শে জুলাই তারিখে কাজী নজরুল তাঁর শিক্ষক মৌলবি আব্দুল গফুরকে লিখেছিলেন। চিঠির ফটোকপি পূর্বাহ্নে কলকাতার ‘কাফেলা’ পত্রিকায় প্রথম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা মে-জুন ১৯৮১ তে প্রকাশিত হয়েছিল। চিঠিটির মাথায় লেখা ছিল, আজ পর্যন্ত নজরুলের যত চিঠি পাওয়া গেছে এটি তার প্রাচীনতম। সম্পূর্ণ পাঠ এই-
রানীগঞ্জ,
মোসলেম হোস্টেল
২৩-০৭-১৯১৭
পাক জোনাবেষু-
আমার কর্ণেশাৎ হাজার হাজার পাক জোনাবে পঁহুছে। বাদ আরজ ইতঃপূর্ব্বে খাদেম আপনাকে ২ কানা পত্র বর্দ্ধমানের ঠিকানায় লিখিয়াছিল, কিন্তু বড়ই দুঃখের বিয়য় কোন উত্তর পাই নাই। পড়াশুনা মন্দ হয় নাই। বোডিং অবস্থা মাঝামাঝি। সকলেই ভাল।
রমজান শাহের পিতা শুরৎ শাহের নিকট আপনি যে ছয় টাকার মানতা হইয়াছিলেন,তন্মধ্যে কেবল দুই টাকা সে আপনাকে দিয়াছিল। বাকী চার টাকা আপনি চলিয়া যাইবার সময় আমার নামে চাপাইয়া দিয়াছিলেন এবং লিখিয়াও লইয়াছিলেন। আমি জানি যে, সে চারি টাকা আপনি রমজানের হিসাবে চাপান নাই। তথাপি শুরৎশাহ বলিতেছে “মৌলবি সাহেব তোমার টাকা চারিটি রমজানের হিসাবে চাপাইয়া দিয়াছেন, তুমি পাইবার কে? আমি তাহাকে বিশেষ করিয়া বুঝাইয়া দিলেও সে বুঝিতেছে না।। শেষে বলিয়াছে, যদি মৌলবি সাহেব লিখিয়া দেন যে তাহা রমজানের হিসাবে চাপান নাই তাহা হইলে আমি টাকা দিতে স্বীকৃত আছি। আপনি পুনরায় যখন টাকার জন্য এখানে আসেন তখনও বলিয়া যান যে, সে টাকা রমজানের টাকা হইতে কাটাইয়া লই নাই। তথাপি সে বুঝিবে না। অতএব মেহেরবানী পূর্বক অপর কার্ডে স্পষ্ট করিয়া লিখিয়া দিয়া বাধিত করিবেন যে, রমজানের টাকা হইতে বা তাহার হিসাবে আমার টাকা কাটাইয়া লই নাই। নতুবা এ গরিবের টাকা কয়টি অনর্থক যায়। আশা করি আমার পত্র পাঠ স্পষ্ট করিয়া জানাইয়া বাধিত করিবেন। পত্রের আশায় রহিলাম।
আজকাল কি করিতেছেন ও কোথায় আছেন জানাইবেন। পাক জোনাবে আরজ।
ইতি-
খাদেম, নজরুল এসলাম
মৌলভী আব্দুল গফুর সাহেব
ভিলেজ-বাণীশোর
পোস্ট অফিস- ভাটার
বর্ধমান
চিঠির প্রতিলিপির শেষে লেখা ছিল, পশ্চিমবঙ্গ মুসলিম অনুসন্ধান সমিতির সম্পাদক জনাব এম, আব্দুর রহমান সাহেবের সৌজণ্যে এ দূর্লভ চিঠিটি মুদ্রিত করা সম্ভব হল। (নজরুল প্রসঙ্গে-রফিকুল ইসলাম।)
তথ্যঋণ-
‘নজরুল প্রতিভা’ - মোবাশ্বের আলী
‘নজরুল প্রসঙ্গে’ - রফিকুল ইসলাম
‘কেউ ভোলে না কেউ ভোলে’- শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
কাজী নজরুল ইসলাম “স্মৃতি কথা” কমরেড মুজাফফর আহম্মদ
“আমার বন্ধু নজরুল” শৈলজানন্দ মুখোপ্যাধ্যায়ের (হরফ প্রকাশনী, কলকাতা ১৩৭৫)