কাজী নজরুল ও লেটো গানের কিছু কথা
মাজহারুল মোর্শেদ

লেটো গানের ইতিহাস থেকে জানা যায়, এ গানের উদ্ভাবক মুর্শিদাবাদ জেলার একঘরিয়া গ্রামের মুন্সি আহমদ হোসেন। যদিও তাঁর গানের নমুনা কিছু পাওয়া যায় নি। ঐতিহাসিকদের মতে, এটা সম্ভাব্য নাম। তাই লেটো গানের শুরুটাকে নির্ধারণ করতে হলে আমাদের বাংলা অষ্টাদশ শতকের পুর্বের বাংলা গানের ধারা অনুসরণ ছাড়া সম্ভব নয়।

লেটো গান পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে প্রচলিত এক প্রকার লোকসঙ্গীত। পালার আকারে রচিত এ গান নৃত্য ও অভিনয়সহ পরিবেশন করা হয় সঙ্গে থাকে বাদকদল। লেটো গানে অনেক সময় দুটি দলের মধ্যে প্রতিযোগিতাও হয়। দলের প্রধানকে বলা হয় ‘গোদা কবি’।
লেটো গান শুরু হয় বন্দনা দিয়ে। সখি, সঙদার, পাঠক বিভিন্ন নামে নট-নটীরা গান ও নাচ পরিবেশন করে। কিশোর বালকরা মেয়েদের পোশাক পরে নটী সাজে। এর বিষয় বস্তত সামাজিক রঙ্গরস ও আটপৌরে গ্রামীণ জীবন। পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক বিষয় নিয়েও পালা রচিত হয়।
লেটো গান যেহেতু একটি পালাধর্মী গান, সেজন্য এখানে একাধিক কণ্ঠশিল্পী ও বাদ্যকার থাকে। প্রধান কবিয়ালের অধীনে দল সাজানো হত। তিনিই গোদাকবি। দলে অংশগ্রহণকারীদের নানা নামে ডাকা হয়। যেমন-
ডাকসুরা- পালা সূচনায় ডাক দেওয়া বা উপস্থাপক।
গোদাকবি- দলের পরিচালক ও প্রধান কবি।  
বাই, ছোকরা বা রাঢ়- দলে দেখতে সুন্দর কিশোর যে মেয়েদের পোশাক পরে নারী ভুমিকায় অবতীর্ণ হয়। এরা পালার মহিলা চরিত্রে অভিনয়, গান, নাচ করে থাকে।
পাঠক- রাজা, মন্ত্রী, সেনাপতি অর্থাৎ শক্তিশালী পুরুষ চরিত্রের নাম পাঠক।
সংগাল- যারা নাচ, গান আর অভিনয়ে মাধ্যমে দর্শককে হাসায় তারাই সংগাল। এরা সঙ সেজে এই পালায় থাকে বলেই এই নামে ডাকা হয়।
‘নিমশা’ গ্রামে লেটো গানের দলের পরিচালক, স্বনামধন্য অপরাজেয় গোদা কবি ও ওস্তাদ কাজী বজলে করীম ছিলেন কাজী নজরুল ইসলামের চাচা। কাজী নজরুলের বয়স যখন বারো-তেরো বছর বলে জানা যায়, ওস্তাদ কাজী বজলে করীমের হাত ধরেই লেটোগানের জগতে আসেন তিনি। বজলে করীমের সহযোগিতা ও প্রশিক্ষণে দুখু মিয়া নাচ-গান-অভিনয়ে এবং বাদ্যযন্ত্রের দক্ষ হয়ে ওঠেন।
দু’টো পয়সা রোজগারের তাড়ণা থেকেই কাজী রজরুল, কৈশোরে ভ্রাম্যমাণ নাটক (লেটো গান) দলের সঙ্গে কাজ করেন। সেই সুবাদে সাহিত্য, কবিতা ও নাটকের সঙ্গে তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন। রাঢ় বাংলার (পশ্চিম বাংলার বর্ধমান-বীরভূম অঞ্চল) কবিতা, গান আর নৃত্যের মিশ্র আঙ্গিক লোকনাট্যের দলে বালক নজরুল ছিলেন একাধারে পালাগান রচয়িতা ও অভিনেতা। তাৎক্ষণিকভাবে কবিতা ও গান রচনার কৌশল নজরুল লেটো বা কবিগানের দলেই রপ্ত করেন। এ সময় লেটোদলের জন্য কিশোর কবি নজরুলের সৃষ্টি। নজরুলের লেখা পালার গানগুলি হল-
চাষার সঙ, রাজপুত্রের সঙ, রাজা যুধিষ্ঠিরের সঙ, আকবর বাদশাহ, কবি কালিদাস, শকুনিবধ, দাতা কর্ণ,  বিদ্যাভূতুম,
বুড়ো সালিকের ঘাড়ে রোঁ, মেঘনাদ বধ প্রভৃতি।
মোট কথা নজরুলের কাব্যলেখা ও শিল্পী জীবনের সূচনা হয় এই লেটোদল থেকেই। মক্তবে ছাত্র-শিক্ষক, মাজারের খাদেম এবং মসজিদের ইমাম বা মুয়াজ্জিনের পর কাজী নজরুলকে লেটো গানের দলে যোগ দিতে দেখা যায়। এ প্রসঙ্গে নজরুলের আত্মীয় কাজ আনোয়ারুল ইসলাম “নজরুলের বাল্যজীবন” শীর্ষক প্রবন্ধে (কবিতা কার্তিক -পৌষ ১৩৫১) লিখেছেন-
“বাড়ির অবস্থা ভালোছিলনা তাই নজরুল ‘লেটো’র দলে গান এবং নাটক রচনা করে দিয়ে অর্থ উপার্জন করতেন। তাঁর বয়স বারো-তেরো বছর মাত্র এ সময়ে রচনা তাঁর এত ভাল হতে লাগল যে ক্রমে তিনি ‘নিমসা’ ও ‘চুরুলিয়া’ এবং ‘বাখাখূড়া’ এ তিনটি ‘লেটোনাচে’র দলে নাটক রচনা করে গেলেন।”
বাসুদেবের কবিগানের দলে কিশোর নজরুলের চিত্র পাওয়া যায় শৈলজানন্দ মুখোপ্যাধ্যায়ের “আমার বন্ধু নজরুল” (হরফ প্রকাশনী, কলকাতা ১৩৭৫) গ্রন্থে-
“একটা অজুন গাছে হেলান দিয়ে গার্ড সাহেব দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গান শুনছেন। গান শুনতে শুনতে তন্ময় হয়ে গেলেন। দেখলেন দলের মাঝখানে বসে জোয়ান যে ছেলেটি ঢোলক বাজিয়ে গান গাইছে, তারই কৃতিত্ব যেন সবচেয়ে বেশি। মাথায় ওেছাট ছোট চুল, গায় একটা হাফ হাতা জামা, পরণে খাট ধুতি। হাসি যেন মুখে তার সব সময় জড়িয়ে আছে।
দু’টো গান শেষ হল। ছেলেটি উঠে দাঁড়াল। বললে চললাম। সবাই আবার তাকে ধরে বসল, আর একট থাক। ছেলেটি থাকল না। বেরিয়ে যাচ্ছিল গার্ড সাহেবের পাশ দিয়ে। গার্ড সাহেব তার হাতটা চেপে ধরলেন। ছেলেটা হকচকিয়ে থমকে দাঁড়াল।
গাড সাহেব বললেন তুমি এ দলের নও তাহলে?
না
কি নাম তোমার?
দুখু মিয়া, ভাল নাম নজরুল ইসলাম।
তুমি মসলমান?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
সাহেব তার বুকে একটা থাপ্পর মেরে বললেন বাঃ।
বাসুদেব হারমোনিয়াম বাজাচ্ছিল, ঘাড় ফিরিয়ে দেখছে ব্যাপারটা। দুখুকে সাহেব ধরেছে। আসর ছেড়ে ছুটে এল বুড়ো বাসুদেব। সাহেবের কাছে এসে জোড় হাতে বললে-দল আমার হুজুর, ও শুধু গান লেখে, পালা লেখে আর সুর দিয়ে দেয়। যা বলতে হয় আমাকে বলুন। (নজরুল প্রসঙ্গে- রফিকুল ইসলাম পৃষ্ঠা ১৩-১৪)
সাধারণত শীতের ফসল ওঠার পরে কৃষকের অবসর সময়ে লেটো গানের আসর বসে। লোকমনোরঞ্জনই এর প্রধান উদ্দেশ্য। প্রধানত মুসলমান সমাজে লেটো গানের সমাদর বেশি। লেটো গানের পরিবেশনায় ছিল- ‘ছোট ছোট’ প্রেমগীত, ডুয়েট, ইসলামী গান, রাধা-কৃষ্ণ বিষয়ক গান, চাপান- উতোর সং এবং বিভিন্ন ধরনের পালা।
যেমন-
ঐ, ঐ, ঐ আসে কর্ণ কৌরব সেনানী।
মহাবীর ভীষ্ম গেছে, দ্রোণ গেছে জানি।
কর্ণে বধিতে হবে, কুরুক্ষেত্র রণে।
তারপর বধিব মোরা নীচ দুযোর্ধনে।
কাজী ফজলে করীম ছিলেন এই অঞ্চলের অপরাজেয় জনপ্রিয় একজন গোদাকবি। তাঁর হাত ধরেই নজরুলের লেটো গানের দলে আসা। কিশোর নজরুলের রচিত পালায় পাওয়া যায় সমকালীন সামাজিক প্রেক্ষাপট, পাওয়া যায় আর্থসামাজিক দ্ব›দ্ব। কাব্য রচনায় অসাধারণ দক্ষতা, রসবোধ, বিরুদ্ধ পক্ষকে ঘায়েল করার তীক্ষè পদরচনা, বিদ্রæপ ইত্যাদি। এর আর এক নাম ছিল ‘চাপান উতোর সঙ’। ইসলামের শরিয়ত, সুফি, বাউল, হিন্দু পৌরাণিক কাহিনী, বৈষ্ণব ও শক্তি দর্শন ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ের পরিচয় মেলে তার গানে। এমন একটি জনপ্রিয় লেটোগান-
লৌহ কারার দুয়ার ভাঙো,
দুয়ার ভাঙো বন্দী আজি মহান রাজা।
কে রাজাকে বন্দী করে,
কোন বিদেশিনী, দেয় সে সাজা;
ভাঙ ঐ কারার দুয়ার জোরসে টান,
অত্যাচারীর মাথার উপর খড়গ হান,
পালারে অত্যাচারী জেগেছে আজ সকল প্রজা
লাথি মার লাথি মার কারার দ্বারে,
ঝনঝনিয়ে ভাঙুক কারা ভয় কারে রে
মায়াবিনী বিদেশিনী দ্বীপবাসিনীর দিব সাজা
সেকালের রাঢ় অঞ্চলের শ্রমজীবী প্রান্তিক গোষ্ঠীর কাছে এইসব গান ও লোকনৃত্য চিত্তবিনোদনের অন্যতম মাধ্যম ছিল। আর রাঢ় বাংলার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশই ছিল ইসলাম ধর্মবলম্বী। তাই  ইসলামী গান সহ মনসা মঙ্গলের আদলে তৈরি হল সত্যপীরের গান। পাঁচালির অনুকরণে হল সত্যপীরের পাঁচালী, হোসেনের পাঁচালী। কৃষ্ণযাত্রা হল ইমামযাত্রা।
দলের প্রয়োজনে দুখু মিয়া রচনা করলেন বিভিন্ন পালা, ‘প্রেম গান, ইসলামী গান, ডুয়েট গান, রাধা-কৃষ্ণ বিষয়ক গান, হাসির গান ও অন্যান্য গান, হাস্যরসাত্মক সং।’ ইসলামী ধারার একটি গান-
চাষ কর দেহ জমিতে
হবে নানা ফসল এতে।
নামাজে জমি ‘উগালে’
রোজাতে জমি ‘সামালে’,
কলেমায় জমিতে মই দিলে
চিন্তা কি হে এই ভবেতে।।
শুধু তাই নয়, কবি নজরুলের অন্য আর একটি বৈশিষ্ট্য ছিল সং ও পালার সঠিক স্থানে সঠিক রসের গান সংযোজন। এসব গান তিনি নিজেই রচনা করতে পারতেন। যার জন্য সং ও পালাগুলো আকর্ষণীয় হয়ে উঠতো। লেটোর আসরে হাস্যরসাত্মক নাট্যশ্রিত গান এবং এক মুখো কমিকের প্রচলন তিনি করে গিয়েছিলেন।”
বয়সের ভারে বজলে করীম দল ছাড়ার আগে দুখু-কে লেটো দলের ওস্তাদ পদে নিযুক্ত করেন। ওস্তাদ হবার পর তাঁর লেটো দলে আসে নতুন করে গতি। তিনি লেটো গানের জন্যে উপাধি পান ‘ভ্রমর কবি’ হিসেবে। তিনি গৌরববোধও করতেন তার উপাধি নিয়ে। আর সে কারণেই হয়তো তার একটি গানে ভ্রমর কবি ভানতা যুক্ত পঙক্তি পাওয়া যায়।
চেয়ো না সুনয়না
আর চেয়ো না এ নয়ন পানে।
জানিতে নাইকো বাকি
সই ও আঁখি কী জাদু জানে।
মিছে তুই কথার কাঁটায়
সুর বিঁধে হায়-রে ভ্রমর কবি।
বিকিয়ে জায়রে মালা,
আয় নিরালা আঁখির দোকানে।
বর্তমানে গানটির ‘ভ্রমর’ শব্দের স্থলে ‘গাঁথিস’ ব্যবহৃত। গানটি যে লেটোর গানের জন্যেই রচিত এ ব্যাপারেও মুহম্মদ আয়ুব হোসেনের দেয়া তথ্য এরকম- “এই গানটি আছে, কবির লেটো জীবনের বন্ধু, চুরুলিয়া নিকটবর্তী কোলজোড়ার শেখ ফকির মন্ডলের লেটো গানের খাতায়।”
শিয়ারসোল-রাণীগঞ্জের ছাত্র জীবনেও দুখু মিয়া অনেক লেটো গান, সং ও পালা রচনা করেছিলেন। লেটোর গানকে নতুন করে জনপ্রিয় করে তুলবার ক্ষেত্রে এবং কৃষিজীবী শ্রমজীবী সমাজের চিত্তবিনোদনের জন্যে দুখু মিয়ার অবদান বাংলা লোক সাহিত্যে এক অনন্য সংযোজন। লেটোদলের জন্য নজরুলের লেখা কতিপয় লেটোগান-
আই লো, আই সতীন-রা
আম খাবি তো আয়।
এ আম খেলে, হবে ছেলে
ঘুচবে সকল দায়।
ফকিরের দাওয়ার এ ফল,
খেলে পেটে আসবে লো ফল,
জীবন তোদের হবে সফল,
আই লো তোরা আয়।
১৯১০ সালে নজরুল লেটো দল ছেড়ে ছাত্র জীবনে ফিরে আসেন। লেটো দলে তার প্রতিভায় সকলেই যে মুগ্ধ হয়েছিল তার প্রমাণ নজরুল লেটো ছেড়ে আসার পর তাকে নিয়ে অন্য শিষ্যদের রচিত গান-
‘’আমরা এই অধীন, হয়েছি ওস্তাদহীন
ভাবি তাই নিশিদিন, বিষাদ মনে
নামেতে নজরুল ইসলাম,
কি দিব গুণের প্রমাণ”।

তথ্যসূত্র
ইনটারনেট মেডিয়া।
শৈলজানন্দ মুখোপ্যাধ্যায়ের “আমার বন্ধু নজরুল” (হরফ প্রকাশনী, কলকাতা ১৩৭৫)
নজরুল প্রসঙ্গে- রফিকুল ইসলাম (পৃষ্ঠা ১৩-১৪)