কুমিল্লার দৌলতপুরে কবি নজরুল ও নার্গিস সম্পর্কে কিছু কথা-(২য় পর্ব )
মাজহারুল মোর্শেদ
কবি নজরুল ও নার্গিসের প্রণয়ী আবেক সূচক আচরণ অনেকের দৃষ্টিতে আসে। উদীয়মান তরুণ কবি নজরুলকে নিজ পরিবারের সাথে সম্পর্কের বাঁধনে আটকে রাখতে পারলে তার পুস্তক ব্যবসায় লাভজনক হবে এটা নিশ্চিন্তে ভাবা যায়। কমরেড মুজাফফর আহমেদের ভাষায়- “এবার শুরু হলো আলী আকবার খানের অভিনয়। তিনি বারেবারে নার্গিসের মায়ের পদধুলি মাথায় নিতে লাগলেন আর বলতে লাগলেন ‘বুবু তুমি রতœপ্রসবিনী’ এই ছেলে (নজরুল) একসময় জগৎ বিখ্যাত দার্শনিক কবি হবে, কাজেই কাজীকে কোন উপায়ে আটকাতেই হবে। বিয়ের কথা হতে নার্গিস মায়ের কাছে না থেকে মামাদের বাড়িতে থাকতে লাড়ল। বিয়ে মামার বাড়িতে হতেই হবে। আলী আকবর খান সে ব্যবস্থাই করতেছিলেন, চারদিকে নিমন্ত্রণ পত্র চলে গেল।”
(কাজী নজরুল ইসলাম-স্মৃতিকথা-মুজফফর আহমদ পৃষ্ঠা-৯৮)
নজরুলের সহায় সম্বল অর্থ-সঙ্গতির বিষয়ে আলী আকবর খান এবং বাড়ির অভিভাবকগণ অবহিত ছিলেন। বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠদের অনেকে তাকে ছন্নছাড়া বাউন্ডুলে উড়ে এসে জুড়ে বসা ছেলে বলে ভাবতেন। বিয়ের আগে তাদের মধ্যে এ নিয়ে কথাও হয়েছে। এখতারুননেসা প্রস্তাব করেছিলেন যে তারা তিন বোন তাদের পৈতৃক সম্পত্তি থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে জুবী আর নজরুলের জন্য ঢাকা বা কলকাতায় বাড়ি করে দেবেন; ততদিন জুবী না হয় দৌলতপুরেই থাকবে। এমন একটা কাঙ্খিত ধারণার ভিত্তিতে আলী আকবর খান নজরুলের কাছে নার্গিসের বিবাহের প্রস্তাব পেশ করেন। এবং নজরুলের সম্মতিতে ১৭ই জুন শুক্রবার (৩রা আষাঢ়, ১৩২৮) বিবাহের দিন ধার্য হয়। নজরুল কি নার্গিসকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন? অবশ্যই তিনি নার্গিসকে বিয়ে করতে সম্পূর্ণ ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন বলেই আলি আকবর খানের প্রস্তবে সম্মতি দিয়েছিলেন এবং এ ব্যাপারে পত্রের মাধ্যমে কলকাতার বন্ধু-বান্ধবদেরকে তাঁর বিয়ের কথা জানিয়ে ছিলেন।
আলি আকবর খানের বাড়ি হতে চেষ্টা করা হচ্ছিল যেন এ বিয়ে উপলক্ষ্যে ইন্দকুমার সেনগুপ্তের বাসার লোকদের নিমন্ত্রণ করে আনা হোক। কারণ স্কুল জীবন হতে আলী আকবর খান সে বাড়িতে যাচি।ছলেন, খাচ্ছিলেন, থাকছিলেন। ছোট ভাইয়ের কারণে আলতাব আলী খানেরও সে বাড়িতে যাতায়াত ছিল। (কাজী নজরুল ইসলাম-স্মৃতিকথা-মুজফফর আহমদ পৃষ্ঠা-৯৮)
বিয়ের কথা হতেই নজরুল বিরজাসুন্দরী দেবীকে চিঠি লিখে অনুরোধ করেছিলেন যে,
“মা তুমি না এলে আমার পক্ষেত কেউ থাকছে না। তোমাকে আসতেই হবে।”
নজরুল ইসলাম সত্যিকার অর্থে নার্গিসকে ভালোবেসে বিয়ে করতে রাজী হয়েছিলেন তার প্রমাণ হলো- তিনি পবিত্র গাঙ্গোপাধ্যায়কে চিঠিতে লিখেছেন-‘এক অচেনা পল্লী-বালিকার কাছে এত বিব্রত আর অসাবধান হয়ে পড়েছি, যা কোন নারীর কাছে কখনও হইনি।’
বিবাহের এই খবর, নজরুল মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলীকে জানিয়েছিলেন। এর ৪ দিন পর ২১ জুন আলী আকবর একটি নিমন্ত্রণ পত্র পাঠিয়েছিলেন। এই পত্রটি আলী আকবর খানের নামে মুদ্রিত হয়েছিল। অরুণকুমার বসু তাঁর “নজরুল জীবনী” গ্রন্থে পত্রে মূল বয়ান তুলে ধরেছেন। পত্রটি ছিল-
“এ বিশ্বনিখিলের সকল শুভ কাজে যাঁর প্রসন্নকল্যাণ আঁখি অনিমিখ হয়ে জেগে রয়েছে...তাঁর ঐ মহাকাশের মহাসিংহাসনের নীচে আমার মাথা নত করে আমি আপনাদের জানাচ্ছি যে আমার পরম আদরের কল্যাণীয়া ভাগ্নী র্নাগিস আরা খানমের বিয়ে বর্ধমান জেলার ইতিহাস-প্রখ্যাত চুরুলিয়া গ্রামের দেশবিখ্যাত পরমপুরুষ, আভিজাত্যগৌরবে গৌরাবান্বিত, আয়মাদার, মরহুম মৌলবী কাজী ফকির আহমদ সাহেবের দেশবিশ্রæত পুত্র মুসলিম কুলগৌরব মুসলিম বঙ্গের 'রবি' কবি, দৈনিক নবযুগের ভূতপূর্ব সম্পাদক কাজী নজরুল ইসলামের সাথে। বাণীর দুলাল দামাল ছেলে, বাংলার এই তরুণ সৈনিক কবি ও প্রতিভান্বিত লেখকের নতুন করে নাম বা পরিচয় দেবার দরকার নেই। এই আনন্দঘন চিরশিশুকে যে দেশের সকল লেখকলেখিকা, সকল কবি-যুবকরা ভালোবাস দিয়েছিলেন সেই বাঁধনহারা যে দেশমাতার একেবারে বুকের কাছটিতে প্রাণের মাঝে নিজের আসনখানি পেতে চলেছে, এর চেয়ে বড়ো পরিচয় তার আর নেই।
আপনারা আমার বন্ধু, বড়ো আপনার জন। আমার এ গৌরব, আমার এ সম্পদের দিনে আপনারা এসে আনন্দ করে আমার এ কুটিরখানিকে পূর্ণ আনন্দ দিয়ে ভরাট করে তুলুন, তাই এ আমন্ত্রণ। বিয়ের দিন আগামী ৩রা আষাঢ় শুক্রবার নিশীথ রাতে আরজ।
বিনীত আলী আকবর খান”
এই চিঠি আলী আকবর খানের নামে লিখিত হলেও, মুজফ্ফর আহমেদের ধারণা চিঠিটি খসড়া তৈরি করে দিয়েছিলেন নজরুল নিজেই। মুজফ্ফর আহমেদ এই নিমন্ত্রণ পত্র পেয়েছিলেন নজরুলের আক্দের অনুষ্ঠান হয়ে যাওয়ার পর। তিনি এই চিঠি পড়ে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন সম্ভবত ' মুসলিম বঙ্গের 'রবি' কবি' দেখে। মুজফ্ফর আহমেদ এই দাবিকে অহঙ্কারের প্রকাশ হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন। এ বিষয়ে পরে (২৬ জুন) মুজফ্ফর আহমেদ নজরুলকে একটি পত্র পাঠিয়েছিলেন। অবশ্য পত্রিকান্তরে, নজররুল- আলী আকবর খানের নিমন্ত্রণ পত্রের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন। নজরুলের এই প্রতিক্রিয়াটি ছাপা হয়েছিল- সাপ্তাহিক বিজলী পত্রিকার ২২শে জুলাই সংখ্যায়। [সূত্র: ১২ আষাঢ় (২৬ জুন ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দ) নজরুলকে লেখা মোজাফ্ফর আহমেদের চিঠি। কবি পরিচিতি। আব্দুল কাদির।]
বিয়ের ধুম ধাম গান বাজনা চলে বিয়ের সাত দিন আগে থেকে; বাদ্যকর, বয়াতী এলেন; এলেন ওস্তাদ আলাউদ্দীন খানের ভাই বংশীবাদক আফতাবউদ্দীন খানও। দৌলতপুরের পার্শ্বস্থ বাঙ্গোরার জমিদার রায় বাহাদুর রূপেন্দ্র লোচন মজুমদার এবং বাঙ্গোরা হাই স্কুলের হেড মাস্টার বাবু মোহন মজুমদার।
১৭ই জুন ১৯২১ (শুক্রবার ৩রা আষাঢ় ১৩২৮) কুমিল্লার দৌলতপুরে, নজরুলের সাথে নার্গিসের আক্দ আসর বসে দৌলতপুরস্থ আলী আকবর খানের বাসায়। এই অনুষ্ঠানে আলী আকবর খান কুমিল্লা থেকে সপরিবারে ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। বিবাহ অনুষ্ঠানে ইন্দ্রকুমারের পরিবারের প্রায় সকলেই দৌলতপুরে গিয়েছিলেন।
মুজাফ্ফর আহমদের “কাজী নজরুল ইস্লাম স্মৃতিকথা” গ্রন্থে ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের সাথে আর যাঁরা দৌলতপুর গিয়েছিলেন তাঁর একটি তালিকা পাওয়া যায়। এঁরা ছিলেন-
শ্রীইন্দ্রকুমার সেনগুপ্ত,
শ্রীযুক্তা বিরজাসুন্দরী দেবী (শ্রীইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের স্ত্রী),
তাঁদের একমাত্র পুত্র শ্রীবীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্ত
শ্রীমতি কমলিনী সেনগুপ্তা (বীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের স্ত্রী,)
তাঁদের শিশুপুত্র প্রবীরকুমার সেনগুপ্ত ওরফে রাখাল
শ্রীযুক্তা গিরিবালা দেবী (বীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বিধবা জ্যেঠী মা),
কুমারী প্রমীলা সেনগুপ্তা (গিরিবালা দেবীর ১৩ বছরের কন্যা),
কুমারী কমলা সেনগুপ্তা (ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের ১২ বছরের মেয়ে),
অঞ্জলি সেনগুপ্তা ওর্ফে জটু (ইন্দ্রকুমারের ৬ বছরের শিশুকন্যা)
সন্তোষকুমার সেন (পরিবারের একটি ¯েœহাস্পদ কিশোর)”।
প্রথমে পরিস্কার হওয়া দরকার যে, মুসলিম বিবাহ কোন আধ্যাত্মিক বিবাহ নয়। এটা নিতান্তই নারী-পুরুষের মধ্যে একটা চুক্তি বা কন্ট্রাক্টের ব্যাপার। ইংরেজিতে যে অমরা সিভিল ম্যারেজ বলি এটা ঠিক তাই। এই কন্ট্রাক্টকেই আরবি ভাষায় ‘আকদ’ বা ‘নিকাহ’ বলে। এই কন্ট্রাক্টের একটা পরিবর্ত (আরবিতে ‘ইববজ’ বা ‘ইওজ’) থাকা আবশ্যক। এই পরিবর্ত হচ্ছে নারী-পুরুষের সহবাস, আনন্দ লাভ এবং সন্তানোৎপাদন। কিন্তু সন্তান না জন্মালেও বিয়ে বাতিল হয়ে যায় না। বিয়ের কন্ট্রাক্ট একটি মজলিসে স্বাক্ষীগনের মোকাবেলায় হতে হয়। মুসলিম বিবাহে একটা ‘মাহর’ বা স্ত্রিধন ধার্য হওয়া অপরিহার্য। এটা স্বামীর নিকট থেকে স্ত্রি পেয়ে থাকেন। এর অর্ধেক স্ত্রি পক্ষ হতে দাবি করা মাত্রই দিতে হয়। বাকি অর্ধেক বিবাহ বর্তমান থাকা অবস্থায় শোধ দিতে হয়। কিন্তু বিবাহের কন্ট্রাক্ট হওয়ার পরে নারী-পরুষের সহবাসের ভিতর দিয়ে তার পরিপূর্ণতা লাভ না হলে স্ত্রির স্ত্রিধন প্রাপ্য হয় না। বিয়েটা যখন কন্ট্রাক্টের মধ্যে হয় তখন এ বিবাহ বিচ্ছেদও আছে। কিন্তু এখানে পুলুষরাই প্রবল পক্ষ। তারা যখন খুশি মুখের কথায় বিবাহ বাতিল করতে পারে। কয়েকটি ব্যাপাওে স্ত্রি বিবাহ বাতিল করতে পারলেও তার জন্য তাদের অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। জবরদস্তীর ভিতর দিয়ে তা সে পুরুষ কিংবা নারী যেই হোক না কেন বিয়ে হলে সে বিয়ে সঙ্গে সঙ্গে অসিদ্ধ হয়ে যায়। (কাজী নজরুল ইসলাম-স্মৃতিকথা-মুজফফর আহমদ পৃষ্ঠা-৯৯)
আকদ্ আনুষ্ঠানের অন্যান্য কাজে যখন সবাই ব্যস্ত নীরব-নিথর স্তব্ধতায় আচ্ছন্ন। জেগে আছে রাতের চাঁদ-তারা। আবার সে চাঁদ-তারাও আষাঢ়ের মেঘমালার সাথে আলো-আঁধারের লুকোচুরি খেলায় নিমগ্ন। দূর-বহুদূর থেকে ক্ষণে ক্ষণে ভেসে আসে রাত জাগা শুকসারির অস্ফুট সুর। নজরুল-নার্গিস যুগল-মিলনের ক্ষণে। এই প্রেমময় শুভলগ্নে-শুভক্ষণে হঠাৎ আষাঢ়ের কালো মেঘের ধূপছায়া ফেলে দুজনার হৃদয়াকাশে। বিয়ের আকদ নিয়ে শুরু হয় বাক-বিতÐা। তখন নজরুল অন্তর্দ্বন্দে বিক্ষুব্ধ কারণ আলী আকবর খানের বাড়াবাড়ী রকমের আগ্রহ এবং নার্গিসের কিছু কিছু আচরনে ক্রমে বিরক্ত হতে লাগলেন। সে উত্তপ্ত রেশ মুহূর্তের মধ্যে তিক্ততায় পৌঁছে চরমে। আষাঢ়ের কালো মেঘ যেন কঠিন বজ্র-ঝড়ে রূপ নেয়। কবির চাঁপা ক্ষোভ ধুম্রজালে ছেয়ে যায়। বিরক্তি চরম শিখরে উঠল যখন আলী আকবর খান কাবিননামায় একটি শর্ত রাখতে চাইলেন- ‘‘বিয়ের পরে নজরুল নার্গিসকে অন্য কোথাও নিয়ে যাবেন না। দৌলৎপুরেই তার সঙ্গে বাস করবে।’’
এ অপমানজনক শর্ত নজরুল মেনে নিতে পারেননি। কিন্তু দুখু মিয়া তখনও নজরুল হয়ে ওঠেননি। দুখু মিয়ার দুঃখের অমানিশার ছদ্মাবরণে ঢাকা নজরুল। ছন্নছাড়া, বাঁধন-হারা দুঃখ ভরা জীবনতরীর এক দুর্দিনের যাত্রী। তবে নজরুল দারিদ্রতার কষাঘাতে জর্জরিত হলেও তাঁর আভিজাত্যকে ঢেকে দিতে পারেনি দুঃখের কালোছায়া। ‘ঘরজামাই’ হয়ে থাকার কথা শুনে কবি দুঃখে ক্ষোভে, ক্রোধে যেন ফেটে পড়লেন। বিয়ের মজলিশ থেকে উঠে তিনি ছুটে যান বিরজা সুন্দরী দেবীর কাছে। তাকে বলেন,
“মা, আমি এখনই চলে যাচ্ছি”।
ওই অবস্থায় তাকে ফেরানোর কোন কথাই ওঠে না। নজরুলের মেজাজ সেই রকম নয়। “তিনি বললেন, তুমি বাইরের লোক, পথ ঘাট চেনো না, এই রাত্রে একা যাবে কি করে? যাবেই যদি তবে বীরেনকে সঙ্গে নিয়ে যাও। সে তবু কুমিল্লায় জন্মেছে আর কুমিল্লায় মানুষ হয়েছে, এদেশের লোকজনকে চেনে। আমাদের সঙ্গে তো উনি থাকলেন।“
নার্গিসকে সঙ্গে নিতে চাইলেন। কিন্তু নার্গিস বয়সে ষোড়শী অনূঢ়া, ছিন্নমূল বাউন্ডুলে কবিকে বুঝে উঠতে পারেননি স্বল্প সময়ে। নাম ঠিকানা বিহীন বাঁধন-হারা এক কবির সঙ্গে অজানার পথে পা বাড়াতে সে দিন সাহস পাননি সনার্গিস। নার্গিসের অনাহত উন্মাসিকতা কবির বুকে হেনেছিল চরম আঘাত। দুরন্ত-দুর্বার নজরুলে একরোখা মন। পশ্চিমবঙ্গের চুরুলিয়ার কাঁকর বিছানো রুদ্র কঠিন মাটির ছেলে তেঁতে উঠলেন চৈত্রের খরার মত। জ্যৈষ্ঠের ঝড়ের মত ফেটে পড়লেন রুদ্র রোষে। আর তখনি আষাঢ়ের মেঘঘন বিদ্যুৎ গতিবেগে ঘর থেকে বেড়িয়ে পড়েন পথে।
“শুধু আষাঢ় মাস তো ছিল না, পূর্ববঙ্গে অতি বৃষ্টির আষাঢ় মাস। পথ ঘ্ট গলে গিয়ে কাদাময় হয়ে যায়। সেই কাদা বিছানো পথে দশ-এগারো মাইল রাস্তা পায়ে হেঁটে নজরুল ও বীরেন্দ্রকুমার কুমিল্লা পৌছেন ৪ঠা আষাঢ়ের সকাল বেলা। একেতো এগারো মাইল কাদা বিছানো পথ পায়ে হেঁটে আসা তার উপর নার্গিসকে ফেলে আসার মানসিক চাপ। সব মিলিয়ে নজরুল ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন।
শ্রীযুক্তা বিজরা সুন্দরী লিখেছেন- “দৌলৎপুরে তারা তিন দিন ছিলেন”। তার মানে ২রা,৩রা ও ৪ঠা আষাঢ় এই তিন দিন। ৪ঠা আষাঢ় দিবাগত রাত্রির গভীর তাঁরা নৌপথে আলী আকবর খানের বাসা ছেড়েছিলেন। বিয়ের বর উঠে চলে গেছেন, এজন্য গ্রামের লোকেরা তাদেও সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতে পারেন ভেবে তাদেও দিনের বেলা রওনা হতে দেওয়া হয়নি। ভোর হওয়া পর্যন্ত আলী আকবর খানের একজন অগ্রজ (আলতাব আলী নয়) আমাদের সঙ্গে ছিলেন। নজরুল পায়ে হেঁটে গিয়েছিলেন বলে তার নিজের জিনিস পত্র সঙ্গে নিয়ে যেতে পারেননি। সেগুলো বিজরাসুন্দরী দেবী সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। সঙ্গে সে সব জিনিস নিয়েও ছিলেন তিনি, তবে তার ভিতর হতে আলী আকবর খার চিঠিপত্রগুলি ও অন্যান্য কাগজপত্রগুলি বার করে নিয়েছিলেন।”
আলী আকবর খানের প্রতি একটা অপসীম ঘৃণা নিে নজরুল দৌদৎপুর গ্রাম ছেড়েছিলেন। তাদের বাড়িতে যা ঘটেছিল তা জানতে পেলে নজরুলের কোন শুভাকাঙ্খী মত দিতে পারতেন না যে, ঐ পরিবারের মেয়েকে নিয়ে নজরুল সংসার পাতুক। কুমিল্লা হতে ফিরে এসে খুব অল্প সময় পেয়েছিল নজরুল, এর মধ্যে বিজরাসুন্দরী দেবীকে সাব খুলে বলতে পারেননি, বলা যায়ও না। কিন্তু বিরজাসুন্দরী ওখানে পৌছে যা শুনেছেন ও বুঝেছিলেন তাতে তার মন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। তিনি ভাবতে পারছিলেন না যে, এমন বিয়ে কি করে নজরুলের পক্ষে মঙ্গলময় হতে পারে। শেষ পর্যন্ত যা ঘটল তার মতে-“ বিয়েতো ত্রিশঙ্কুর মতোন ঝুলতে লাগল।” তবুও তিনি দৌলৎপুর হতে কুমিল্লায় ফিরে এসে নজরুলকে তার মনের সঙ্গে আর একবার বোঝাপড়া কওে দেখতে বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন-
“সব ঘটনা ভুলে গিয়ে নজরুল কি আর একবার তার মন ওই ময়েটির দিকে ফেরাতে পারেনা?”
উত্তরে নজরুল বলেছিল-“তার মন আর ওমুখো হবার নয়”।
(কাজী নজরুল ইসলাম-স্মৃতিকথা-মুজফফর আহমদ পৃষ্ঠা-১০৬)
সেই বিয়ে-ভাঙা রাতের কাহিনি জানা যায় বিরজাসুন্দরী দেবীর লেখা ‘নৌকা পথে’ নামক এক প্রবন্ধে-
“সকলের বড় ‘খান’ (আলতাফ আলী খান) আর সকলের ছোট ‘আ খান’ (আকবর আলী খান) এই দুইটির সঙ্গে আমার অনেক দিন থেকে জানা শুনা। ‘আ’ (আকবর আলী খান) আমার পুত্র ‘বী-র’ (বীরেন্দ্রকুমার সেনের) সহপাঠী, তাঁর সঙ্গেই আগে পরিচয়, সে আমাকে মা বলে এবং যথেষ্ট শ্রদ্ধা করে। তাঁর জন্য তাঁর ভাগ্নির (অতএব আমার নাতনীর), বিয়েতে তাদের বাড়ি গিয়েছিলেম। মুসলমানের বিয়ে এই প্রথম দেখলাম। ওদের বিয়ে একদিনে হয় না, সেদিন হ’লো আমাদের পাকা কথার মত বা লগ্ন পত্রের মত (এখন ও প্রথা উঠে গেছে)। বিয়ে তো ত্রিশঙ্কুর মতন ঝুলতে লাগলো মধ্য পথেই, এখন আমাদের বিদায়ের পালা- সে যে কি কান্না-কাটি আমাদের ছেড়ে দিতে, তা’ আর কি লিখব, লিখে বা বলে তা বুঝানো যায় না। মেয়ে বৌদের থেকে আরম্ভ ক’রে বাড়ি শুদ্ধ সব্বাই কাঁদতে কাঁদতে আমাদের সঙ্গে সঙ্গে ঘাটে এসে আমাদের নৌকায় উঠিয়ে দিলে। পাছে গ্রামের ছোট খাল দিয়ে যেতে কোন বিপদ হয়, সে জন্য সেই সরল স্বভাব মেজ ছেলেটি নৌকায় সকাল পর্যন্ত ‘কো-গঞ্জের’ (কোম্পানীগঞ্জের) বাজার থেকে আমাদের আবশ্যকীয় খাবার জিনিস কিনে দিয়ে হেঁটে বাড়ি রওয়ানা হ’য়ে গেল। এবার গোমতী দেবীকে উল্টো ঠেলে নিয়ে আসতে হলো বলে একদিনের রাস্তায় তিন দিন কাটিয়ে আমরা নিশি ভোরে কুমিল্লায় এসে পৌছুলুম।”
কলকাতায় লোকমুখে শুনতে পেলাম যে সেখানে নজরুলের নাকি খুব আদর আপ্যায়ন হচ্ছে। অনেক দিন নজরুলের নিকট হতে কোন পত্রও পোলামনা। অন্যান্যরাও যে কোন পত্র পেয়েছে সে কথাও শুনিনি।সমস্ত বৈশাখ মাস কেটে গেল কোন খবর নেই। জ্যৈষ্ঠমাসে হঠাৎ একদিন আমি নজরুল ও আলী আকবর খানের নিকট হতে পত্র পেলাম যে, খান সাহেবের এক ভাগিণীর সঙ্গে নজরুলের বিবাহ স্থির।তারা আমার সম্মতি না শুভাশিস তা আমার মনে নেই। পত্র পেয়ে আমি সত্যি হতভস্ব হয়ে গিয়েছিলাম। আলীিআকবর খানের বাড়িতে নজরুল পুরো দু’টি মাসও কাচালেন না, এরই মধ্যে একটি গ্রাম্য মেয়ের সঙ্গে তাঁর দেখা হলো, কথা হলে, পরিচয় হলো ভালোবাসা হলো তারপর একেবারে বিবাহ স্থির? সেই মেয়েটির কোন রূপগুনের কথা আমাকে কেউ কোন কিছু পত্রে লিখেনি। নজরুলের বন্ধু মহলের একজনও এমন বিয়ের কথা সমর্থন করলেন না, সকলে হায়! হায়! করতে লাগলেন।
সমিতির অন্যান্যরা বলতে লাগলেন- “সত্যিকার প্রেম জন্মালেও তো লোকে অপেক্ষা করে পরস্পরের মন বোঝানোর চেষ্টা করে। এমনকি মেয়েটির বাগদত্তা হওয়ার পরেও বছরের পর বছর অপেক্ষা করে। এমন হুট করে বিয়ে করতে তো কাউকে কখনো দেখিনি।”
আমি এ বিয়েতে অসম্মতি জানিয়ে খুব তীব্র ভাষায় একখানা পত্র লিখেছিলেম। আমি যে চটেছিলেম তাতে কোন সন্দেহ নেই। নজরুল কোন উত্তর দিল না, উত্তর দিল আলী আকবর খান। তিনি লিখেছেন- আমার পত্র মাথায় তুলে রেখে তিনি আর নজরুল নাকি নেচেছেন। আমার ঈত্র মাথায় তুলে রেখে যদি তারা নাচবেনই তাহলে বিয়ের প্রস্তাব বাতিল করে দেয়া উচিত ছিল। তা নাকরে বিয়ের নিমন্ত্রণ পত্র তারা বিভিন্ন জায়গায় পাঠিয়ে দিলেন। কলকাতার অন্যান্যরা বিয়ের আগে নিমন্ত্রণ পত্র পেয়েেিলন আর পেয়েছিলাম বিয়ের পর। ৩রা আষাঢ় বিয়ের বিয়ের তারিখ ছিল খ্রিস্টীয় হিসেবে ১৮ বা ১৯ জুন। আমি ভাবলাম নজরুল যখন বিয়ে করেই ফেলেছে তখন আর কি করা যাবে। আমার মন ধীরে ধীরে নরম হয়ে এলো।
আবার কোর চিঠি পত্র নেই, এবার ভাবলেম যে নজরুল বুঝি বিয়ের আনন্দে মেতে আছে, নাই বা দিল চিঠি। হঠাৎ যেন একদিন বজ্রপাত হলো। জুন মাসের শেষের দিকে আমি নজরুলের লেখা একখানা পোস্টকার্ড পেলাম। এতোদিনে তার ভাষা মনে থাকার কথা নয়, তবে মোদ্দা কথা যা মনে আছে তা হলো যে, সে আলী আকবর খানের দ্বারা প্রতারিত ও অপমানিত হয়েছে। তার ফলে সে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। পত্রের উপরের দিকে যে ঠিকানা দেওয়া আছে সেই ঠিকানায় যেন আমি কিছু টাকা পাঠিয়ে দেই। কুমিল্লা কান্দিপাড়াস্থিত ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাড়ি হতে এ পত্র খানা এসেছিল। সঙ্গে সঙ্গে আমি সাহিত্য সমিতির অফিসে, তার নামে মোসলেম ভারতেও খবরটা পৌছিয়ে দিলাম। সেখান থেকে তার খবরটা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। আমার হাতে টাকা ছিল না, আমি টাকা সংগ্রহে বার হলাম। একজন বন্ধু রাইটার্স বিল্ডিং এ শিক্ষা বিভাগে চাকার করতেন তার কাছ থেকে বিশ টাকা ধার করে নজরুলকে পাঠিয়ে দিলাম।
এদিকে নজরুলের বন্ধুরা ৩২নং কলেজ স্ট্রিটে জড়ো হলেন। সকলে আবার হায়! আফসোস করতে লাগলেন। পত্রে দেওয়া ঠিকানা দেখে পবিত্র গঙ্গোপ্যাধ্যায় বলল বাসাটা তার চেনা ও বাসার লোকজনকেও সে চেনে। কী ব্যাপার ঘটেছে তা জানতে চেয়ে সে সঙ্গে সঙ্গে বিরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্তকে একখানা পত্র লিখে ডাকযোগে পাঠিয়ে দিল। সকলে আলোচনা কওে স্থিও করলেন যে, একজণের কুমিল্লা গিয়ে নজরুলকে নিয়ে আসা উচিত। যাওয়ার ভারটা পড়ল আমার উপরে। আমি দু’টি অসুবিধার কথা জানালাম।প্রথম আপত্তি হলো গোয়ালন্দ হতে স্টীমার সার্ভিসে এবং আসাম-বেঙ্গল রেলওয়েতে তখন ধর্মঘট চলেছে। চব্বিশ ঘন্টার ভিতওে পুলিশ পাহারায় একখানা স্টীমার ও একখানা ট্রেন মাত্র চলে। এই ধর্মঘট অমান্য কওে আমি কি কওে কুমিল্লা যাব? আমার জন্য ২য় অসুবিধা ছিল যে আমার হাতে তখন কোন টাকা পয়সা নেই, তবুও আমি বিশ টাকা ধার কওে নজরুলকে পাঠিয়ে দিয়েছি। ধর্মঘট অমান্য করা ঠিক নয় এাঁ তারা বোঝেন কিন্ত প্রশ্ন হচ্ছে নজরুলের মতো একজন লোকের জীবন। তাঁকে যেমন করেই হোক কলকাতায় নিয়ে আসা উচিত। তাঁর অসুখ বেশী হলে ওখানে কি তার ভালো চিকিৎমা হবে? শেষ পর্যন্ত আমাকে রাজি হতে হলো, কিন্তু টাকা? টাকা কেউ বার করতে পারলেন না। আফজালুল হক সাহেবও না। তবে আফজালুল হক টাকার জন্য আমার সঙ্গে দু’চার জায়গায় ঘুরলেন। টাকা কেউ দিল না। সংস্কৃতি কলেজের দর্শন শাস্ত্রেও অধ্যাপক শ্রীফকিরদাস বন্দোপাধ্যায় শুনতে পেয়ে ত্রিশটি টাকা এনে আমার হাতে দিলেন।
আজ অনেকে আশ্চর্য হবেন যে ত্রিশ টাকা নিয়ে কোন ভরসায় আমি নজরুলকে আনার জন্য কুমিল্লা গিয়েছিলাম। ১৯২১ সালে রেলওয়ে ও স্টীমারের ভারা অত্যন্ত কম ছিল। তাছাড়া আমরা র্থাড ক্লাসের হিসেব করেছিলাম। কলকাতা হতে আমি রাত্রের ঢাকা মেইলে রওয়ানা হয়েছিলাম। কারণ সকালের চাটগা মেইলে গেলে স্টীমার পাওয়া যেত না। ট্রেন ছাড়ার কিছু আগে আফজালুল হক সাহেব ছুটতে ছুটতে এলেন। পবিত্র গঙ্গোপ্যাধ্যায় বিরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের পত্রের উত্তর পেয়েছিল। এই পত্র পড়ে ঘটনা সম্পর্কে কিছুটা ওয়াকিফহাল হয়ে আমি রওয়ানা দিয়েছিলাম। পথে আমাকে দু’রাত কাটাতে হয়েছিল।
৬ জুলাই, ১৯২১ সকাল বেলা শ্রীইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাসায় পৌছে দেখলাম নজরুল আঘাতের ধাক্কা সামলে নিয়েছে। ওই বাড়ির লোকদেও সেবা-যতœতো বটেই, বিশেষ কওে বিরজাসুন্দরী দেবীর ঐকান্তিক যতেœ ও ভিতর দিয়ে নজরুল আবার নিজেকে ফিরে পেয়েছিল। এ ব্যাপারে কুমিল্লা মহরের যুবকদেও অবদানও কম ছিল না। তারা নজরুলকে এতো বেশি ঘিওে রেখেছিল যে সে গুমড়ানোর কোন অবকাশ পাচি।চল না। তার উপর সে বিভিন্ন সভা ও মিছিলে যোগ দিয়েছিল। তার জন্য গান লিখেছিল, গান গেয়েছিল।
দু’রাত্রি শ্রীইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাসায় কাটিয়ে তৃতীয় দিন ৮ই জুলাই (১৯২১) তালিখে আমি নজরুলকে নিয়ে কলকাতার উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। কুমিল্লা হতে আনন্দময় স্মৃতি নিয়ে ফিরছিলাম। প্রমিলা ও কমলা বাড়িটিকে সঙ্গীত মুখর করে রেখেছিল। ছোট অঞ্জলি, সেও দেখলাম কম যায় না। যতটা মনে পড়ে আমরা কলকাতা পৌছেছিলেম ১০ই জুলাই সন্ধ্যার পর।
তার কয়েকদিন পরে নজরুল আর আমি থাকতে যাই তালতলা লেনের বাড়িতে। আগস্টমাসে না সেপ্টেম্বও মাসে ঠিক মনে নেই, তবে সেপ্টেম্বও মাসই হবে। একদিন সন্ধ্যার পর আলী আকবর খান আমাদের বাড়িতে আসেন। নজরুল আর আমি বাড়িতেই ছিলেম। আরও দু’একজন কে কে যেন উপস্থিত ছিলেন সেখানে। নজরুলের স্বভাব ছিল যে, নতুন কেউ এলে চেঁচিয়ে আনন্দ প্রকাশ করে তাকে গ্রহন করত। পাশের ঘরের লোকজনও বুঝতে পারত যে, নজরুলের নিকট বুঝি কেউ এলেন। সেদিন আলী আকবর খানের আসাতে কোন উচ্ছ¡াস প্রকাশ তো করলই না, একবার বসতেও বলল না তাকে। শক্ত হয়ে চুপ করে বসে রইল সে।
আজ এতকাল পরে “বাবা শ্বশুর ”মার্কা পত্র খানা পড়ে আমার মনে হচ্ছে যে, আলী আকবর খান যাদেও সেই পত্রখানা দেখিয়েছিলেন তাদেও একজন কেউ যদি সে সন্ধ্যায় আমাদেও তালতলা লেনের বাসায় উপস্থিত থাকতেন তাহলে বুঝতে পারতেন কি চিজ এই আলী আকবর খান। (কাজী নজরুল ইসলাম-স্মৃতিকথা-মুজফফর আহমদ পৃষ্ঠা-১১৪)
যাক আলী আকবর খান নিজেই নজরুলের পাশেযেয়ে তখ্ৎপোষকের উপরে বসলেন। তার হাতে বেশ পুরু একতাড়া দশ টাকার নোট ছিল। খুব নিচু আওয়াজে কথা বলছিলেন তিনি আর নোটের তাড়াটি নাড়ছিলেন-চাড়ছিলেন। অকারণে নাড়াচাড়ার মতো দেখালেও আসল ভাবনা ছিল এইযে, এই নোটের তাড়াটি তোমারই জন্য।
সেই সন্ধ্যায় আলী আকবর খান এসেছিলেন একটি সমঝোতার জন্য। তিনি বলতে এসেছিলেন, যা ঘটে গেছে তার সবকিছু ভুলে যাক নজরুল। আবার সে ফিওে চলুক, গ্রহণ করুক তার ভাগিনীকে। কিন্তু নজরুলের মন এমনভাবে ভেঙে গিয়েছিল যে তা আর কোন ভাবে জোড়া লাগানো সম্ভব হয়ে উঠেনি।
আলী আকবর খান কিছুতেই নজরুলের মন টলাতে পারল না। তাই খুব নিরাশ হয়েই সে দিন ফিওে গেলেন। যাবার সময় আমাকে তিনি বাইওে ডেকে নিয়ে গিয়ে একটা দীর্ঘ বক্তৃতা শুনিয়ে দিলেন। তার মোদ্দা কথা ছিল এই যে, আমার মেয়ে আছে, ভাইপো ভাইঝিরা আছে, তাদেও ষুখ-সুবিধার দিকে নজর দেওয়াই আমার কর্তব্য। নজরুলের পিছনে শক্তি ক্ষয় করা উচিত নয় আমার। (যেন নজরুলের কোন শক্তি ছিল না) দৃষ্টান্তস্বরূপ তিনি নিজেকে তুলে ধওে দেখালেন যে, নজরুল তাকে কিরকম ঠকিয়েছে। কি হয়েছে তা নিয়ে আমি রাস্তার আবহাওয়া দুষিত করতে চাইনি। কোন জবাব না দিয়ে সব কথা আমি শুধু শুনেই গেলাম। তারপর আলী আকবর খান চলে গেলেন। এটাই তার সাথে আমার শেষ দেখা।
পরের দিন, নজরুল বিরজাসুন্দরী দেবীকে লিখেছিলেন-'মা, আলী আকবর খান আমাকে নোটের তাড়া দেখিয়ে গেল'। এরপর নজরুলের সাথে চিরকালের জন্য আলী আকবরের বিচ্ছেদ ঘটেছিল। আর সেই বিচ্ছেদেও আগুনে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যায় নার্গিসের নজরুলকে পাবার ভবিষ্যত সম্ভাবণাও।
(কাজী নজরুল ইসলাম-স্মৃতিকথা-মুজফফর আহমদ পৃষ্ঠা-৯৫-৯৬)
এরপর শুরু হয় স্বপ্ন ভঙ্গের খেলা। সেই সম্পর্ক আর জোড়া লাগেনি। নজরুলের জীবনে নার্গিস পর্ব সেখানেই শেষ হয়ে যায়। নজরুলের বিষয় বৈরাগ্য বা দারিদ্র্য নিয়ে ‘বাড়ির দাসদাসীরাও ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ করতে ছাড়েনি। সেই প্রত্যাখ্যাত ভবঘুরের সঙ্গে নার্গিসের বিয়ে! আগে হয়তো এ সব বিষয় আমলে নেননি কিন্তু এখন নার্গিস দিশেহারা। নজরুলের গ্রামের বাড়ি চুরুলিয়ায় দালান কোঠা ছিল না কিন্তু সাধারণ গৃহস্থের উপযুক্ত বসতবাড়ি ছিল; নার্গিসকে সেখানে সসম্মানে রাখতে পারতেন নজরুল। নার্গিসের মামারা বিত্তশালী ছিলেন, নার্গিস অতটা নন। কলকাতায় বা কোথাও কষ্টে-শিষ্টে দু’জনে থাকতেও পারতেন। কিন্তু তা হয়নি। সম্পর্কটা শুরুতেই বিষিয়ে গেছে। নজরুলের হৃদয় অপমানের আগুনে জ¦লে পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে। কবি তাঁর ‘নিশীথ প্রীতম’ কবিতায় লিখেছেন-
মোদের দু’জনারেই জীবন ভরে কাঁদতে হবে গো-
মোরা কে যে কত ভালবাসি কোন দিনই হবে না বলা।
কভু সাহস করে চিঠির বুকেও আঁকবোনা সে কথা।
শুধু কইতে-নারার প্রাণ পোড়ানি বইবে
দোঁহার ভরে, বুকের তলা।’
রাত পোহাতে না-পোহাতে ঝরে পড়লো নিশি ভোরের নার্গিস। মুছে গেল হাতের মেহেদী। খসে পড়লো নাকের বেসর-নাকফুল। একবুক বেদনা নিয়ে নার্গিস যুগ যুগ ধরে চোখের জলে গাঁথে মালা। স্বপ্ন ভাঙা রাতের দুঃস্বপ্নে চোখের জলে ভেসে যায় বুক। গোমতীর উথাল পাথাল ঢেউয়ের দোলায় নার্গিসের বিরহ-ব্যথার চোখের জল বয়ে চলে অশ্রæমতির দেশে। নজরুলও নার্গিসের বিরহে ধূপের অনলে পুড়ে পুড়ে হয়েছেন অঙ্গার। দুজনের মাঝে মান-অভিমান, রাগ-অনুরাগ, বিরহ-বেদনায় লিখেছেন অশ্রæলিপি। কবি নিজেই লিখেছেন বিরহ বেদনার কথা ‘আড়াল” কবিতায় (আংশিক)
রূপের দেশের স্বপন-কুমার স্বপনে আসিয়াছিনু,
বন্দিনী! মম সোনার ছোঁয়ায় তব ঘুম ভাঙাইনু।
দেখ মোরে পাছে ঘুম ভাঙিয়াই,
ঘুম না টুটিতে তাই চলে যাই,
যে আসিল তব জাগরণ-শেষে মালা দাও তারই গলে,
সে থাকুক তব বক্ষে রহিব আমি অন্তর-তলে।
সন্ধ্যা-প্রদীপ জ্বালায়ে যখন দাঁড়াবে আঙিনা-মাঝে,
শুনিয়ো কোথায় কোন তারা-লোকে কার ক্রন্দন বাজে!
নার্গিস বিয়ের আগেই ভালোবাসার অধিকারে যাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে মনে প্রানে গ্রহণ করেছেন, সে তাকে ছেড়ে চলে গেছে। অন্তর বিধাতার কাছে সদা প্রার্থনা করেছেন তার মঙ্গলের জন্য। পথভোলা সে পথিক যেন ফিরে আসে তাই পথের দিকে চেয়েই রইলেন। ক্ষণিকের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত ক’রতে নার্গিস অনেক বছর দৌলতপুরেই ছিলেন। চিঠি লিখেও কবির কাছ থেকে সাড়া পাননি। শুধু পেয়েছেন কবিতার বাণী, বেদনার কাব্যমালা-“স্নেহের পরশ”
‘আমি এদেশ হ’তে বিদায় যেদিন নেবো প্রিয়তম,
আর কাঁদবে এ-বুক সঙ্গীহারা কপোতিনী সম,
তখন মুকুর-পাশে একলা গেহে
আমারি এই সকল দেহে
চুমবো আমি চুমবো নিজেই অসীম স্নেহে গো,
আহা পরশ তোমার জাগছে যে গো এই সে দেহে মম
কম সরস হরষ সম।
(পুবের হাওয়া-কাব্যগ্রন্থ)
তথ্যঋণ-
‘নজরুল প্রতিভা’ - মোবাশ্বের আলী
‘নজরুল প্রসঙ্গে’ - রফিকুল ইসলাম
‘নজরুল কাব্যসমীক্ষা’-–আতাউর রহমান
‘কেউ ভোলে না কেউ ভোলে’- শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
কাজী নজরুল ইসলাম “স্মৃতি কথা” কমরেড মুজাফফর আহম্মদ
‘কুমিল্লায় নজরুল স্মৃতি প্রেম ও পরিণয়’- তিতাশ চৌধুরী
“শৈশবের বন্ধু নজরুল” শৈলজানন্দ মুখোপ্যাধ্যায়ের (হরফ প্রকাশনী, কলকাতা ১৩৭৫)