কুমিল্লার দৌলতপুরে কবি নজরুল ও নার্গিস সম্পর্কে কিছু কথা- (১ম পর্ব)
মাজহারুল মোর্শেদ
কুমিল্লা কবি নজরুলের জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল। ঠিক এ সময়ে বাংলা সাহিত্যজগতকে তিনি অনেক মণি-মুক্তা দিয়ে পরিপূর্ণ করেছিলেন। কবিতা ও গান যেন যেন পরশ পাথরের মতো হয়ে ওঠে, এতটুকু নাড়াচাড়া করলে, একটু স্পর্শ করলেই বের হয়ে আসে নতুন নতুন কবিতা ও গান। কারণে-অকারণে নজরুল পাঁচ বারের মতো কুমিল্লায় আসেন। এখানেই তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন মা, খুঁজে পেয়েছিলেন হাজারও বন্ধু, খুঁজে পেয়েছিলেন হৃদয়ের গহীনে লুকিয়ে রাখার মতো দুর্লভ বস্তু, পেয়েছিলেন জীবন সঙ্গিনী নারী।
কবি নজরুলের জীবনে কুমিল্লার কোমলমতি মানবীরাই এসেছিলেন শুভও কল্যাণের প্রতিকরূপে, প্রিয়ারূপে, বঁধুরূপে। নার্গিস ও প্রমিলা বাংলা সাহিত্য গগনে উজ্জল নক্ষত্রের মত উদ্ভাসিত আলেঅর প্রতিক। যে আলোর পথে হেঁটে নজরুল পেয়েছিলেন পরশ পাথরের সন্ধান। যার ছোঁয়ায় তিনি সোনা ফলাতে পেরেছিলেন বাংলা সাহিত্য ও সঙ্গীতের অনুর্বর জমিতে। কবিতা ও গানে যোগ করতে পেরেছিলেন নতুন মাত্রা। এ কথা অনস্বীকার্য যে, কুমিল্লা নজরুলের জীবনে যতটা আপন হয়েছিল, যতটা প্রভাব ফেলেছিল, তাঁর জীবনব্যাপি অন্য কোথাও এমনটি হয়নি।
কবি নজরুল কুমিল্লার সামাজিক, রাজনৈতিক, সাহিত্য ও সংস্কৃতি প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রবেশ করে সকলের গ্রহণযোগ্যতা অর্জনের মাধ্যমে ভালোবাসা পেয়েছেন। কবি হিসেবে পরিচিত হয়েছেন সবার কাছে। রাজনৈতিক এবং সাহিত্য ও সংস্কৃতি এ যুগপৎ ধারায় কুমিল্লা জীবনে নানা চাঞ্চল্য, রোমান্স, সংগ্রাম, বিক্ষোপ ও দ্রোহের সৃষ্টি করেছিলেন। তবে এ কথা সত্য যে, নজরুল কুমিল্লায় যে মহীয়সী দু’জন নারীর সান্নিধ্য পেয়েছিলেন তাদের অনুপ্রেরণাই বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হয়েছে। নজরুলের সমগ্র অস্তিত্ব জুড়ে এক রকম নোঙ বাঁধা ছিল কুমিল্লার মাটিতে।
(কুমিল্লায় নজরুল স্মৃতি, প্রেম ও পরিণয়-তিতাশ চৌধুরী,)
নজরুল নিজেই নার্গিসকে বলেছেন- “তুমি এই আগুনের পরশমানিক না দিলে আমি ‘অগ্নিবীণা’ বাজাতে পারতাম না। আমি ধুমকেতুর বিস্ময় নিয়ে উদিত হতে পারতাম না”।
সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা সব মিলেই মানুষের জীবন। মানব জীবনে যেমন সুখর নদী আছে তেমনি বিষাদেরও সমুদ্র আছে। কবি নজরুল নিজেই বলেছেন- “রবীন্দ্রনাথ আমায় প্রায়ই বলতেন,”দ্যাখ উন্মাদ, তোর জীবনে শেলীর মত, কীটসের মত খুব বড় একটা ট্র্যাজেডী আছে, তুই প্রস্তুত হ’।”জীবনে সেই ট্র্যাজেডী দেখবার জন্য আমি কতদিন অকারনে অন্যের জীবনকে অশ্রæর বরষায় আচ্ছন্ন করে দিয়েছি। কিন্তু, আমারই জীবন রয়ে গেল বিশুষ্ক মরুভূমির মত দগ্ধ।” তবুও গহীন অন্ধকারে মাঝে মধ্যে সুখের প্রদীপ জ্বলে ওঠে। ভোরের আলো আর দক্ষিণা বাতাসে প্রাণ ভরে যায়।
কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদ ছিলেন নজরুল-সুহৃদ এবং ভারতীয় উপমহাদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। বাংলাদেশের স›দ্বীপে জন্মগ্রহণকারী এই নেতা কলকাতাকে রাজনৈতিক জীবন অতিবাহিত করেন। বয়সে অনেক বড় হলেও তিনি হয়ে ওঠেন নজরুলের ঘনিষ্ট বন্ধু ও সুখ-দুঃখের সঙ্গী। তিনি বলেন-“১৯১৩ সালে আমি নোয়াখালী জিলা স্কুল হতে ঢাকা কেন্দ্রে মেট্রিকুলেন পরীক্ষা দিতে গিয়েছিলাম। সেখানে কলেজ পড়–য়া অনেক ছাত্রের সঙ্গে আমার পরিচয় হয় তার মধ্যে আলী আকবর খানও ছিলেন। যতটা মনে পড়ে তিনি তখন ঢাকা কলেজের ফোর্থ ইয়ার ক্লাসে পড়তেন। আমার বিশ্বাস তিনি আমার চেয়ে বয়সে ছোট ছিলেন। কারণ আমি বেশি বয়সে ইংরেজি স্কুলে পড়তে গিয়েছিলাম। পরীক্ষ দিতে গিয়ে যে পরিচয় ঢাকা কলেজের ছাত্রদেও সাথে আমার হয়েছিল তা ছিল পয়ে ট্রেনের কামরায় যাত্রী আর যাত্রীতে পরিচয়ের মতো। গন্তব্য স্থলে পৌছানোর পরই অধিকাংশ যাত্রী একে অন্যকে ভুলে যান। আমার কিন্তু আলী আকবর খানের নামটি মনে ছিল। কারণ তার স্বভাবে বড়বেশি কৃত্রিমতা ও নাটকীয় ভাব ছিল। তার উপরে তিনি ইউরোপীয় পোশাক পড়তেন আর ইংরেজিতে ছাড়া কথা বলতেন না। এ সব বৈশিষ্টের কারণে তার নাম আমার মনে থেকে গিয়েছিল বটে, কিন্তু কোন যোগাযোগ তাঁর সঙ্গে আমার থাকে নি।”
(কাজী নজরুল ইসলাম-স্মৃতিকথা-মুজফফর আহমদ পৃষ্ঠা-৮৭)
কমরেড মুজাফ্ফর আহমদের ভাষায়- প্রয় ছয় বছর পর ১৯১৯ সালে আলী আকবর খানের সাথে আমার দেখা হয় কলকাতার ওয়েলিংটন স্ট্রিটের (এখন নাম নির্মল চন্দ্র স্ট্রিট) টেলর হোস্টেলে বদিউর রহমান সাহেবের ঘরে। তিনি আমার বন্ধু ছিলেন। যুক্ত বঙ্গে তিনি শিক্ষা বিভাগে এসিস্টেন ডিরেক্টর ছিলেন। ছয় বছর পর দেখা হওয়ায় প্রথমে আমি আলী আকবর খানকে চিনতে পারিনি, তবে খুব চেনা চেনা মনে হচ্ছিল। কারণ তিনি খোলস বদলে ফেলেছিলেন। এবার তিনি ধুতি ও খাকি সার্ট পড়েছিলেন, কথাও বাংলাতে বলছিলেন। নতুনভাবে পরিচয়ের পরে আমাকে উপলক্ষ্য করে তিনি ৩২ নম্বর কলেজ স্ট্রীটে “বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে” বেশ ঘণঘণ যাতায়াত শুরু করলেন। এরই মধ্যে প্রায় সকলের সাথে তার পরিচয়ও হয়ে গিয়েছিল। সাহিত্য সমিতির একখানা খালি ঘর ছিল একদিন দেখা গেল যে কাউকে কিছু না বলে তিনি ঐ ছোট ঘরটিতে তিনি বিছানা পেতে ফেলেছেন। সকলে স্তম্ভিত হলেন কিন্তু চক্ষু লজ্জার খাতিওে কেউ কিছু বললেন না। এভাবে কয়েকমাস কাটাবার পর দেখা গেল যে তিনি একটি খাবার ব্যাধিতে ভুগছেন। কয়েকদিন তাকে বিছানায় শুয়ে থাকতে হলো। ঠিক এই সময় কবি নজরুল আমাদের সঙ্গে থাকতে এলো। তার সঙ্গে আলি আকবর খানের পরিচয় হলো। কবি নজরুল এক সময় “বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিস” থেকে কিছুদিনের জন্য দেওঘরে চলে গিয়েছিলেন বেড়াতে। সেখান থেকে আবার সমিতির অফিসে আফজালুল হকের সঙ্গে আস্তানা গেড়েছিলেন। ঠিক পাশের ঘরেই তিনি থাকতেন। নজরুল তাকে এটা ওটা এগিয়ে দিতে লাগল, দোকান থেকে খাবারও এনে দিতে লাগল। অবশ্য কয়েক দিনের ভেতওে তিনি সুস্থ হয়ে চলাফেরা করতে লাগলেন।
আমরা দেখতাম যে আলী আকবর খান সম্রাট বাবরের জীবন নিয়ে একখানা নাটক লিখছেন। অর্থাৎ তার নিজের স্বভাবে যে শুধু নাটকীয়তা ছিল তাই নয়, তিনি একখানা নাটকও লিখে ফেলেছেন। তার লেখা তিনি আমায় পড়েও শোনাতেন আর আমাকে সেঠা ধৈর্য্য ধারণ করে শুনতে হতো। এরপর তিনি বিভিন্ন জিলার ছোট ছোট ভৌগলিক বিবরণ লিখে ছাপাচ্ছেন। এই বইগুলো পাঠ্যপুস্তকে তালিকাভুক্ত হতো না বটে শিক্ষকেরা ছেলেদের দিয়ে সে সব বই কেনাতেন এ জন্য যে আপন আপন জিলা সম্পর্কে ওয়াকিফহাল হতে পারবে। আলী আকবরের বড় ভাই আলতাফ আলী খান বইগুলি ক্যাভাস করে বিক্রি করতেন। তিনি প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। আলী আকবর খানের তৃতীয় কাজ হলো যে তিনি প্রথমিক স্কুলের পাঠ্য পুস্তক রচনার মশ্ক করতেন। তাঁর কথা বার্তা হতে বুঝতাম যে প্রাথমিক স্কুলের পাঠ্য পুস্তক লিখে বা প্রকাশ কওে তিনি একদিন বিত্তশালী হবেন। এ পুস্তকগুলোর জন্য কবিতা তিনি নিজে লিখতেন। সে যে কি অপূর্ব চীজ হতো তা প্রকাশ করা কঠিন।আমি ঠাট্টা করে তাকে বলতাম, কেন আপনি বাচ্চাগুলোর ভবিষ্যত নষ্ট করতে যাচ্ছেন? তার চেয়ে বরঞ্চ আমাকে কবিতা পিছু পাঁচটি করে টাকা দিন আমার কবিতা আপনার চেয়ে ভালো হরে। তিনি হাসতেন। কেননা আমি লিখলেও তা যে কবিতা হবে না সেটা তিনি ভালো করেই জানতেন।
আলী আকবর খানের কবিতা দেখে তা নজরুলের চক্ষুস্থির। সে তখন-তখনই খান সাহেবকে তারঁ বিখ্যাত “লিচুচোর” কবিতাটি লিখে দিল। এই কবিতা পেয়ে খান সাহেব আনন্দে উচ্ছ¡লিত হয়ে উঠলেন। পরে এই “লিচু চোর”ই নজরুলের জীবনে অনেক দুঃখের কারণ হয়েছিল। (কাজী নজরুল ইসলাম-স্মৃতিকথা-মুজফফর আহমদ পৃষ্ঠা-৮৯)
লিচু চোর- কাজী নজরুল ইসলাম (আংশিক)
বাবুদের তাল-পুকুরে
হাবুদের ডাল-কুকুরে
সে কি বাস করলে তাড়া,
বলি থাম একটু দাঁড়া।
নিজের স্বার্থ হাসিলের একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ছিল আলী আকবর খানের মনে। নিজে তিনি শিশুপযোগী বই লিখে প্রকাশ করতেন এবং তাঁর বড় ভাই আলী আফজাল সেগুলো ক্যানভাস করে বিক্রি করতেন। নজরুল এই আলী আকবরকে ‘লিচু চোর’ নামে একটি কবিতা লিখে দিয়েছিলেন শিশুপযোগী বইয়ে প্রকাশ করার জন্য। চমত্কার পদ্যটি পড়েই আলী আকবর খান এই তরুণ কবির প্রতিভার প্রকৃত পরিচয় পেয়েছিলেন। এই পদ্য ভালো লাগার পর থেকে নজরুলকে হাত করার জন্য উঠেপড়ে লাগেন আলী আকবর। নজরুলকে তাঁর বাড়িতে আমন্ত্রণ জানানোর পরিকল্পনা এখান থেকে তৈরি হয়।
কমরেড মুজাফ্ফর আহমদের ভাষায়- “একদিন আলি আকবর খান কবি নজরুলকে ধ’রে বললেন- “চলুন কাজী সাহেব, আমার সঙ্গে আমাদের দেশে। আমাদের বাড়িতে দিন কয়েক থেকে আসবেন।” এ প্রস্তাব খোলাখুলি করা হয়েছিল, গোপন নয়। নজরুল তার অন্য বন্ধুদের সঙ্গে এ বিষয়ে কি পরামর্শ করেছিল তা আমি জানিনে, তবে সে আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল যে আলী আকবর খান তাঁদের বাড়ি যাওয়ার জন্য তাকে অনুরোধ করেছেন, আমার কি মত? আমি তাকে বলেছিলেম-
দেখ ভাই, আমার পরামর্শ যদি শুনতে চাও তবে তুমি কিছুতেই আলী আকবর খানের সঙ্গে তাদেও বাড়িতে যেও না। তিনি অকারণে অনর্গল মিথ্যা কথা বলে যান, যেন অভিনয় করছেন এইরকম একটা ভাব তার কথা বার্তাও ভিতর দিয়ে সর্বদা প্রকাশ পায়। কি মতলবে তিনি তোমায় তাদেও বাড়িতে নিয়ে যেতে চান তা কেউ জানে না। তিনি তোমাকে একটা বিপদেও ফেলতে পারেন। আত্মভোলা নজরুল শেষ পযর্ন্ত একদিন আমাকে না বলেই আলি আকবর খানের সঙ্গে চলে গেলো। (কাজী নজরুল ইসলাম-স্মৃতিকথা-মুজফফর আহমদ পৃষ্ঠা-৯০)
কুমিল্লার মুরাদনগর থানার দৌলতপুর গ্রামে আলী আকবর খানদের বাড়িতে যাওয়ার পথেই নজরুল ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাসায় উঠেছিলেন। ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্ত ছিলেন ত্রিপুরা জেলার কোর্ট অব ওয়ার্ডসের ইন্সপেক্টর। আলি আকবর খান, কুমিল্লা জেলা স্কুলে ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের একমাত্র ছেলে বীরেন্দ্র কুমার সেনগুপ্তের সহপাঠি। সেই সূত্রে- বীরেন্দ্র কুমার সেনের সঙ্গে তাদের বাসায় যাতায়াতের ভিতর দিয়ে বীরেন্দ্র কুমার সেনের মাতা শ্রীযুক্ত বিরজা সুন্দরী দেবীর ¯েœহের পাত্র হয়ে ওঠেন। বীরেন্দ্র কুমার সেনের সাথে তার মাতা শ্রীযুক্ত বিরজা সুন্দরী দেবীকে তিনিও ‘মা’ বলে সম্বোধন করতেন। এ জন্য আলি আকবর খান নজরূলকে নিয়ে তার বন্ধুর বাড়িতে যাত্রা বিরতি করেন। ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাড়িতে ছিল স্ত্রি শ্রীযুক্ত বিরজা সুন্দরী দেবী, একমাত্র ছেলে বীরেন্দ্র কুমার সেন, তার দুই মেয়ে কমলা ও অঞ্জলি, ভ্রাতুষ্পুত্র বসন্ত কুমার সেনগুপ্তের বিধবা স্ত্রি গিরিবালা দেবী ও তাঁর মেয়ে আশালতা ওরফে দোলন বা দুলি। ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের ভ্রাতুষ্পুত্র বসন্ত কুমার সেনগুপ্ত ত্রিপুরায় নায়েব পদে চাকরি করতেন। তিনি পরিবার নিয়ে মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার তেওতা গ্রামের বাড়িতে অবস্থান করতেন। হঠাৎ বসন্ত কুমারের মৃত্যুতে গিরিবালা দেবী অসহায় হয়ে পড়লে তার কাকা ইন্দ্র কুমার তাদেরকে কুমিল্লার কান্দির পাড়ে নিয়ে যান। কাজী নজরুল ইসলাম, আলী আকবর খানের সঙ্গে কুমিল্লায় বেড়াতে আসলে ইন্দ্র কুমার সেনগুপ্তের বাড়িতে আশালতার সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। পরিবারটি তেমন স্বচ্ছল অবস্থায় ছিল না। কিন্তু তাতে সাহিত্য ও সঙ্গীতের আবহাওয়া বিরাজ করত। রাজনৈতিক আবহাওয়াও এ পরিবাওে ছিল। বিরেন্দ্র কুমারের জ্যেঠতুত বোন আশালতা ও আপনবোন কমলা অসযোগ আন্দলনে সাড়া দিয়ে ফয়জুন্নেসা গার্লস হাইস্কুলে (গভর্নমেন্ট স্কুল) ছেড়েছিল। আমি সঠিক মনে রাখিনি, হয়তো অসহযোগ আন্দলনের ডাকে বীরেন সেনও কোন স্কুলের শিক্ষকতা ছেড়েছিলেন।
কবি নজরুল অতি অল্প সময়ের মধ্যে পরিবারের সবার সাথে মিশে গিয়েছিল। বিরজা সুন্দরী ও গিরিবালা দেবীর আদর যতœ ও ¯েœহ-মমতায় নজরুল মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল। বিরজাসুন্দরীর স্নেহে আপ্লুত হয়ে নজরুলও তাঁকে ‘মা’ বলে সম্বোধন করেন। নজরুল তার কবিতা আবৃত্তি ও গানে সেন বাড়ির পরিবেশকে কলমূখর করে তুলেছিল। শহরের যুবকেরা গান শোনার জন্য বাড়িতে এসে ভিরড় জমাতে শুরু করল। নজরুল কমলা, অঞ্জলি, সকলেরই প্রিয় কবিদাদা হয়ে উঠল। এই মোহময় পরিবেশে চার-পাঁচ দিন কাটিয়ে ২৩ চৈত্র, (৬ এপ্রিল ১৯২১) কবি নজরুল দৌলতপুরে চলে যান আলী আকবর খানের বাড়িতে”।
দৌলতপুরে নজরুলের জন্য আলী আকবর খানের নির্দেশে উষ্ণ অভ্যর্থনার ব্যবস্থা করা হয়। নির্মান করা হয় তোরন। আলী আকবর খানদের বনেদী বাড়ি, সামনে আলিশান অট্রালিকা, এই অট্রালিকার নাম “আলী আকবর খান মেমোরিয়াল” এর ডান পাশে নানান রকম বৃক্ষের সারি, বাঁ পাশে রান্নাঘর, বিশাল শান বাঁধানো পুকুর। পুকুরের পশ্চিম পাড়েই ছিল বৈঠকখানা ঘর। এটি ছিল ছনের ছাউনি যুক্ত বিশাল আকারের চৌচালা ঘর। সৌখিনতার উত্তম প্রতিক রূপে বাঁশ বেতের নিপুণ কারুকার্যে নির্মিত ছিল এর চারিদিকের বেড়াগুলো। বৈঠকখানা ঘেঁষে ছিল সৌখিন বিলাশী ফুলের বাগান। নানা রকম ফুলের গাছে সাজানো ছিল বাগানটি। কবি নজরুল এসে বাগানের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে বৈঠকখানায় রাত যাপনের ইচ্ছা পোষণ করেন। সেই থেকে যতদিন খাঁ বাড়িতে ছিলেন এঘরেই ছিলেন।
বাড়ির জ্যেষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনদের সাথে নজরুল খুব দ্রæতই ঘনিষ্ট হয়ে উঠেন। তাদের কবিতা শুনিয়ে, অজ¯্র গান গেয়ে মুগ্ধ করে ফেলেন। দূরদুরান্ত থেকেও লোকেরা আসত কবিকে দেখতে, তার গান শুনতে। কবি নজরুল মূলত বেড়াবার উপলক্ষেই দৌলতপুরে এসেছিলেন এবং এখানে প্রায় আড়াই মাসের মতো অবস্থান করেছিলেন। বলতে হয় ভবঘুরে নজরুল আলি আকবর খানের কবাড়িতে বেশ আদর-যতœ ও সমাদরে দিন কাটাচ্ছিলেন।
দৌলতপুরে আলি আকবর খানের বাড়ির সামনে দুটি বড় আম গাছ ছিল। নজরুল এ আমগাছের নিচে বসে নিঝুম দুপুর, জোৎ¯œা রাতে একাকী মনে বাঁশি বাজাতেন। এই আমগাছের পাশেই ছিল কামরাঙ্গা, কামিনী, কাঠাঁল গাছের সারি। এখানে কবি নজরুল খাঁ বাড়ির ও গ্রামের ছেলে মেয়েদেরকে গান, বাদ্য শেখাতেন।
খাঁ বাড়িতে ছিল দৈর্ঘ্য-েপ্রস্থে অনেক বড় একটি পুকুর। তার সামনের দিকটায় রয়েছে একটি শান বাঁধানো ঘাট। এই পুকুরে নজরুল ঘণ্টার পর ঘণ্টা সাঁতার কাটতেন। সাঁতার কাটতে কাটতে গান গাওয়া ছিল তাঁর সখ। একবার পুকুরে নামলে উঠবার নামও করতেন না। নজরুল সাবানের পর সাবান মেখে পুকুরের পানি সাদা করে ছোট মনিদের নিয়ে লাই খেলতেন, ডুব দিয়ে তাদেরকে কলের গান শোনাতেন। কবি শখ করে জাল কিংবা পলো দিয়ে পুকুরে মাছও ধরতেন। পুকুরটি আজও কবি নজরুলের সে আনন্দময় স্মৃতিকে উদয়াস্ত ধরে রেখেছে।
পুকুর পাড়ে আম গাছের তলায় ‘এখতেখারুন্নেছা’ (আলী আকবর খাঁ’র নিঃসন্তান বোন এফতেখারুন্নেছা যাকে নজরুল মা ডাকতেন) খাবার নিয়ে এসে ডাকতেন ‘আয় নুরু, খেতে আয়!’ নজরুল তখন ভদ্র ছেলের মত গোসল সেরে খেতে আসতেন।
কবির শয়নকক্ষের সংলগ্ন ছিল একটি প্রাচীন কামরাঙ্গা গাছ, যা তার অনেক কবিতা, গানে, হাসি-কান্না, মান অভিমান এবং মিলন বিরহের নীরব স্বাক্ষী। কবি মাঝে মধ্যে, বিশেষ করে দুপুরে এই গাছটির শীতল ছায়ায় বসে আপন মনে গান গাইতেন, গান রচনা করতেন। একটি কামরাঙ্গা গাছে একটি ফলক লাগানো রয়েছে। কবি এ গাছকে নিয়েই লিখেছেন- (আংশিক)
‘কামরাঙ্গা রঙ্গ লোকের পীড়ন থাকে,
ঐ সুখের স্মরণ চিবুক তোমার বুকের,
তোমার মান জামরুলের রস ফেটে পড়ে,
হায় কে দেবে দাম।’
সুদর্শন যুবক, ‘ঝাকড়া চুল। সারা দিন হাসি খুশীতে মেতে থাকতেন। অন্যদের মজিয়ে রাখতেন। গান গাইতেন। গ্রামের ছেলেমেয়েদেরও গান শেখাতেন। কখনো কখনো জ্যোৎস্না রাতে বাশীতে সুর তুলতেন। দৌলতপুর কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর থানার নিভৃত এক অজপাড়াগ্রাম। দৌলতপুরে এসে কবি তাঁর স্বভাব সুলভ গান গেয়ে, বাঁশি বাজিয়ে, হো হো করে অট্টহাসি হেসে জয় করলেন খান পরিবারের ছোট-বড় সবার মন। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা ঘিরে ধরল কবিকে। কবি ছোটদের উদ্দেশ্য করে লিখলেন- ‘হার মানা হার’ কবিতাটি-(আংশিক)
তোরা কোথা হতে কেমনে এসে
মণি-মালার মতো আমার কণ্ঠে জড়ালি।
আমার পথিক-জীবন এমন করে
ঘরের মায়ায় মুগ্ধ করে বাঁধন পরালি।
আমায় বাঁধতে যারা এসেছিল গরব করে হেসে
তারা হার মেনে হায় বিদায় নিল কেঁদে,
তোরা কেমন করে ছোট্ট বুকের একটু ভালোবেসে
ওই কচি বাহুর রেশমি ডোরে ফেললি আমায় বেঁধে!
(দৌলতপুর, কমিল্লা- বৈশাখ-১৩২৮)
আলী আকবর খানের বড় বোন ‘আসমাতুন্নেসা’র বিয়ে হয়েছিল খাঁ বাড়ির পাশেই মুন্সি আবদুল খালেকের সাথে। আলী আকবর খানের বাড়ি থেকে মুন্সি আবদুল খালেকের বাড়ির দূরত্ব প্রয় এক কিলোমিটারের মতো হবে। মুন্সি আবদুল খালেক সৈয়েদা খাতুন নামে একটি মেয়ে রেখেই মৃত্যুবরণ করেন। সৈয়দা খাতুনের ডাকনাম দুবরাজ। মামারা সোহাগ করে ডাকতেন যুবরাজ, যুবী বলে। যুবীর বয়স ষোল, দেখতেও অপরূপ সুন্দরী। বাড়ির পাশে প্রাইমারী স্কুল থেকে যুবী ১৯২০ সালে উচ্চ প্রাথমিক পাশ করেন। হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাইতেও শিখেছিলেন।
নজরুল-নার্গিসের প্রথম স্বাক্ষাৎকার সম্পর্কে নার্গিস নিজেই বলেন-“১৩২৮ এর ২২ বোশেখ আমার বড় ভাই মুনশি আব্দুল জব্বারের বিয়ে হয় আমাদেও বাড়িতে আমার এক মামাত বোর আম্বিয়া খানম মানিকের সঙ্গে। সেই বিয়েতে আমি গিয়েছিলাম এবং গানও গিয়েছিলাম। সেই থেকে নজরুলের সাথে আমার পরিচয়”।
নার্গিসের সাথে নজরুলের আলোচনার সূত্রপাত তাঁর বাঁশি বাজানোকে কেন্দ্র করে। এক রাতে কবি নজরুল খাঁ বাড়ির দীঘির ঘাটে বসে বাঁশি বাজাচ্ছিলেন, সেই বাঁশি সুরে মুগ্ধ হয়ে যান নার্গিস। পরদিন নজরুলকে এসে শুধান, “গত রাত্রে আপনি কি বাঁশি বাজিয়েছিলেন? আমি শুনেছি”। এই পরিচয় থেকেই ঘটে পারস্পারিক অন্তরঙ্গতা ও প্রণয়ের সূত্রপাত। তখন নজরুলের বয়স ২২ আর সৈয়দা খাতুনের বয়স ১৬। হয়তো তারুণ্যের ভাবাবেগে নজরুল সেই অপুর্ব সুন্দরী যুবতি মেয়ের প্রতি আকৃষ্ট হবেন এটাই স্বাবাভিক ব্যাপার। তাঁর আচার আচরণে নার্গিসের প্রতি অনুরাগ প্রকাশ পেতে থাকল। কবি নজরুল সৈয়দা খানমের নাম দিলেন ‘নার্গিস আসার খানম’। ফার্সীতে নার্গিস হচ্ছে- ইরানী গুল্মবিশেষ। এই গুল্মে অতি সুগন্ধি সাদা ফুল ফোটে। ইরানের কবিদের কাছে এই গুল্ম ও ফুল খুবই প্রিয়। নার্গিস কবির দেয়া এই নামটি খুবই পছন্দ করেন। এভাবেই প্রেমের সূত্রপাত।
দৌলতপুর কবি নজরুল জীবনে এক বিচিত্র অধ্যায়। দৌলতপুরে এসেই নজরুলের সঙ্গে নার্গিসের পরিচয় হয়। সেই পরিচয় সূত্র ধরে ঘটে প্রণয় আর এই প্রণয় পরিণত হয় পরিণীতায়। যৌবনে কবি নার্গিসের প্রেম-পরশে হয়েছিলেন আবিষ্ট। বাঁধন-হারা কবি বাঁধা পড়েন নার্গিসের মায়ার জালে। তাঁরই আভাস কবির ‘মানসবধূ’ কবিতায় ফুটে ওঠে-(আংশিক)
যেমন ছাঁচি পানের কচি পাতা প্রজাপতির ডানার ছোঁয়ায়,
ঠোঁট দুটি তার কাঁপন-আকুল একটি চুমায় অমনি নোয়ায়।
জল-ছলছল উড়ু-উড়ু চঞ্চল তার আঁখির তারা,
কখন বুঝি দেবে ফাঁকি সুদূর পথিক-পাখির পারা,
নিবিড় নয়ন-পাতার কোলে,
গভীর ব্যথার ছায়া দোলে,
মলিন চাওয়া (ছাওয়া) যেন দূরের সে কোন্ সবুজ ধোঁয়ায়।
(দৌলতপুর, কমিল্লা- বৈশাখ-১৩২৮)
নজরুল খানবাড়ির পুকুর পাড়ে বসে মনের আনন্দে বাঁশের বাঁশিতে সুর তুলতেন। এক নিশুতি রাতে নজরুলের বাঁশের বাঁশির সুর শুনে ষোড়শী নার্গিসের হৃদয়ে জাগে দোলা, বুকের স্পন্দন বেড়ে যায়। নার্গিস নজরুলের প্রতি আকৃষ্ট হন। কৃষ্ণের জাদুকর মন ভোলানো বাঁশির সুরে যেমনি ভাবে রাধা আত্মহারা হয়েছিলেন, তেমনিভাবে নার্গিসও নজরুলের বাঁশির সুর-সুধায় হয়েছিলেন বিমোহিত। নজরুলের প্রেম কাননে ফোটে নার্গিস ফুল। বোশখ মাসের তপ্ত দুপুর বাড়ির সবাই হয়তো আলস্য ঘুমের ঘোরে মগ্ন। নার্গিসও তাদেও দলে ছিল কিন্ত পুকুর পাড়ে আমগাছের শীতল ছায়ায় বসে বাসিতে সুর আনার চেষ্টায় ব্যাকুল কবি নজরুল। নার্গিসের কানে সে সুর যেন আগমনি ধ্বনি হয়ে বাজতে থাকে, তার সবকিছুকে উলট-পালট করে দেয়। সে মোহনীয় সুর যেন তার শিরায় উপশিরায়, ধমনিতে প্রবেশ করে তাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে তার দেহ থেকে। নার্গিস ছুটে আসে গাছের তলে, কোন প্রকার শব্দ না করেই দাঁড়িয়ে থাকে ঠিক তাঁর পিঠ বরাবর। নজরুলও বাঁশিতে এতটাই মগ্ন ছিল যে, নার্গিস কখন এসে তাঁর পিছনে দাঁড়িয়েছে টেরই পায়নি সে। গাছের ডালে বসা একটি বেরসিক পাখির ভারে ছোট্ট একটি শুকনো ডাল ভেঙে নার্গিসের মাথার উপর পড়ে যায়, অমনি সে মৃদু শব্দ করে আঁৎকে ওঠে। সেই আঁৎকে ওঠার শব্দে নজরুলের ধ্যান ভেঙে যায়, পিছন ফিরে তাঁকিয়ে দেখে ঠিক তার কাঁধ বরাবর একেবারে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে নার্গিস। কারও মুখে কোন কথা নেই। রাজ্যের সব নীরবতা এসে যেন মৌন আবেশে জড়িয়ে রেখেছে তাদেরকে। নার্গিস একটা মুচকি হাসি দিয়ে দ্রæত সেখান থেকে প্রস্থানের সুযোগ খুঁজে। তার আগেই নজরুল বলে ফেলে, এমন আলস্য ঘুমের ব্যাঘাত ঘটানোর অপরাধ থেকে মুক্তির কোন পথ আমার জানা নেই। উত্তরটা যদিও নার্গিসের খুব জানা শোনার মধ্যেই পড়ে কিন্তু তা প্রকাশ করার ভাষা নেই। তাই সে এতটুকু নড়াচড়া না করে ঠিক নিষ্প্রাণ পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল। তার ওষ্ঠ কম্পনের শব্দে যেন চারিদিকের প্রবহমান বাতাস প্রকম্পিত হচ্ছে। অস্ফুটিত হৃদয়ের আর্তনাদে দুরুদুরু কাঁপছে বুক। তবুও বুকের ভেতর যতটা শক্তি সঞ্চয় করা যায় তার সবটকিি একসাথে জড়ো করে বলল- আসি। প্রেমিক কবি প্রেমময় রূপসী প্রেয়সীর মনের গোপন কথা ব্যক্ত করলেন নিজের লেখা ‘কার বাঁশী বাজিল’ কবিতায়-(আংশিক)
‘কার বাঁশি বাজিল
নদী-পাড়ে আজি লো?
নীপে নীপে শিহরণ কম্পন রাজিল
কার বাঁশী বাজিল?
বনে বনে দূরে দূরে
ছল ক’রে সুরে সুরে
এত ক’রে ঝুরে’ ঝুরে’
কে আমায় যাচিল?
পুলকে এ-তনু-মন ঘন ঘন নাচিল।
(দৌলতপুর, কমিল্লা- বৈশাখ-১৩২৮)
কবি নজরুল যখন বিকেল বেলায় একসঙ্গে গাছের ছায়ায় বসে কবিতা ও গান রচনা করতেন। নার্গিস তখন নানা কাজের ছলে ছুটে আসতেন এই গাছের নীচে। অবলা হৃদয়ের অব্যক্ত কথাগুলো হয়ত মুখফুটে প্রকাশ কর করতে না পারলেও তা অভিব্যক্তিতে প্রকাশ পেত। আর এটাই হতো কবির ‘গিনিপিক’ যা দিয়ে ঠিক মনের কথাগুলো সাজিয়ে গুছিয়ে লিখে ফেলতেন পাতার পর পাতা। প্রিয়ার ডাগর চোখের ইশারায় যেন আকাশ কাঁপে, বাতাশ দোলে। সে দোদুল্যমান হৃদয়ের ভাষায় কবি প্রিয়ার চোখের ভাষায় ভাবময় করে তুলতেন তাদের হৃদয় লোকে।
কবির বুকের স্বপ্নগুলো লেখা অবিনাশী কবিতা। দৌলতপুর থাকাকালে নজরুল যেসব গান আর কবিতা লিখেছেন, এসব গান ও কবিতার বিষয়জুড়ে ছিল শুধুই নার্গিস। কবি নজরুল নার্গিসের প্রেমে আত্মহারা হয়ে প্রেম-প্রেয়সী নার্গিসকে নিয়ে লিখলেন-(আংশিক)
‘অচকিতে পথের মাঝে পথ ভোলানো পরদেশীকে,
হানলে দিঠি পিয়াস জাগা পথভোলা এই উর্বশীকে।
শূন্য তাহার কন্যা হিয়া
ভুবন বধূর বেদন নিয়া
জাগিয়ে গেল পরদেশিয়া বিধূর মধুর ব্যথা।’
কবি নজরুল তাঁর লেখা কবিতা, গান, গজল, গল্প, উপন্যাস দিয়ে একজন যোগ্য কবির আসন অলঙ্কৃত করেছেন। বলা বাহুল্য তাঁর অধিকাংশ লেখার মাঝে বেজে ওঠে কুমিল্লার সুর। অর্থাৎ কুমিল্লার কবি প্রিয়া নার্গিসের সুর। কুমিল্লর দৌলতপুরে কবি প্রিয়া নার্গিসকে নিয়ে কবি নজরুলের যে সকল স্মৃতি হৃদয়ের গহীনে ভেসে বেড়াত ঠিক তারই প্রতিফলন ঘটত তাঁর কবিতায়, গানে। কুমিল্লর দৌলতপুওে এসে কবিতায়, গানে সবার মন জয় করে নিয়েছেন নজরুল। তিনি বাঁশি বাজিয়েছেন, গান গেয়েছেন, অভিনয় করেছেন, আড্ডা দিয়েছেন, এমন কি স্বদেশের জন্য, মানুষের মুক্তির জন্য আন্দোলন করেছেন, মিছিল করেছেন সে মিছিলে গ্রেপ্তার হয়ে কারাববণও করেছেন। পশ্চিম বঙ্গেও সুদূর চুরুলিয়া অজগ্রাম থেকে কুমিল্লায় এসে কি কাÐটাই না করে গেছেন।
দৌলতপুরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে বুড়ি নদী ও আটি নদী। এখানে তিনি সাঁতার কেটেছেন।
নজরুল মাঝেমধ্যে পুকুর পাড়ে আমগাছের শীতল ছায়ায় বসে বাঁশি বাজাতেন। নার্গিসের কানে সে সুর যেন আগমনি ধ্বনি হয়ে বাজতে থাকে, তার সবকিছুকে উলট-পালট করে দেয়। সে মোহনীয় সুর যেন তার শিরায় উপশিরায়, ধমনিতে প্রবেশ করে তাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে তার দেহ থেকে। নার্গিস ছুটে আসে গাছের তলে। প্রিয়ার ডাগর চোখের চাহনীতে নিজেকে হারিয়ে কবিতায় প্রকাশ করে। তিনি লিখে ফেলেন “মনের মানুষ” কবিতাটি-(আংশিক)
ফিরনু যেদিন দ্বারে দ্বারে কেউ কি এসেছিল?
মুখের পানে চেয়ে এমন কেউ কি হেসেছিল?
অনেক তো সে ছিল বাঁশি,
অনেক হাসি, অনেক ফাঁসি,
কই কেউ কি ডেকেছিল আমায়, কেউ কি যেচেছিল?
(দৌলতপুর, কমিল্লা -আষাঢ়-১৩২৮)
কবির এই পল্লী-বালিকার নাম সৈয়দা কিন্তু কবি তাকে এই নামে ডাকতেন না। ডাকতেন, ইরানী ফুল নার্গিস নামে। এই নার্গিস ফুলই পরবর্তীতে কবির হদয়-বাগান সুরভিত করেছিল। কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর উপজেলার কোম্পানীগঞ্জ-নবীনগর রোডের পাশে দৌলতপুর গ্রাম। গ্রামের নাম দৌলতপুর হলেও কবি কাজী নজরুলের আগমনের কারণে যোগ হয়েছে কবিতীর্থ। তাই কবিতীর্থ দৌলতপুর নামে আশপাশের গ্রামের লোকেরা চেনে।
নার্গিস আসার খানমের সাথে কাজী নজরুল ইসলামের পরিচয়, প্রণয়, পরিণয় খুবই সল্পসময়ের মধ্যে ঘটলেও এ আনন্দ-বিরহের ঘটনা কেবলমাত্র নার্গিস-নজরুলের ব্যক্তিজীবনেই নয় পরবর্তীতে তা নজরুল-সাহিত্য এবং নজরুল-গবেষণার ক্ষেত্রেও যথেষ্ট প্রভাব ও অভিঘাত সৃষ্টি করেছে। এমন পরিস্থিতিতে নজরুল ‘হারা মণি’ নামে একবিতাটিলিখে-(আংশিক)
‘হারা-মণি’
এমন করে অঙ্গনে মোর ডাক দিলি কে স্নেহের কাঙালি!
কে রে ও তুই কে রে?
আহা ব্যথার সুরে রে,
এমন চেনা স্বরে রে,
আমার ভাঙা ঘরের শূন্যতারই বুকের পরে রে।
দৌলতপুর, কমিল্লা, বৈশাখ-১৩২৮
ছান্দসিক কবি আব্দুল কাদির সম্পাদিত “নজরুল রচনাবলী” থেকে দৌলতপুরে নার্গিসকে উদ্দেশ্য করে অনেক কবিতা-গান রচনা করেছেন। এ কবিতা-গানগুলোর ভেতরে যে কেহ প্রবেশ করলে সহজেই এর রূপ-রস-স্বাদ-গন্ধ ও স্পর্শ অনুভব করতে পারবেন। এগুলো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের কোন দরকার আছে বলে আমি মনে করি না। প্রত্যেকটি কবিতায় হৃদয়ের আকুলতা, প্রেম-ভালোবাসা, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, মান-অভিমানের চিত্র ফুটে উঠেছে। নজরুল তার নিঃসঙ্গতায়, একাকিত্বে, আধো জোৎস্না কিংবা উদাস দুপুরে পুকুর পাড়ে গাছের ছায়ায় বসে তাঁর মানষপটে নার্গিসের উপস্থিতিকে অনুভব করে কল্পলোকে নিজেকে ভাসিয়ে লিখতে থাকেন গান, কবিতা। যে কবিতায়-গানে থাকে প্রিয়ার উপস্থিতি- “পাপড়ি খোলা” (আংশিক)
রেশমি চুড়ির শিঞ্জিনীতে রিমঝিমিয়ে মরম-কথা
পথের মাঝে চমকে কে-গো থমকে যায় ঐ শরম-নতা ।।
কাঁখ-চুমা তার কলসি-ঠোঁটে
উল্লাসে জল উলসি' ওঠে,
অঙ্গে নিলাজ পুলক ছোটে
বায় যেনো হায় নরম লতা ।।
(দৌলতপুর, কমিল্লা -বৈশাখ-১৩২৮)
কুমিল্লার দৌলতপুর গ্রামে কবির জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় কিছু সময় কেটেছিল। এখানকার নারীর মমত্ববোধ ও ভালবাসা তার বিদ্রোহী মানসপটে প্রেমিক কবির বিমূর্ত ছবি এঁকে দিয়েছিল। কুমিল্লায় ও দৌলতপুরে না এলে নজরুলের কবিজীবন ও প্রেমিকজীবন হয়ত পরিপূর্ণ হত না। দৌলতপুর আসার কারণে নজরুলের জীবনে এক নতুন অধ্যায় সূচিত হয়েছিল, তার সাহিত্য চর্চায় যোগ হয়েছিল নতুন মাত্রা। এখানে এসেই নজরুল হয়ে গিয়েছিলেন প্রেমের কবি। নার্গিস নামে এই গ্রামের এক তরুণী তার জীবনের গতিপথ বদলে দিয়েছিল। নার্গিসকে প্রথম দেখার পরই বিদ্রোহী কবির মাঝে প্রেমিক কবির আবির্ভাব ঘটেছিল। তাই তো তিনি লিখেছেন ‘এক অচেনা পল্লী- বালিকার কাছে এত বিব্রত আর অসাবধান হয়ে পড়েছি, যা কোন নারীর কাছে হয়নি।’ “বিদায়-বেলায়” (আংশিক)
তুমি অমন ক’রে গো বারে বারে জল-ছল-ছল চোখে চেয়ো না,
জল-ছল-ছল চোখে চেয়ো না।
ঐ কাতর কন্ঠে থেকে থেকে শুধু বিদায়ের গান গেয়ো না,
শুধু বিদায়ের গান গেয়ো না।।
হাসি দিয়ে যদি লুকালে তোমার সারা জীবনের বেদনা,
আজো তবে শুধু হেসে যাও, আজ বিদায়ের দিনে কেঁদো না।
(দৌলতপুর, কমিল্লা -বৈশাখ-১৩২৮)
নার্গিস-নজরুল উভয়ের দুষ্টি মিলন ঘটে ভালো লাগার যে মোহনীয় ক্ষণ আসে, সেটা সুন্দরী ষোড়শী নার্গিসও ভালোবেসে ফেলেন মাথাভরা বাবড়ি দোলানো চুল, ভরাট গাল, টানাটানা চোখ, সুঠাম দেহের তরুণ কাজী নজরলকে। সেখান থেকেই শুরু হয় নার্গিস- কাজী নজরুলর ইসলামের প্রেম-পরিণয় ও বিচেছদের করুণ কাহিনী। নার্গিস আসার খানমের সলামের কাজী নজরুল ইসলামের পরিচয়, প্রণয়, পরিণয় এবং বিচ্ছেদ খুবই সল্পসময়ের মধ্যে ঘটলেও এ আনন্দ-বিরহের ঘটনা কেবলমাত্র নার্গিস-নজরুলের ব্যক্তিজীবনেই নয় পরবর্তীতে তা নজরুল-সাহিত্য এবং নজরুল-গবেষণার ক্ষেত্রেও যথেষ্ট প্রভাব ও অভিঘাত সৃষ্টি করেছে। শুধু কুমিল্লা এবং দৌলতপুরেই নয়, নার্গিস নজরুলের জীবদ্দশায় কোন দিনই বুকের ভেতর থেকে আলাদা হয় নি। তাই অধিকাংশ কাব্যে নার্গিসের সুর বেজে ওঠে। অতি অল্প সময়ের জন্য হলেও জীবনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, মান-অভিমান, সোহাগ-অনুরাগ তাদের পরস্পরের মধ্যে কম হয়নি। “অনাদৃতা” কবিতায় সেই চিত্রই ফুটে উঠেছে ।
‘অনাদৃতা’ (আংশিক)
ওরে অভিমানিনী!
এমন করে বিদায় নিবি ভুলেও জানিনি।
পথ ভুলে তুই আমার ঘরে দু’দিন এসেছিলি,
সকল-সহা! সকল সয়ে কেবল হেসেছিলি।
হেলায় বিদায় দিনু যারে
ভেবেছিনু ভুলব তারে, হায়!
ভোলা কি তা যায়?
ওরে হারা-মণি! এখন কাঁদি দিবস-যামিনী।।
(দৌলতপুর, কমিল্লা -বৈশাখ-১৩২৮)
রোমান্টিক কাব্যে প্রকৃতির সাথে মানুষের একটা সহজ নিবিড় ও আন্তরিক সম্পর্ক স্থাপনের প্রয়াস করা হয়ে থাকে এবং রোমান্টিক কবি নজরুরেও এর ব্যতিক্রম নন। মানুষের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্না, মিলন-বিরহ, আশা-ভরসা, ইত্যাদিতে প্রকৃতি সহানুভুতি জ্ঞাপন করে থাকে। ‘বেদনার অভিমান’ কবিতায় ঠিক এমন একটা অনুভুতি উজ্জীবিত হয়েছে। দয়িতার ভালোবাসার বার্তায় দয়িতের যে আনন্দ, এতে প্রকৃতিও অংশভাগ হয়। নজরুলের মধ্যে মানুষের সুখ-আনন্দ-উল্লাস অপেক্ষা ব্যথা-বেদনা-বিরহেরই প্রকৃতি সমাধিক সহানুভ’তি জ্ঞাপন করেছে। কেননা তাঁর কাব্য মূলত বিরহের কাব্য। ‘বেদনার অভিমান’ কবিতায় কোন এক অভিমানী গৃহহারা পথিকের জন্য সমগ্র প্রকৃতি ¯েœহব্যাকুল হয়ে উঠেছে এবং তাকে সাদও আমন্ত্রণ জানিয়েছে।
‘বেদনা-অভিমান’ (আংশিক)
ওরে আমার বুকের বেদনা!
ঝঞ্ঝা-কাতর নিশীথ রাতের কপোত সম রে
আকুল এমন কাঁদন কেঁদো না।
কখন সে কার ভুবনভরা ভালোবাসা হেলায় হারালি,
তাইতো রে আজ এড়িয়ে চলে সকল স্নেহে পথে দাঁড়ালি!
(দৌলতপুর, কমিল্লা জৈষ্ঠ-১৩২৮)
নজরুল কাব্যে নারীরা কল্যাণী, প্রেমময়ী ও যে কোন মহান সৃষ্টির মূলে নারী। যুগে যুগে নারীরাই সাহিত্য-শিল্প সৃষ্টির মূলে প্রেরণা যুগিয়েছে। প্রেত্রার্কের লরা, দাম্ভেও বিয়াত্রিচ, কীটসের ফ্যানি, শেলির এমিলিয়া, চÐীদাসের রামী, রবীন্দ্রনাথের কাদম্বরী, আর নজরুলের নার্গিস এরাই বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কাব্যের নায়িকা। একদিকে যেমন বিরহের অতল গভীর বেদনা, অপরদিকে তেমন মিলনের সুনিবিড় আনন্দের কথা কবিতা, শব্দ, গান হয়ে ওঠে। নজরুল মানসের অবচেতন মন প্রবল ও সক্রিয় এবং কাব্য সৃষ্টিতে এর পরিচয় নানাভাবে পরিলক্ষিত হয়। হয়তো বা নার্গিসের নিকট থেকে যৌবনে নিদারুণ আঘাৎতাঁর মনের গহীণে প্রবল রেখোপাত করে। সজ্ঞান ও সচেতনভাবে তিনি জীবনের এ সংক্ষিপ্ত অধ্যায়টি যতই বিস্মৃত হওয়ার প্রয়াস করুন না কেন কোন দিন তা সম্ভব হয়ে ওঠে নি। সজ্ঞান মনে মনে নারীকে আদর্শমÐিত কওে দেখলেও এবং নারীর মহিমা ঘোষণায় তৎপর হয়ে উঠলেও নির্ঝ্ঞান মনে নারীর যেকঠোর ও কুৎসিত রূপ রেখোপাত করেছেএর বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে অন্যৗান্য ববিতায়। “পরশ পূজা” কবিতাটি এমনি এক সজ্ঞান মনে আদর্শমÐিত করার রূপ। (আংশিক)
আমি এদেশ হতে বিদায় যেদিন নেব প্রিয়তম,
আর কাঁদবে এ বুক সঙ্গীহারা কপোতিনী সম,
তখন মুকুর পাশে একলা গেহে
আমারই এই সকল দেহে
চুমব আমি চুমব নিজেই অসীম স্নেহে গো,
আহা পরশ তোমার জাগছে যে গো এই সে দেহে মম।
(দৌলতপুর, কমিল্লা -আষাঢ়-১৩২৮)
তথ্যসূত্র-
ইন্টারনেট মেডিয়া থেকে সংগৃহিত
নজরুল প্রতিভা- মোবাশ্বের আলী
নজরুল প্রসঙ্গে- রফিকুল ইসলাম
‘কেউ ভোলে না কেউ ভোলে’- শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
কাজী নজরুল ইসলাম ‘স্মৃতিকথা’-মুজফফর আহমদ
কুমিল্লায় নজরুল স্মৃতি, প্রেম ও পরিণয়-তিতাশ চৌধুরী